০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`


স্যার ফজলে হাসান আবেদ

স্যার ফজলে হাসান আবেদ - ছবি : সংগ্রহ

কথায় বলে, ‘শক্তিমানরা টিকে থাকেন আর দুর্বলরা হটে যান।’ এ হচ্ছে মানুষের টিকে থাকার শুধু নয়, সেরা ও সাহসী কাজ করার শক্তি। এতে যারা বলীয়ান বিজয়গাথা কেবল তাদের নিয়ে। বাসযোগ্য এ পৃথিবীতে উর্বর ভূমি অগণিত শ্রেষ্ঠ সন্তান উপহার দিয়েছে। যাদের রয়েছে অনন্য অসাধারণ অবদান এবং তাদের কৃতিত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব আকাশচুম্বী। মেধা আর কর্মের কারণে দেশে বিদেশে সর্বত্রই তারা প্রশংসিত ও সম্মানিত। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যতদিন থাকবে ততদিন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কলমজাদুকর হুমায়ুন আহমেদ প্রমুখের নাম থাকবে। আবিষ্কারের জন্য এডিসন, মাইকেল ফ্যারাডে, চার্লস ব্যাবেজ কিংবা জুকারবার্গে র নাম কখনো হারিয়ে যাবে না। মহান স্বাধীনতা এনে দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম চিরভাস্বর থাকবে। এভাবে অনেকের নাম ইতিহাসে চিরকাল অমর এবং অম্লান। স্যার ফজলে হাসান আবেদ কেসিএমজি বর্ণাঢ্য জীবনে জাতির গর্ব। পরবর্তী প্রজন্মের অনুপ্রেরণার বাতিঘর, বাংলাদেশের উন্নয়ন ব্যক্তিত্ব, দায়িত্ববোধ, সহমর্মিতা ও নিরলস শ্রমের এক অবিস্মরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের কারণে জীবদ্দশাতেই তিনি কিংবদন্তিতে পরিণত হন।

১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার কামালখানিপাড়া গ্রামে তিনি জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী এবং কুমিল্লা জিলা স্কুলে সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়নের পর পাবনা জিলা স্কুলে ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেভভাল আর্কিটেকচার কোর্সে ভর্তি হন কিন্তু এই কোর্স অসমাপ্ত রেখে চার বছরের সিএ কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬২ সালে লন্ডনে কিছুদিন চাকরি করার পর কানাডায় চলে যান। সেখানেও চাকরি করার পর যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ১৯৬৮ সালে দেশে ফিরে শেল ওয়েল কোম্পানির হেড অব ফাইন্যান্স পদে যোগ দেন। ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়বিপন্ন দ্বীপ, ভোলার মনপুরায় ত্রাণসেবা পরিচালনা করেন। সেটাই তার জীবনে মানুষের জন্য কাজ করার প্রথম উদ্যোগ; বলা যেতে পারে, ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক বীজ বপন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে পাল্টে যায় তার জীবনের গতিপথ। ১৯৭১ সালের যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য গড়ে তোলেন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ এবং ‘হেল্প বাংলাদেশ’ নামে দুটি সংগঠন।

তিনি ছিলেন প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি আবেদ দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নব্য স্বাধীন বাংলাদেশে দরিদ্র, অসহায়, সর্বহারা মানুষের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য Bangladesh Rehabilitation Assistance Committee বা BRAC প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৭ সালে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দেশ স্বাধীন হলে অসহায় দুর্গত মানষের কাছে গিয়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ করব।’ দেশ স্বাধীন হলে ভারত থেকে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ফিরে এলো। অসহায় ছিন্নমূল সেই মানুষদের জরুরি সেবা এবং ত্রাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলো। যুদ্ধ চলাকালে লন্ডনের ফ্ল্যাটটি বিক্রি করার টাকা নিজের কাছে রেখেছিলেন পরবর্তীতে সেই টাকা দিয়ে উত্তর পূর্ব সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত থানা শাল্লার পুরো এলাকা; পরে দিরাই ও বানিয়াচংয়ের কয়েকটি ইউনিয়নে ব্র্যাকের কার্যক্রম শুরু করেন। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল দারিদ্র্য বিমোচন ও দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়ন। বর্তমানে দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি জরুরি ত্রাণ সহায়তাসহ নানান কার্যক্রম ব্র্যাক চালিয়ে যাচ্ছে।

ব্র্যাক এক লাখ কর্মী নিয়ে পৃথিবীর ১১টি দেশে ১২০ মিলিয়ন মানুষকে বিভিন্ন সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার আবেদ ব্র্যাকের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন। টিকাদান, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, যক্ষ্মা প্রতিরোধসহ তাদের অনেক কর্মসূচি রয়েছে। আশির দশকে এ দেশে ডায়রিয়া মহামারীর রূপধারণ করলে রোগীদের বাঁচানোর জন্য ব্র্যাক বা তাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার স্যালাইন তৈরি করা শিখিয়ে দেন। বিগত চার দশক ধরে বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশের দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে, শিক্ষাস্বাস্থ্য, মানবাধিকার ও সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য ২০১০ সালে যুক্তরাজ্য থেকে একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে তাকে নাইট উপাধি (নামের আগে ‘স্যার’) দেয়া হয়। তাঁর প্রাপ্ত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরস্কার হলো- র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার (১৯৮০), ব্র্যাকের জন্য ইউনেস্কোর নোমা পুরস্কার (১৯৮৫), ও স্বাধীনতা পুরস্কার (২০০৭), বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার (২০১৫), শিক্ষায় অবদানের জন্য ইদান পুরস্কার ও স্বর্ণ পদক (২০১৯)। এত যশ সম্মান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও পুরস্কার পেয়েও তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী এবং নির্মোহ। সবার কথা শুনতেন এবং সাক্ষাতের সময় বের করে নিতেন। বক্তৃতা দিয়ে নয়, কাজের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত তুলে ধরতেন। জনহিতকর প্রতিষ্ঠান ‘ব্র্যাক’ চালু করার পর সেটাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ২০০২ সালের সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার স্ত্রীসহ এবং ২০০৫ সালে মাইক্রোসফট করপোরেশনের কর্ণধার বিল গেটস স্ত্রীসহ ব্র্যাকের কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। ২০১০ সালে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব আবেদকে বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর স্বনামধন্য ব্যক্তিদের একজন হিসেবে নিয়োগ করেন। তিনি চাইলে অনেক সম্পদের মালিক হতে পারতো কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল দরিদ্র মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ব্র্যাক থেকে বেতন নিই; কিন্তু আমার নিজের কিছুই নেই। নিজের বাড়ি নেই। ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থাকি। যখন ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করি, তখনই নিজের জন্য কিছুই করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ নিজের সম্পদ গোছানোর ব্যবস্থা করতে গেলে গরিবদের সাহায্য করতে পারব না।’ তথ্য ও প্রযুক্তিবান্ধব নতুন নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে তিনি স্বেচ্ছায় চেয়ারপারসনের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আবারো দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর হাসপাতালে (বিদেশে গিয়ে নয়) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও তিনি ব্র্যাকসহ জনকল্যাণকর অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চিরকাল বেঁচে রইবেন।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
kaisardinajpur@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
সন্দেশখালির ধর্ষণের অভিযোগ সাজানো, বিজেপি নেতার ভিডিওতে তোলপাড় খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় বজ্রপাতে মা-ছেলের মৃত্যু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় পূর্ব আফ্রিকায় মানবিক সঙ্কটের অবনতির হুমকি স্বরূপ এ জে মোহাম্মদ আলীর সম্মানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকাজ বন্ধ ঘোষণা অনির্দিষ্টকালের জন্য সারাদেশে কর্মবিরতিতে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভিসা অব্যাহতি ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ নিয়ে বাংলাদেশ-মিসরের আলোচনা দুই অঞ্চলে ঝড়ের আভাস আ’লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভা আজ রাশিয়ার ড্রোন হামলায় ইউক্রেনের খারকিভ-নিপ্রো অঞ্চলে আহত ৬ যুদ্ধবিরতি : নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করল হামাস কাশ্মিরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর গাড়িতে হামলা, হতাহত ৫

সকল