গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল আলোচিত একটি পরমাণু চুক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টায় আগামী ২৯ নভেম্বর থেকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় বিশ্বের ক্ষমতাধর পাঁচ দেশের সাথে আলোচনায় বসছে ইরান।
জয়েন্ট কম্প্রেহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন বা সংক্ষেপে জেসিপিওএ নামে পরিচিত এই চুক্তিটি ২০১৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ভিয়েনায় ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স ও জার্মানি স্বাক্ষর করে।
কিন্তু ২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চুক্তিটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে যাওয়ায় তা অকার্যকর হয়ে পড়ে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে।
ইরানি পরমাণু স্থাপনার ওপর সম্ভাব্য হামলার জন্য ইসরাইল তার সশস্ত্র বাহিনীকে প্রস্তুত রাখতে ইতোমধ্যে ১৫০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছে।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএ সতর্ক করে দিয়ে বলছে, ইরানের গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরমাণু স্থাপনা পরিদর্শনের ব্যাপারে তেহরানের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে তারা।
ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে। তেহরান সবসময়ই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
ইরান বলছে, শক্তিধর বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে স্বাক্ষরিত আগের চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করা হলে তারা তাকে স্বাগত জানাবে। ওই চুক্তিতে ইরানের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার বদলে দেশটির পরমাণু কর্মসূচির বিষয়ে কিছু সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।
ভিয়েনার আলোচনা সফল হলে ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হতে পারে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে ইরানের সম্ভাব্য বিপজ্জনক পরমাণু সামগ্রী উৎপাদনের ক্ষেত্রেও কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করা হবে।
তবে যদি আলোচনা ব্যর্থ হয় তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি বিপজ্জনক পথে মোড় নিতে পারে।
মূল চুক্তিতে কী আছে?
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে চুক্তিটি হয়েছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশ - যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এবং জার্মানির সঙ্গে। এই পক্ষগুলো পরিচিত 'পি৫ + ১' হিসেবে।
এই সমঝোতায় ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ ও মজুদ করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। চুক্তি অনুসারে তেহরান তাদের কিছু পরমাণু স্থাপনা বন্ধ করে দিতে অথবা পরিবর্তন করতে সম্মত হয়। এছাড়াও ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের অনুমতিও দেয়া হয়।
অন্যদিকে ইরানের ওপর আরোপিত অনেক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
পি৫ + ১ বিশ্বাস করেছিল যে এই চুক্তি পরমাণু অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টায় ইরানকে প্রতিহত করবে।
ইরান এই ধরনের চেষ্টার কথা সবসময় অস্বীকার করেছে। কিন্তু বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা ইরানের বিরুদ্ধে এই চেষ্টা অব্যাহত রাখার অভিযোগ এনেছে।
ইরান আশা করেছিল, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে তাদের বিপর্যস্ত অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
দীর্ঘ সময় ধরে ধারাবাহিক আলোচনার পর চুক্তিটি ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে কার্যকর হয়।
চুক্তিটি কেন ধসে পড়লো?
খুব ছোট্ট করে এর উত্তর হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্প।
চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে। কিন্তু ২০১৭ সালে নির্বাচিত হয়ে হোয়াইট হাউজে আসার অনেক আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্প পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন, এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নেবেন তিনি।
ওই সময় তিনি বলেছিলেন, এটি তার দেখা সবচেয়ে বাজে চুক্তি।
ইরানের সাথে বিশ্বশক্তিগুলোর এই সমঝোতাকে বরাবরই 'বীভৎস' ও 'হাস্যকর' বলে উল্লেখ করে আসছিলেন তিনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা খুবই দুর্বল।
তার মতে, এই চুক্তিতে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ওপরেও বিধি-নিষেধ আরোপ করা উচিত ছিল।
২০১৮ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রকে এই চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে ইরানের ওপর পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন ট্রাম্প।
এর জবাবে ইরান চুক্তিতে বেঁধে দেওয়া সীমার চেয়েও অধিক মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে শুরু করে এবং আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা কমিয়ে দেয়।
চুক্তিটি কারা পুনরুজ্জীবিত করতে চায়?
আপাতদৃষ্টিতে চুক্তিটি যারা স্বাক্ষর করেছে তাদের প্রত্যেকে এটি ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী।
ইরান কখনও চায়নি এই সমঝোতা বাতিল করা হোক। চায়নি 'পি৫+১' এর দেশগুলোও।
একমাত্র ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তিটি বাতিল করতে চেয়েছে।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বারাক ওবামার শাসনামলে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় চুক্তিটি সমর্থন করেছিলেন।
এছাড়াও ছয় বছর আগে ২০১৫ সালে চুক্তিটি হওয়ার ব্যাপারে যারা সাহায্য করেছিলেন তাদের বেশিরভাগই এখন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ইরান বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।
আলোচনা সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতখানি?
আলোচনার সাফল্যের পথে কিছু বাধা বিপত্তি রয়েছে। চুক্তিটি ভেঙে পড়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্রুদ্ধ ইরান। তারা দেশটিকে একটি 'দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র' হিসেবে উল্লেখ করছে।
ইরানের কাছে অগ্রাধিকার পাচ্ছে তাদের ওপর আরোপিত যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়টি। কিন্তু ওয়াশিংটন চায় ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজ বন্ধ করুক।
দুই দেশই চায় অপরপক্ষ যেন আগে তাদের কাজটি করে।
এই কারণেই ইরান ও যুক্তরাষ্টের মধ্যে সরাসরি আলোচনা হচ্ছে না।
এছাড়াও ইরান চলতি বছরের জুন মাসে সাইয়েদ ইবরাহিম রইসিকে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার সরকারকে আগের সরকারের তুলনায় কট্টরপন্থী বলে মনে করা হয়।
প্রেসিডেন্ট রইসি বলেছেন, তিনি ভিয়েনার আলোচনাকে প্রলম্বিত হতে দেবেন না।
একই সঙ্গে তিনি ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও তাদের আঞ্চলিক নীতির ব্যাপারে যেকোনো ধরনের সমঝোতার সম্ভাবনার কথা নাকচ করে দিয়েছেন। এই নীতির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেশে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর প্রতি ইরানের সমর্থন।
এসব কারণে চুক্তিটি পুনরুজ্জীবিত করার কাজ কিছুটা কঠিন হতে পারে।
চুক্তিটি ফিরে এলে সবাই কি খুশি হবে?
ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র সৌদি আরব সতর্কতার সঙ্গে পুরনো চুক্তিটিকে সমর্থন করেছিল।
তবে মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে বিবেচিত দেশ ইসরাইলই এই চুক্তিটির বড় সমালোচক। যদিও ইসরাইলি কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কাছে পরমাণু অস্ত্র থাকার বিষয় স্বীকার করেনি।
ইসরাইল মনে করে, চুক্তিবদ্ধ থাকলেও পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে ইরান অগ্রসর হতে পারবে।
তেলআবিব বলছে, তারা ইরানকে কখনোই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে দেবে না।
এর আগে মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া ও ইরাকের পরমাণু স্থাপনা একাকি বিমান হামলা চালিয়ে ধ্বংস করেছিলো ইসরাইল।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা