২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যে ৫ কারণে আরব দেশগুলোর সাথে ইসরাইলের শান্তি চুক্তি এতটা গুরুত্বপূর্ণ

ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এক ঐতিহাসিক ফ্লাইটে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যান - ছবি : বিবিসি

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরাইল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল আজ মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে এক ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তিতে সই করবে।

এই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও। সেখানে বাহরাইনের পক্ষ থেকে ইসরাইলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের ঘোষণা দেয়া হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত সপ্তাহে এরকমটাই জানিয়েছেন।

এই শান্তি চুক্তি যে পাঁচটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ তা বিশ্লেষণ করেছেন বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সংবাদদাতা জেরেমি বোয়েন :

১. উপসাগরীয় দেশগুলো দেখছে বাণিজ্য এবং আরো অনেক কিছুর সম্ভাবনা
উচ্চাকাঙ্ক্ষী আমিরাতিদের সাহায্য করবে এই চুক্তি। সংযুক্ত আরব আমিরাত উপসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের এক সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাদের দেশ হয়ে উঠেছে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পর্যটনের এক বড় কেন্দ্র।

মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এই শান্তি চুক্তির ব্যাপারে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে রাজি করিয়েছে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র দেয়ার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে। অতীতে এরকম সমরাস্ত্র সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাগালের বাইরে ছিল, তারা কেবল এমন সমরাস্ত্র কেনার স্বপ্নই দেখতে পারতো। এরকম সমরাস্ত্রের মধ্যে আছে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান এবং ইএ-১৮জি গ্রোলার ইলেকট্রনিক যুদ্ধ বিমান।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক বাহিনী এমনিতে যথেষ্ট সুসজ্জিত। এই বাহিনীকে তারা যুদ্ধে পাঠিয়েছে লিবিয়া এবং ইয়েমেনে। কিন্তু তাদের সবচেয়ে সম্ভাব্য বড় শত্রু কিন্তু ইরান। উপসাগরের ঠিক উল্টো দিকে যে দেশটি।

ইরানকে সংযুক্ত আরব আমিরাত যেরকম সন্দেহের চোখে দেখে, ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রও তাই। বাহরাইনও সন্দেহ করে ইরানকে। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ইরান দাবি করতো বাহরাইন তাদের দেশেরই অংশ। বাহরাইনের শাসকরা সুন্নি। কিন্তু দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শিয়া। কাজেই সুন্নি শাসকরা এই শিয়াদের ইরানের সম্ভাব্য ‘ফিফথ কলাম’ বা ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ বলে ভাবেন।

এই দুটি উপসাগরীয় দেশ অবশ্য ইসরাইলের সাথে তাদের সম্পর্ক নিয়ে রাখঢাক কমই করে। এখন তারা ইসরায়েলের সাথে খোলাখুলি বাণিজ্য করার আশায় তাকিয়ে আছে। ইসরাইল হচ্ছে প্রযুক্তির দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসর দেশগুলোর একটি।

কোভিড মহামারি যখন ছিল না, তখন ইসরাইলিরা কিন্তু ছুটি কাটাতে প্রচুর বেড়াতো। কাজেই উপসাগরীয় দেশগুলোর মরুভূমি, সৈকত আর শপিং মলে যেতে তারা উদগ্রীব থাকবে। কাজেই দুপক্ষের জন্যই হয়তো এটি এক ভালো ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ।

২. মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের নিঃসঙ্গতা কমবে
সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারটা ইসরাইলের জন্য সত্যিকার অর্থেই এক বিরাট অর্জন।

প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাদের ইহুদী রাষ্ট্র এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ‘আয়রন ওয়াল’ বা ‘লৌহ প্রাচীরের’ কৌশলে বিশ্বাসী। ১৯২০ এর দশকে এই কৌশলের কথা প্রথম বলা হয়।

এই কৌশলের মূল কথা হচ্ছে, ইসরাইলকে এতটাই শক্তিশালী হতে হবে যাতে করে শেষ পর্যন্ত আরবরা বুঝতে পারবে ইসরাইলের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

কিন্তু ইসরাইল আবার মধ্যপ্রাচ্যে একদম একঘরে হয়ে থাকতে চায় না। মিসর আর জর্ডানের সাথে শান্তি চুক্তি হয়েছে সত্যি, কিন্তু সম্পর্ক কখনোই উষ্ণ ছিল না। তবে উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের বেলায় ইসরাইল হয়তো একটু বেশি আশাবাদী হতে পারে। কারণ জেরুসালেম আর অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চল থেকে এই দেশগুলো অনেক দূরে।

আর ইরানের বিরুদ্ধে জোট আরো শক্তিশালী করার ব্যাপারটা তো আছেই। নেতানিয়াহু মনে করেন, ইরান হচ্ছে তার দেশের এক নম্বর শত্রু। মাঝে মধ্যে তিনি ইরানের নেতাদের তুলনা করেন নাৎসীদের সাথে। অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্ভাব্য অস্ত্র চুক্তি সম্পর্কে তার যে আপত্তি ছিল, তিনি আপাতত সেটা চেপে গেছেন।

তবে নেতানিয়াহু স্বদেশের রাজনীতিতে কোনঠাসা হয়ে আছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, এই অভিযোগে তার বিচার হতে পারে। তিনি জেলে যেতে পারেন। করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় তিনি শুরুটা ভালোই করেছিলেন, কিন্তু এরপর ব্যাপারটা একেবারেই তালগোল পাকিয়ে গেল। বিরোধী দলগুলো এখন প্রতি সপ্তাহেই জেরুসালেমে তার বাসভবনের বাইরে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে।

কাজেই এরকম এক দুঃসময়ে হোয়াইট হাউসে এমন এক শান্তি চুক্তির অনুষ্ঠান তার জন্য যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।

৩. ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির জন্য এক বিরাট সাফল্য
এই চুক্তি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্যও নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ।

ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের কৌশলে বিশ্বাসী। এই শান্তি চুক্তি তার সেই কৌশলের পক্ষে সমর্থন আরো জোরালো করবে। আর নির্বাচনের বছরে এটি তার জন্য একটি দারুণ অস্ত্রও বটে। তিনি যে সবসময় বড়াই করে বলেন, বিশ্বে সবচেয়ে বড় ‘ডিল-মেকার’ হচ্ছেন তিনি, সেটা এখন আরো জোর গলায় বলতে পারবেন।

তার যে কোনো কাজ, যেটিতে ইসরাইলের সুবিধা হয়, বা আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সুবিধা হয়, সেটা আমেরিকার ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টানদের খুশি করবে। এই ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টানরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনের একটা বড় ভিত্তি।

ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্প আমেরিকার বন্ধুদের যে জোটের কথা বলেন, সেটা অনেক বেশি ভালোভাবে কাজ করবে যদি উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলের সাথে গোপন সম্পর্কের খোলস থেকে বেরিয়ে প্রকাশ্যে খোলাখুলি সম্পর্ক স্থাপন করে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তথাকথিত ‘শতাব্দীর সেরা সমঝোতা’ বলে যে শান্তি চুক্তির কথা বলতেন, সেটার কোনো নিশানা দেখা যাচ্ছে না।

কিন্তু ইসরাইল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে এই সমঝোতা, যেটার নাম দেয়া হয়েছে ‘আব্রাহাম চুক্তি’, তা মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্যে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনবে। ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস স্বাভাবিকভাবেই এটিকে তাদের পররাষ্ট্রনীতির এক বিরাট অর্জন বলে বর্ণনা করছে।

৪. ফিলিস্তিনির মনে করছে তারা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার
আবারো ফিলিস্তিনিদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে কাঠের চামচ।

আব্রাহাম চুক্তিকে তারা এরই মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা বলে বর্ণনা করেছে। আরব দেশগুলোর মধ্যে বহু বছরের একটা ঐকমত্য ছিল। সেটি হচ্ছে, ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক একমাত্র ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার মাধ্যমেই হতে পারে।

কিন্তু ফিলিস্তিনিরা যখন পূর্ব জেরুসালেম আর পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের মধ্যে দুঃসহ দিন কাটাচ্ছে, গাজার খোলা কারাগারে বন্দী, তখন ইসরাইল এই আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে তার সম্পর্ক সুদৃঢ় করছে।

আবুধাবীর যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানই কার্যত সংযুক্ত আরব আমিরাতের শাসক। তিনি বলেছিলেন, এই চুক্তির বিনিময়ে ইসরাইলকে রাজি হতে হবে যে, পশ্চিম তীরের এক বিরাট ফিলিস্তিনি এলাকা তারা নিজেদের সীমানাভুক্ত করবে না।

প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু অবশ্য পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি অঞ্চল সীমানাভুক্ত করার পরিকল্পনার জন্য প্রচণ্ড আন্তর্জাতিক বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন।

এ কারণে তাকে মনে হচ্ছিল যেন এই পরিকল্পনা থেকে পিছু হটতে হচ্ছিল। এখন অবশ্য তিনি এই রাজনৈতিক কানা-গলি থেকে বেরিয়ে আসতে যেন মুখ রক্ষার একটা সুযোগ পেলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে এই চুক্তির সুবাদে।

তবে এই কাজ তারা কখনোই করতে পারতো না সৌদি আরবের সম্মতি ছাড়া। আরব শান্তি চুক্তি প্রণয়নকারী অন্যতম দেশ হচ্ছে সৌদি আরব, যাতে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার দাবি তোলা হয়েছিল।

সৌদি বাদশাহ সালমান হচ্ছেন ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র দুটি স্থানের জিম্মাদার। এই সুবাদে তিনি বিপুল কর্তৃত্বের অধিকারী ইসলামী দুনিয়ায়। কাজেই হঠাৎ করে তিনি ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে বসবেন এমন সম্ভাবনা কম।

তবে তার ছেলে এবং রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান হয়তো অতটা আপত্তি করবেন না।

৫. ইরানের জন্য এক নতুন মাথাব্যাথা
ইরানের নেতারা এই চুক্তির ব্যাপক নিন্দা করেছেন।

এটা শুধু বাগাড়ম্বর নয়। আব্রাহাম চুক্তি আসলেই তাদের একটা বাড়তি চাপের মুখে ফেলবে।

ইরানের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন সেটা এমনিতেই যথেষ্ট অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করেছে। এখন তাদের জন্য যোগ হলো এক নতুন কৌশলগত মাথাব্যাথা।

ইরান থেকে ইসরাইলের বিমান ঘাঁটিগুলো বহু দূরে। কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিমান ঘাঁটিগুলো উপসাগর পাড়ি দিলেই অপর তীরে। ইরানের পরমাণু স্থাপনার ওপর যদি কখনো বিমান হামলার কথা উঠে, তখন এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

ইরানীদের জন্য নড়াচড়ার জায়গা যেন আগের চাইতে অনেক বেশি সংকুচিত হয়ে এলো।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement