‘যেভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলাম’
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৪ জানুয়ারি ২০১৯, ১০:১৩
এটা এমনই এক নাটকীয় ঘটনা যার মধ্য দিয়ে সৌদি আরবে নারীদের সমস্যার ওপর নতুন করে বিশ্বের নজর পড়েছে।
আঠারো বছর বয়সী রাহাফ মোহাম্মদ আল-কুনুন গত সপ্তাহে ব্যাংকক বিমানবন্দরের হোটেল কক্ষে নিজেকে অবরুদ্ধ করেন এবং আর বাড়ি ফিরে যাবেন না বলে ঘোষণা করে বিশ্বব্যাপী বিতর্কের সূচনা করেন।
তিনি তার জন্মভূমি সৌদি আরব থেকে পালিয়েছেন। তাকে ঘিরে টুইটারে এক তীব্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ক্যানাডার সরকার রাহাফ মোহাম্মদ আল-কুনুনকে আশ্রয় দিয়েছে।
সৌদি আরবে নারীদের অধিকার এবং মর্যাদা নিয়ে বিতর্ক যখন চলছে তখন রাহাফ আল-কুনুনের মতো আরও একজন নারী এর আগে দেশ থেকে পালিয়ে ক্যানাডায় আশ্রয় নিয়েছেন।
তার নাম সালওয়া। চব্বিশ-বছর বয়সী এই নারী তার এক বোনকে নিয়ে সৌদির আরব থেকে পালিয়ে ক্যানাডায় চলে যান।
এখানে তার নিজের বর্ণনাতেই পড়ুন তার কাহিনী:
ঘর থেকে পালানোর প্রস্তুতি
ছয় বছর ধরে আমরা দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করছিলাম। কিন্তু এটা করতে হলে আমাদের পাসপোর্ট এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হতো।
এই কাগজগুলো জোগাড় করতে হলে আমার অভিভাবকের সম্মতি লাগতো। (সৌদি আরবে নারীদের বহু কিছু পেতে হলে পরিবারের পুরুষ অভিভাবকের সম্মতির প্রয়োজন হয়।)
সৌভাগ্যক্রমে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলাম তখন আমার একটি জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরি করা হয়েছিল। আমার একটি পাসপোর্টও ছিল। কারণ একটি ইংরেজি ভাষা পরীক্ষার জন্য পাসপোর্টের দরকার হতো।
কিন্তু আমার পরিবার এগুলো আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাই, যে কোন উপায়ে আমাকে ঐ কাগজগুলো জোগাড় করা দরকার হয়ে পড়েছিল।
তাই আমি আমার ভাইয়ের বাড়ির চাবি চুরি করি। এরপর চাবি তৈরির দোকানে গিয়ে সেগুলোর নকল তৈরি করি। আমি লুকিয়ে বাড়ি থেকে বের হই। কাজটা ছিল খুবই বিপজ্জনক। ধরা পড়লে সমূহ বিপদ ছিল।
এভাবে নকল চাবি হাতে আসার পর আমার এবং আমার বোনের পাসপোর্ট দুটি আমার হাতে চলে আসে। একদিন আমার বাবা যখন ঘুমিয়ে ছিলেন, তখন আমি তার মোবাইল ফোনটি ব্যবহার করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার অ্যাকাউন্টে লগ-ইন করি এবং সেখানকার রেজিস্টার্ড ফোন নাম্বারটি বদলে আমার মোবাইল নাম্বার দিয়ে দেই।
তার অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেই আমি দেশ ত্যাগের জন্য আমার বাবার অনুমতিপত্র জোগাড় করি।
যেভাবে ছাড়তে হলো দেশ
একরাতে সবাই যখন ঘুমচ্ছিল তখন আমরা দুই বোন গোপনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। আমরা গাড়ি চালাতে জানি না। সেজন্য ট্যাক্সি ডাকি।
ঘটনাচক্রে সৌদি আরবে বেশিরভাগ ট্যাক্সি ড্রাইভার হলেন বিদেশি।
ফলে, দুজন নারী নিজেরাই বিমানবন্দরে যাচ্ছেন, এটা নিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভারের মনে কোন প্রশ্নের উদয় হয়নি। আমরা রিয়াদে বাদশাহ খালেদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে রওনা হলাম।
কেউ যদি এটা লক্ষ্য করতো এবং যদি আমরা ধরা পড়তাম, তাহলে নির্ঘাত আমাদের মৃত্যু হতো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বছরটিতে আমি এক হাসপাতালে কাজ করে যে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম।
তা দিয়েই আমরা বিমানের টিকেট এবং জার্মানিতে ট্রানজিট ভিসা জোগাড় করি।
সৌদি বেকার ভাতার কিছু অর্থও আমি জমিয়ে রেখেছিলাম। যাহোক, আমার বোনকে সাথে নিয়ে আমি জার্মানি-গামী বিমানে উঠে বসি।
এটা ছিল আমার প্রথম বিমান ভ্রমণ। সেই অভিজ্ঞতা ছিল অনন্য। একদিকে যেমন খুশি ছিলাম, অন্যদিকে বেশ ভয়ও লাগছিল।
বাড়ির সবাই সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন দেখলো আমরা দু'বোন বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছি তখন আমার বাবা পুলিশে খবর দেন।
কিন্তু যেহেতু আমি বাবার ফোন নাম্বার বদলে দিয়েছিলাম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যখনই বাবার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল, সেই কলগুলো আমার ফোনে বেজে উঠছিল।
জার্মানিতে বিমান নামার পরও আমি তাদের কাছ থেকে টেক্সট মেসেজ পাচ্ছিলাম।
যেখানে যাত্রার শেষ
সৌদি আরবে আমাদের যেটা ছিল তাকে ঠিক জীবন বলা চলে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে আমি বাড়িতে বসে থাকতাম।
সারাদিন কিছুই করার ছিল না। এটা আমাকে খুব কষ্ট দিতো। আমাদের শেখানো হয়েছিল পুরুষরা মেয়েদের চেয়ে সব দিকে থেকে ভাল। রমজান মাস এলে আমাকে রোজা রাখার জন্য জোরজবরদস্তি করা হতো।
জার্মানিতে পৌঁছানোর পর আমি লিগাল এইড গ্রহণ করলাম এবং একজন আইনজীবী খুঁজে বের করলাম যিনি আমাকে রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে সাহায্য করেছিলেন।
তার সাহায্যে আমি ক্যানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার আবেদনপত্র পূরণ করলাম। ক্যানাডাকে আমি বেছে নিয়েছিলাম তার কারণ দেশটির মানবাধিকার রক্ষার রেকর্ড খুবই ভাল।
সিরিয়ার শরণার্থীদের যেভাবে ক্যানাডা আশ্রয় দিয়েছিল, সেই খবর আমি আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলাম। তাই আমি ভাবলাম ক্যানাডাই হবে আমার থাকার জন্য সবচেয়ে ভাল জায়গা।
আমার আবেদনপত্র গৃহীত হওয়ার পর আমি জার্মানি থেকে ক্যানাডার শহর টরন্টোতে চলে আসি। যেদিন টরন্টোতে এসে নামলাম, বিমানবন্দরে ক্যানাডার পতাকা দেখে মনটা ভরে গেল।
এখন আমি আমার বোনকে নিয়ে মন্ট্রিয়াল শহরে থাকি। এখানে আমার জীবনে কোন শঙ্কা নেই। কোন কিছুর জন্য কেই আমাকে আর চাপ দেয় না।
সৌদি আরবে টাকা-পয়সা হয়তো অনেক বেশি, কিন্তু এখানে রয়েছে ব্যক্তি স্বাধীনতা। আমার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আমি যখন খুশি বাইরে যেতে পারি। কারও অনুমতি লাগে না।
এখানকার জীবন নিয়ে আমি সত্যি খুব খুশি। এখনকার প্রকৃতিতে হেমন্তের দৃশ্য আর বরফ পড়া দেখতে আমার খুব ভাল লাগে।
আমি এখন ফরাসি ভাষা শিখছি, সাইকেল চালানো শিখছি, সাঁতার কাটা শিখছি। আইস স্কেটিং শিখছি।
আমার মনে হচ্ছে জীবনটাকে নিয়ে সত্যি ভাল কিছু করছি। আমার পরিবারের সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই।
আমার মনে হয় একদিক থেকে সেটা দু'পক্ষের জন্যই ভাল হয়েছে। এখন আমার বাড়িঘর এখানেই। এই জীবনই আমার জন্য ভাল।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা