১০ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ কার্তিক ১৪৩১, ৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি

নৌ অধিদফতরের লাইটহাউজ প্রকল্পে অনিয়ম
-

দেশী-বিদেশী যৌথ অর্থায়নে চলমান নৌ-পরিবহন অধিদফতরের লাটহাউজ প্রকল্পে অনিয়মের তথ্য উদঘাটিত হওয়ার সাড়ে পাঁচ মাস পরও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি এ ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত প্রকল্প পরিচালককে (পিডি) স্বপদেই বহাল রাখা হয়েছে। তবে নৌ মন্ত্রণালয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নিলেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে দুদকের উপ-পরিচালক রতন কুমার দাশকে। তিনি প্রকল্পের সাত কর্মকর্তাকে ইতোমধ্যে দুদকে তলব করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াও প্রকল্পের বেশ কিছু কাগজপত্র সংগ্রহ করেছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। এছাড়া পিডিসহ অন্য অভিযুক্তদের শিগগির ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
নৌ মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌ চলাচল নিরাপদ করতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকার ও দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের যৌথ অর্থায়নে ৩৭০ কোটি ৮৯ লাখ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয় নৌ মন্ত্রণালয়। যা বাস্তবায়নের শেষ সময় ছিল ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬। লাইটহাউজ প্রকল্প নামে পরিচিত এস্টাব্লিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেসড অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে নৌ পরিবহন অধিদফতর।
প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ১১ তলা ভবনসহ বাগেরহাটের দুবলার চর, ভোলার ধলার চর, নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপ ও পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় একটি করে লাইটহাউজ ও রেডিও স্টেশন নির্মাণ এবং কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন ও কুতুবদিয়ায় তিনটি পুরনো লাইটহাউজ ও রেডিও স্টেশন আধুনিকায়নের কথা। তবে তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটি ৯ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। তিন দফায় এর সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। বরাদ্দের পরিমাণ ৩৭০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৭৭৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা হয়েছে।
এই সময়ের মধ্যে পিডি বদল হয়েছে তিনবার। প্রথম পিডি ছিলেন নৌ অধিদফতরের ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ার এস এম নাজমুল হক। দুদকের হাতে গ্রেফতার হয়ে তিনি সাময়িক বরখাস্ত হলে পিডির দায়িত্ব পান অধিদফতরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (সিএনএস) ক্যাপ্টেন জসিম উদ্দীন সরকার। তিনি প্রায় দুই বছর আগে চাকরি থেকে অবসরে গেলে অধিদফতরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার অ্যান্ড এক্সামিনার আবু সাঈদ মো: দেলোয়ার রহমান পিডি নিযুক্ত হন। এরপর থেকে মতিঝিলে অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ের কাছে আলাদা ভবনে প্রকল্প কার্যালয়ে বসেন তিনি।
সূত্র জানায়, মূল ঠিকাদার দক্ষিণ কোরিয়ার সামি কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ও কয়েকটি উপ-ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১১ তলা ভবনসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণে অহেতুক কালক্ষেপন এবং পিডি দেলোয়ারসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের বিরুদ্ধে ঠিকাদারদের অনিয়মে সহযোগিতার অভিযোগ ওঠে। বাড়তি ব্যয়সহ আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগও ওঠে পিডির বিরুদ্ধে। এ অবস্থায় গত ১০ এপ্রিল নৌ অধিদফতরের মহাপরিচালক (তৎকালীন) কমডোর নিজামুল হক একটি অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটি গঠন করেন। অধিদফতরের তৎকালীন পরিচালক (উপসচিব) বদরুল হাসান লিটনের নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের কমিটি ২১ এপ্রিল মহাপরিচালকের দফতরে প্রতিবেদন জমা দেয়।
অধিদফতরের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বেশ কিছু আর্থিক অনিয়ম ধরা পড়ে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২৩ কোটি ৮ লাখ ৪৬ হাজার ৬০০ টাকা ব্যয়ের তথ্য পায় নিরীক্ষা কমিটি। এ টাকা থেকে একজন দোভাষীকে এক বছরে বেতন পরিশোধ করা হয়েছে ২ কোটি ৬৮ লাখ ৬১ হাজার ৪০০ টাকা। সামি কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের দোভাষী মো: জসিম শেখকে ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৩ জুন প্রকল্পের ভবন ও স্থাপনাসমূহ খাত থেকে এ টাকা দেয়া হয়। পিডি আবু সাঈদ মো: দেলোয়ার রহমান নিজে গত বছরের ৩ এপ্রিল প্রশাসনিক ব্যয় খাত থেকে ৭ লাখ ২৬ হাজার ৮৪০ টাকা নিয়েছেন।
২০২১-২২ অর্থবছরের ভবন ও স্থাপনাসমূহ খাত হতে মুন ভিউ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড ও জুমাইমাহ ইন্টারন্যাশনাল (জেভি) নামে দুটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে ৫ কোটি ১৩ লাখ ১৯ হাজার ২৭৭ টাকা। গত বছরের ১৫ জুন মুন ভিউ ডেভেলপমেন্ট এই টাকা গ্রহণ করে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আর কে এস ট্রেডার্সকে ফি, চার্জ ও কমিশন খাত হতে আলাদাভাবে ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৬০০ টাকা ও ১ লাখ ৯৩ হাজার ৫২০ টাকা এবং যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি খাত হতে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭২০ টাকা প্রদান করা হয়েছে। তবে তিনটি বিলের মধ্যে একটি পাওয়া গেলেও অপর দুটি কমিটিকে দেয়া হয়নি।
মেরামত ও সংরক্ষণ খাতের আসবাবপত্র এবং ফিটিংস ও ফিক্সার উপখাত থেকে একই দিনে (১৫ জুন, ২০২২) আলাদা দুটি টোকেনে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৩২৮ টাকা দেয়া হয়েছে। এই দরপত্র কোটেশন কমিটিতে নৌ অধিদফতরের মহাপরিচালকের অনুমতি ছাড়াই পাট অধিদফতরের একজন সহকারী পরিচালককে রাখা হয়। নৌ মন্ত্রণালয়ের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার দফতর থেকে এ প্রকল্পের ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১৭ কোটি ১৮ লাখ ৬৬ হাজার ৪০০ টাকা ব্যয়ের তথ্য পায় নিরীক্ষা কমিটি। এর মধ্যে অনাবাসিক ভবন খাতে ব্যয় হয়েছে ১৫ কোটি ৫১ লাখ ৬৯ হাজার ১০০ টাকা। এ টাকার মধ্যে সামি কনস্ট্রাকশন দুটি বিলে যথাক্রমে ৩ কোটি ১১ লাখ ৪২ হাজার ৮০২ এবং ২ কোটি ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু কাজ সম্পন্নের ফিল্ড বুকের (সাইট বুক) কপি কমিটিকে দেয়া হয়নি। অবশিষ্ট টাকা দেয়া হয়েছে সিডিডিএল এবং স্পিডি গ্রুপ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানকে।
পেশাগত সেবা, সম্মানী ও বিশেষ হার খাতের কনসালট্যান্সি উপখাত হতে ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভে অ্যান্ড ডিজাইন, বেটস কনসালট্যান্ট এবং পাল্স কনসালট্যান্ট- তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ৬৩ লাখ ৬৫ হাজার ৪০০ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভে অ্যান্ড ডিজাইনের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে নকশায় নৌ অধিদফতরের অনুমোদনের শর্ত থাকলেও অনুমোদন নেয়ার কোনো প্রমাণ পায়নি কমিটি। এ ছাড়া বেট্স কনসাল্ট্যান্টকে নিয়োগের ক্ষেত্রে পিপিআর-২০০৮ এর ১১০ ধারার ১-৬ উপধারা মানা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পাল্স কনসালট্যান্টের বিলে সাইটবুকের তথ্য পায়নি কমিটি। এছাড়া পিপিআর-২০০৮ অনুযায়ী, একক উৎস্যভিত্তিক পরামর্শক নিয়োগে ফার্ম বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২০ লাখ বিল প্রদান করা যায়। কিন্তু উল্লেখিত তিনটি প্রতিষ্ঠানের দুটিকে ২০ লাখ টাকার বেশি করে বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
এ ছাড়া চলতি বছরের ১৯ মার্চ অনাবাসিক ভবনখাত থেকে স্পিডি গ্রুপকে পরিশোধ করা হয়েছে ১ কোটি ২২ লাখ ৬৭ হাজার ৮৯১ টাকা। এসব টেন্ডার ইজিপিতে করার কথা থাকলেও বিলে তা করা হয়নি। দুটি অখ্যাত বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় এ সংক্রান্ত দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রকল্প তহবিল থেকে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত আনোয়ার শিকদার ও মো: আনছার আলী নামে দুজন গাড়িচালকের নামে বেতন বিল উত্তোলন হচ্ছে। তবে বাস্তবে মো: আনছার আলী নামে কোনো চালকের অস্তিত্ব পায়নি কমিটি।
দুদকের অনুসন্ধান শুরু
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ পাওয়ার পর অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে দুদকের উপ-পরিচালক রতন কুমার দাশকে। তিনি প্রকল্পের সাত কর্মকর্তাকে ইতোমধ্যে দুদকে তলব করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তবে মূল অভিযুক্ত পিডি দেলোয়ারকে এখনো ডাকা হয়নি। এছাড়া যথাযথভাবে কাজ না করে বিল উত্তোলনকারী ঠিকাদারদেরও ডাকা হয়নি এখনো।
সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াও প্রকল্পের বেশ কিছু কাগজপত্র সংগ্রহ করেছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। এছাড়া পিডিসহ অন্য অভিযুক্তদের শিগগির ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলেও জানা গেছে।
দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়া কর্মকর্তারা হলেন, ডেপুটি নটিক্যাল সার্ভেয়ার (ডিএনএস) ক্যাপ্টেন ফরহাদ জলিল বিপ্লব, তিন সহকারী পরিচালক (এপিডি) পতিত পবন দাস, নাজমুল হোসাইন টিটো ও রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, জুনিয়র ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার মোবাশ্বের রহমান ফাহিম, সহকারী ইলেকট্রিশিয়ান সাইফুল ইসলাম ও উপ-প্রকল্প পরিচালক (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) ক্যাপ্টেন আবু হায়াৎ আশরাফুল আলম। এদের মধ্যে ফরহাদ জলিল বিপ্লব, পতিত পবন দাস ও সাইফুল ইসলাম পিডি দেলোয়ারের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। আর নাজমুল হোসাইন টিটোর বিরুদ্ধে প্রকল্পে চাকরি পাওয়ার পর বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে প্রকল্পের কয়েকজন কর্মকর্তা দুদকের চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। ক্যাপ্টেন আবু হায়াৎ আশরাফুল আলম বলেন, চিঠি পেয়ে নির্ধারিত তারিখেই হাজির হয়েছিলেন তিনি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। তিনি বলেন, যা সত্য, প্রকল্পে যেসব অনিয়ম হয়েছে, কেন হয়েছে- সব কিছু অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে বলে এসেছি।
চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করে নাজমুল হোসাইন টিটো বলেন, প্রকল্পের মূল অপরাধীরা বহালতবিয়তে রয়েছেন। আর আমাদের মতো নিরাপদ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। তবে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।


আরো সংবাদ



premium cement