২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

লাখ টাকায় কাঙালের ল্যাট্রিন

গ্রামীণ স্যানিটেশন প্রকল্প
-

উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনসহ বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন রয়েছে। সঠিকভাবে সমীক্ষা না করে প্রকল্পের খরচ প্রাক্কলন করা হয়। আবার সমীক্ষা থেকে যে ব্যয় প্রাক্কলন সুপারিশ করা হয় তার চেয়ে বেশি খরচ ধরে প্রকল্প প্রস্তাবনা দেয়া হচ্ছে। গ্রামীণ স্যানিটেশন প্রকল্পের খরচ নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের আপত্তি রয়েছে। দুর্গম এলাকায় হতদরিদ্রদের জন্য প্রতিটি ল্যাট্রিন নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে এক লাখ টাকা। যেখানে অন্য এলাকায় এই খরচ ধরা হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। এছাড়া জনসমাগম স্থানে দু’ধরনের টয়লেট নির্মাণের খরচের ব্যবধান ৯ লাখ টাকা। পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মো: মামুন-আল-রশীদ জানান, প্রকল্পটি পিইসি করে আমরা কিছু অবজারভেশন দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। যদি তারা সেসব পূর্ণ করে ডিপিপি পুনর্গঠন করতে পারে তাহলে আমরা একনেকের জন্য সুপারিশ করবো। অন্যথায় না। তিনি বলেন, খরচের সাথে একমত হতে না পেরেই আমরা প্রস্তাবনাটি ফেরত পাঠিয়েছি।
প্রকল্পের প্রেক্ষাপট থেকে জানা গেছে, ১৯৮০ ও ১৯৯০ এর দিকে স্যানিটেশন পরিস্থিতি বিশেষ করে গ্রামীণ স্যানিটেশন পরিস্থিতি ও কভারেজ ছিল খুবই শোচনীয়। স্যানিটেশন কভারেজ নিরূপণে ২০০৩ সালের অক্টোবরে একটি জাতীয় জরিপ করা হয়। সেখানে দেখা যায়, দেশের প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ পরিবারের মধ্যে মাত্র ৩৩ শতাংশ স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন ব্যবহার করে। ২৫ শতাংশ অস্বাস্থ্যকর ল্যাট্রিন ব্যবহার করে আর ৪২ শতাংশ উম্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করে। শতভাগ স্যানিটেশন কভারেজের জন্য পদক্ষেপ নিয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর জাতীয় স্যানিটেশন প্রকল্প তিনটি পর্যায়ে বাস্তবায়ন করে। প্রথম পর্যায় ২০০৪ সালের জুলাই থেকে ২০০৭ সালের জুন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়। এতে উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ কমে ৬ শতাংশে নেমে আসে। এরপর দ্বিতীয় পর্যায় ২০০৪ সালে থেকে ২০১৩ পর্যন্ত সময়ে বাস্তবায়ন করা হয়। প্রকল্প শেষে উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগের হার কমে ৪ শতাংশে নেমে আসে। এদিকে পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২১ সালে সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে স্যানিটেশন সুবিধা পাচ্ছে সাড়ে ৮১ শতাংশ এবং এখনো উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করে ১.৩ শতাংশ। সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে গ্রামীণ এলাকায় প্রায় ৮ লাখ হতদরিদ্র পরিবারের জন্য নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
স্থানীয় সরকার বিভাগের পক্ষ থেকে নতুন করে প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ স্যানিটেশনে ৮ লাখ ৬ হাজার ৫১৯টি ল্যাট্রিন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। দু’শ্রেণীর ৪ হাজার ৯২০টি পাবলিক টয়লেট নির্মাণসহ এই প্রকল্পে খরচ ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৭১৭ কোটি ৬৬ লাখ ৪২ হাজার টাকা। যার পুরো অর্থই দেয়া হবে সরকারের রাজস্ব খাত থেকে।
প্রকল্পের আওতায় কাজগুলো হলো, হতদরিদ্রদের জন্য ৭ লাখ ২৫ হাজার ৮৬৭টি উন্নত ল্যাট্রিন স্থাপন, দুর্গম ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় হতদরিদ্রদের জন্য ৮০ হাজার ৬৫২টি উন্নত ল্যাট্রিন স্থাপন, ২ হাজার ৪৬০টি এ-টাইপ পাবলিক টয়লেট স্থাপন এবং ২ হাজার ৪৬০টি বি-টাইপ পাবলিক টয়লেট স্থাপন। কমিউনিটি টয়লেট ও ল্যাট্রিন মেরামত, যানবাহন সরবরাহ ও সেবা এবং প্রশিক্ষণ।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, দুর্গম ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকার হতদরিদ্রদের জন্য ৮০ হাজার ৬৫২টি উন্নত ল্যাট্রিন স্থাপনে খরচ প্রাক্কলন করা হয়েছে ৮০৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এখানে প্রতিটি ল্যাট্রিন স্থাপনে খরচ পড়বে এক লাখ টাকা। কিন্তু সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় ওই বিভিন্ন প্রকার ল্যাট্রিনের ব্যয় প্রাক্কলন দেখানো আছে ৬৫ হাজার ৬৪ হাজার ৪৫ হাজার এবং ৪০ হাজার টাকা। সারা দেশে হতদরিদ্রদের জন্য ৭ লাখ ২৫ হাজার ৮৬৭টি উন্নত ল্যাট্রিন স্থাপনে খরচ প্রাক্কলন করা হয়েছে ২ হাজার ১৭৭ কোটি ৬০ লাখ ১০ হাজার টাকা। এখানে প্রতিটি ল্যাট্রিন স্থাপনে খরচ পড়বে ৩০ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, দু’হাজার ৪৬০টি এ-টাইপ পাবলিক টয়লেট স্থাপনে খরচ প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪১৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। এখানে প্রতিটির জন্য একক ব্যয় হবে ১৭ লাখ টাকা। কিন্তু সমীক্ষায় খরচ সুপারিশ করা হয়েছিল সাড়ে ১৬ লাখ টাকা। আর সমজাতীয় প্রকল্পে একই খাতে খরচ ধরা হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। আর দু’হাজার ৪৬০টি বি-টাইপ পাবলিক টয়লেট স্থাপনে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৯৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এখানে প্রতিটির নির্মাণ খরচ হচ্ছে ৮ লাখ টাকা। যেখানে সমজাতীয় প্রকল্পেই একক ধরা হয়েছে ৫ লাখ টাকা। এখানে ৩ লাখ টাকা বেশি ধরা হয়েছে প্রতিটির একক ব্যয়।
এছাড়া প্রকল্পে পাঁচ বছরে সরবরাহ ও সেবায় খরচ প্রাক্কলন করা হয়েছে ২১ কোটি ১১ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। এখানে প্রতি মাসে গড় খরচ হবে প্রায় ৩৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। এই খাতে খরচকে যুক্তিযুক্ত করার জন্য পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়েছে। চলমান সমজাতীয় প্রকল্পের তুলনায় এই খরচগুলো অনেক বেশি বলছেন ভৌত অবকাঠামো বিভাগের কর্মকর্তারা।
স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন জনসচেতনতা কার্যক্রম বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ কোটি ৩৯ লাখ ৪ হাজার টাকা। প্রতি মাসেই খরচ হবে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৪০০ টাকা। ডিপিপি অনুযায়ী এই খাতের বেশির ভাগ অর্থ ধরা হয়েছে স্যানিটেশন বিষয়ক বিভিন্ন দিবস উদযাপনে। তাই এই ধরনের ব্যয় সরকারের রাজস্ব বাজেট থেকে নির্বাহ করা যায় কিনা? প্রশ্ন পরিকল্পনা কমিশনের।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের পরিকল্পনা সার্কেল প্রকৌশলীদের সাথে প্রকল্পটির ব্যাপারে জানতে চাইলে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
প্রকল্পের ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মো: মামুন-আল-রশীদের সাথে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, শুধু ল্যাট্রিন না। এখানে আরো কিছু যেমন অজুখানা এমন আরো কিছু আছে। প্রতিটি খরচ আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করেছি।

 


আরো সংবাদ



premium cement