১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

করোনায় উন্নয়ন খরচ বৃদ্ধির আশঙ্কা

নিরাপত্তার কারণে দেশী-বিদেশী কর্মীরা ছুটিতে; মাঠপর্যায়ের কাজ ২৫ মার্চ থেকে বন্ধ
-

দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় যখন গতিশীলতা আসছিল ঠিক তখনই করোনাভাইরাসের মতো প্রাণঘাতী বৈশ্বিক দুর্যোগ থামিয়ে দিয়েছে সেসব কাজের গতিকে। সরকারি নির্দেশনার পর গত ২৫ মার্চ থেকে মাঠপর্যায়ের কাজ বন্ধ। ফলে নির্ধারিত মেয়াদে যেসব প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল, সেগুলো এখন আটকে গেল। সাধারণ ছুটি ও বিশ্বব্যাপাী লকডাউনের কারণে প্রকল্পের আমদানিকৃত মালামালগুলোও দেশে আসতে পারছে না। প্রকল্পের সাথে যুক্ত শ্রমিকরাও এখন ছুটতে। পাশাপাশি প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন খরচও বৃদ্ধি পাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রকল্প সংশোধনের এবং নতুন করে কিছু প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় পরিকল্পনা কমিশনে পড়ে আছে। অর্থনীতিবিদদের পর্যালোচনা হলো করোনভাইরাস কত দিন থাকবে সেটির ওপর দেশের সব কর্মকাণ্ড নির্ভর করছে। এটি আরো দীর্ঘস্থায়ী হলে তা দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও অর্থনীতিকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করে দেবে।
জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে সাধারণ ছুটি থাকায় অনেক প্রকল্পের মেয়াদ সংশোধন অনুমোদনও পাচ্ছে না। কিছু কিছু প্রকল্প মেয়াদ থেকে তিন থেকে ছয় মাস ইতোমধ্যে অতিক্রম করেছে। এসবের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভার জন্য অপেক্ষমাণ। এখন এসব সাধারণ ছুটির জালে আটকা পড়েছে। এসব প্রকল্পের একটি বড় সংখ্যককে আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) যুক্ত করতে হবে। রেলসহ বিদেশ থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে যেসব সামগ্রী বা মালামাল আনার কথা ছিল সেগুলোও এখন আটকে গেছে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের এবং সেতু বিভাগের মেগা প্রকল্পগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে প্রত্যাশিত পদ্মা বহুমুখী সেতুর কাজ। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৭৮ শতাংশ। তবে মূল সেতুর কাজ ৮৬ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের এখন পর্যন্ত মোট ১১ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে।
সাসেক সড়ক সংযোগ এন-৪ প্রকল্পের আওতাভুক্ত জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা চার লেন প্রকল্পটি এমনিতেই নির্ধারিত মেয়াদে শেষ হয়নি। ৬ বছর ১০ মাসে (গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) কাজ হয়েছে মাত্র ৭৫.৪৮ শতাংশ। টাকা খরচ হয়েছে ৬৮.৭৭ শতাংশ। এটি ২০১৮ সালের মার্চে শেষ করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে অনুমোদন নেয়া হয়েছিল।
এলেঙ্গা টু রংপুর সাসেকের আরেকটি সংযোগ সড়ক প্রকল্প আগামী ২০২১ সালের আগস্টে সমাপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন বছর আট মাসে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১৫ শতাংশ। এখন করোনার কারণে কাজ থমকে গেছে। ফলে ২০২১ সালের আগস্টে সমাপ্ত হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।
মেগা প্রকল্পের অন্যতম ঢাকা-খুলনা (এন-৮) মহাসড়কের যাত্রাবাড়ীর ইন্টারসেকশন থেকে মাওয়া পর্যন্ত এবং পাঁচ্চর-ভাঙ্গা অংশের ধীর গতির যানবাহনের জন্য চার লেন করার প্রকল্পটি চলতি বছর জুনে সমাপ্ত হওয়ার কথা। কাজও অনেক দূর এগিয়ে গেছে অর্থাৎ বাস্তব অগ্রগতি ৮৩ শতাংশ। ২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রকল্পটির মেয়াদ শুরু হয়।
ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইম্প্রুভমেন্ট প্রকল্প সাত বছরে সমাপ্ত হওয়ার কথা। চার বছর সাত মাসে প্রকল্পের গড় বাস্তব অগ্রগতি হলো প্রায় ৫৬ শতাংশ। যেখানে অর্থ ব্যয় হয়েছে ৪২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। পায়রা নদীর ওপর পায়রা সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১২ সালের এপ্রিলে মেয়াদ শুরু হয়। আগামী ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পটি সমাপ্ত করার কথা। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাজের আর্ধিক অগ্রগতি মাত্র ৫১ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
অন্য দিকে মেট্রোরেল-৬ এর প্রকল্প কাজ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি সাত বছর আট মাসে ৪১ দশমিক ২৬ শতাংশ। আগামী ২০২৪ সালের জুনে এ প্রকল্পটি সমাপ্ত করার কথা। এ ছাড়া গাজীপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পটি সময় বাড়িয়ে চলতি বছর জুনে সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি অনেক পিছিয়ে। কোনো কোনো খাতের কাজ শতভাগ শেষে হয়েছে। আবার কোনো কোনোটি শুরুই করা হয়নি।
পদ্মায় রেল সংযোগের অগ্রগতি ব্যাপারে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি) বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তার চেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে ধীর গতিতে জমি অধিগ্রহণ ও এ-সংক্রান্ত জটিলতা মীমাংসার কারণে।
আর পদ্মা সেতুর প্রকৌশলীরা জানান, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে পদ্মা সেতুর (মূল সেতু) কাজে নিয়োজিত প্রায় ৭০ ভাগ কর্মী এখন আর কাজে আসতে পারছেন না। প্রায় সাড়ে চার হাজার কর্মীর মধ্যে তিন হাজার কর্মী কাজে আসতে পারছেন না বলে জানা গেছে। তবে তাতে স্প্যান বসাতে কোনো সমস্যা নেই বলে জানিয়েছেন পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী। তার মতে, যদি করোনা পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থার উন্নতি না হয় তা হলে কাজ থেমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
সাসেক রোড কানেক্টিভিটি প্রকল্প এন-৪ এর প্রকল্প পরিচালক এম ইসহাকের সাথে ফোনে প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাওয়া হলে তিনি গতকাল জানান, কাজ ভালোই আগাচ্ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের প্রভাবে এখন প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে। তিনি জানান, মালামাল সবই আছে। নেই শ্রমিকরা। গত ২৫ মার্চে থেকে কাজ বন্ধ। এ ছাড়া নির্মাণ কাজের সাথে দু’টি কোম্পানি জড়িত। এখানে কোরিয়ানরা কাজ করছে। তারা দেশে আছে কি না সেটাও যোগাযোগ নেই।
সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প (এন-২) (এলেঙ্গা টু রংপুর) প্রকল্প পরিচালক কাজী শাহরিয়ার হোসেনের সাথে অগ্রগতি সম্পর্কে ফোনে আলাপকালে তিনি জানান, নির্ধারিত মেয়াদেই প্রকল্পটি সমাপ্ত হবে আশা করছি। কিন্তু এখন এই করোনার কারণে প্রকল্পের কাজ থমকে গেছে। গত ২৫ মার্চ থেকে মাঠপর্যায়ের কাজ বন্ধ রয়েছে। শ্রমিকদের কিছু কিছু ছুটিতে। এ ছাড়া সরকারিভাবে অনেক লোকের জমায়েত নিষেধ এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য বলা হয়েছে। ফলে মাঠপর্যায়ে কাজ আপাতত বন্ধ। অফিসিয়াল কাজ চলছে। তিনি জানান, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হলো ১৫ শতাংশ। এখানে তিনটি কোম্পানি কাজ করছে যারা চায়নিজ। তাদের কিছু কর্মী হয়তো নেই।
২০২০ সালের জুনে প্রকল্পটি সমাপ্ত করার কথা ছিল, তবে মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, এখন পরিস্থিতি যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে সময় বাড়ানো ছাড়া বিকল্প কোনো চিন্তা করার সুযোগ নেই।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন সম্প্রতি এক অভিমতে জানান, চীন বর্তমানে বাংলাদেশের পরিবহন ও জ্বালানি খাতসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। চীনা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের কারণে এগুলোর কার্যক্রম অনেকটা মন্থর হয়ে গেছে। নির্মাণসামগ্রীর সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে নিযুক্ত অনেক চীনা শ্রমিক তাদের দেশে আটকা পড়েছেন। ফলে প্রকল্পগুলো শেষ হতে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে বাংলাদেশ সরকারের আরো অর্থ নেয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। যার অর্থ হচ্ছে আরো ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পাওয়া।


আরো সংবাদ



premium cement