প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষা করে একটি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ‘সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়া’র (ডিপিএম) মাধ্যমে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য ২৬ হাজার ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও স্পিকার ক্রয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়া ডিপিএম প্রক্রিয়ায় নি¤œমানের ওই সব শিক্ষা উপকরণ ক্রয় করা হলে প্রকল্পের প্রায় ৮৭০ কোটি টাকা অপচয় হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী এসব শিক্ষা উপকরণ ক্রয়ের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) উন্মুক্ত ক্রয় প্রক্রিয়ার (ওটিএম) কার্যক্রম শুরু করলেও অজ্ঞাত কারণে তা বাতিল করা হয়েছে। এখন একটি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ওই সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়া চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের প্রতি উপজেলায় একটি করে মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়াভিত্তিক ক্লাসরুম পরিচালিত হচ্ছে। এর আলোকেই একসাথে দেশের বিদ্যমান সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অর্থাৎ ৬০ হাজারের বেশি বিদ্যালয়ে ই-লার্নিং ম্যাটেরিয়ালভিত্তিক ক্লাসরুম পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প ৪-এর আওতায় এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ‘কম্পিউটার অ্যান্ড এক্সেসরিজ স্কুল’ কর্মসূচির অধীনে সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিতরণের জন্য কম্পিউটার, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও সাউন্ড সিস্টেম ক্রয় করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল, যেসব বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎসংযোগ ও আইসিটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক রয়েছে সেসব বিদ্যালয়কে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ওই সব বিদ্যালয়ের জন্য এই মুহূর্তে ২৬ হাজার ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও স্পিকার ক্রয়ের জন্য গত ৭ মার্চ উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। আগের ক্রয়প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসমূহের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও এবার তাদের প্রতিনিধি ছাড়াই গত ২৪ মার্চ প্রিটেন্ডারিং সভা সম্পন্ন হয়। কিন্তু পরে ১৯ এপ্রিল ওই টেন্ডার প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। এখন দরপত্র ছাড়া অর্থাৎ সরাসরি ‘দেশীয় উৎপাদিত পণ্য’ কেনার চেষ্টা চলছে। প্রকল্পের প্রতিটি ল্যাপটপের প্রাক্কলিত মূল্য ধরা হয়েছে ৫৩ হাজার টাকা।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বুয়েটের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই ডিপিএম প্রক্রিয়ায় টেশিসের মাধ্যমে চীন থেকে নি¤œমানের পণ্য আমদানির চেষ্টা হচ্ছে। এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো: জাকির হোসেন জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে দেশের সব বিদ্যালয়ের ক্লাসরুম ডিজিটালাইজ করা হবে। এ জন্য ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও স্পিকার কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। মান যাচাই-বাছাই করেই উপকরণগুলো কেনা হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম-আল হোসেন বলেন, সরাসরি শিক্ষা উপকরণ কেনার জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে মতামত চেয়ে চিঠি দিয়েছিলাম। তারা সরকারি স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও স্পিকার সরবরাহ করতে পারবে বলে মতামত দিয়েছে। এখন সরকার ডিপিএম করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
তবে মন্ত্রণালয়ের সরাসরি পণ্য ক্রয়ের তৎপরতা নিয়ে ক্ষুব্ধ সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও ইতঃপূর্বে ওই প্রকল্পে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ডিপিইর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত রয়েছেÑ কেনাকাটায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ওটিএম (ওপেন টেন্ডার মেথড) অনুসরণ করার। কিন্তু এই প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে প্রায় দেউলিয়া হতে যাওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ‘টেলিফোন শিল্প সংস্থা’র (টেশিস) মাধ্যমে নি¤œমানের পণ্য কেনার চেষ্টা করলে সেখানে দুর্নীতির অভিযোগ আসতে পারে। টেশিসের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক প্রকল্প আইসিটি ফেইজ-১’ এর অধীনে কেনা প্রায় ২৪ হাজার আইসিটি শিক্ষা উপকরণের অধিকাংশই অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এ ক্ষেত্রেও তেমনটি হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী একটি সংস্থার প্রতিনিধি বলেন, ইতঃপূর্বে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় পিইডিপি-২ ও পিইডিপি-৩ সফলভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। সে সময়ে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ও বিশ্বখ্যাত ব্রান্ডের কোম্পানিগুলো ৫৭ হাজার ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর সরবরাহ করেছে। এর পর থেকে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর তত্ত্বাবধানে কোম্পানিগুলোর দেশীয় এজেন্টরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্রয়োত্তর সেবা দিচ্ছে। এই অবস্থায় তাদেরকে বাদ দিয়ে দেশীয় সংস্থার কাছ থেকে শিক্ষা উপকরণ নেয়া হলে তা মানসম্মত হবে না। আবার তারা বিক্রয়োত্তর সেবা দিতেও ব্যর্থ হবে। ফলে প্রকল্পের আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
প্রসঙ্গত, সরকার সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি) গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আর্থিক সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে পিইডিপি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সংস্থাগুলো হচ্ছেÑ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইন্টারন্যশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ), ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি), ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ), অস্ট্রেলিয়ান ডিপার্টমেন্ট ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ট্রেড (ডিএফএটি অস-এআইডি), সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি (সিড), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা), ইউনিসেফ, গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশন (জিপিই) ডিপার্টমেন্ট অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স এবং ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ডিএফএটিডি)।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা