২১ মে ২০২৪, ০৭ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলকদ ১৪৪৫
`


ষোড়শ শতকের স্থাপনা গুরুদুয়ারা নানকশাহী অনন্য স্থাপত্য

-

ঢাকার গুরুদুয়ারা নানকশাহী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে অবস্থিত শিখ ধর্মের একটি উপাসনালয়। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে কলাভবনের পাশে অবস্থিত। এ গুরুদুয়ারাটি বাংলাদেশে অবস্থিত ৯ থেকে ১০টি গুরুদুয়ারার মধ্যে বৃহত্তম।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, ঢাকার এই গুরুদুয়ারাটি যেখানে অবস্থিত, সেই স্থানে ষোড়শ শতকে শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক স্বল্পসময়ের জন্য অবস্থান করেছিলেন। যেখানে অবস্থানকালে তিনি শিখ ধর্মের একেশ্বরবাদ ও ভ্রাতৃত্ববোধের কথা প্রচার করেন এবং ধর্মের আচার অনুষ্ঠান পালনের শিক্ষা প্রদান করেন।
শিখ ধর্মের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ সিংয়ের সময়কালে (১৫৯৫-১৬৪৪ খ্রি:) ভাইনাথ (মতান্তরে আলমাস্ত) নামের জনৈক শিখ ধর্ম প্রচারক এই স্থানে আগমন করে গুরুদুয়ারাটি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। কারো কারো মতে, গুরুদুয়ারাটি নির্মাণের কাজ শুরু হয় নবম শিখ গুরু তেগ বাহাদুর সিংয়ের সময়কালে (১৬২১-১৬৭৫ খ্রি:)। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। পরে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি ভগ্নদশা প্রাপ্ত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ১৯৭২ সালে গুরুদুয়ারাটির ভবনের কিছু সংস্কার করা হয়। ১৯৮৮-৮৯ সালে এটির ব্যাপক সংস্কার সাধন করা হয় এবং বাইরের বারান্দা ও সংলগ্ন স্থাপনা যোগ করা হয়। সংস্কার কার্যের অর্থায়ন করা হয় বাংলাদেশে ও বিদেশে অবস্থানরত শিখ ধর্মাবলম্বীদের অনুদানের মাধ্যমে। ঢাকার আন্তর্জাতিক পাট সংস্থার তদানিন্তন প্রধান সর্দার হরবংশ সিংয়ের নির্মাণকাজ তদারক করেন।
একসময় গুরুদুয়ারা নানকশাহীর বিপুল পরিমাণ ভূসম্পত্তি ছিল। আজকের মতো বিরাট ও জমকালো উপাসনালয় না থাকলেও তখন গুরুদুয়ারা নানকশাহীর আয়তন ছিল বিপুল। এর উত্তর দিকে ছিল একটি প্রবেশদ্বার। দক্ষিণদিকে ছিল কূপ ও সমাধিস্থল এবং পশ্চিমে ছিল একটি শান বাঁধানো পুকুর। মূল উপাসনালয় ছাড়াও ভক্তদের থাকার জন্য ছিল কয়েকটি কক্ষ। তবে সেসবের তেমন কিছু এখন আর অবশিষ্ট নেই। বর্তমান উপাসনালয়টি সীমিত জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে এবং বারবার সংস্কারের পর বর্তমান রূপ ধারণ করেছে।
উঁচু প্রাচীরবেষ্টিত গুরুদুয়ারা নানকশাহীর বর্তমান প্রবেশপথটি রয়েছে দক্ষিণ দিকে। উপাসনালয়টির সামনে রয়েছে চমৎকার সবুজ লন। এর বাম দিকে আছে শিখ রিসার্চ সেন্টার, ডান দিকে দোতলা দরবার হল, সামনে পতাকা স্ট্যান্ড। বৈশিষ্ট্যময় এই উপাসনালয়টি শিখদের নিজস্ব স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। উপাসনালয়টির ওপর পৃথিবী আকৃতির একটি কাঠামো নির্মিত। তার চার দিকে শিখ ধর্মীয় চিহ্ন খাণ্ডা শোভিত। উপাসনালয়ের শীর্ষে রয়েছে ছাত্রার। এটি শিখদের উপাসনালয়ের চিহ্ন। গুরুদুয়ারা নানকশাহীর ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটি বড় কক্ষ। এই কক্ষের চার দিকে চারটি দরজা আছে। মাঝখানে কাঠের তৈরি বেদির ওপর রয়েছে শিখ ধর্মগ্রন্থ ‘গ্রন্থসাহেব’। এটাকে বলা হয় শ্রী দরবার সাহিব। বেদির সামনে নবম শিখগুরু তেগ বাহাদুর সিংয়ের ব্যবহৃত একজোড়া খড়ম একটি কাচের বাক্সের মধ্যে যতœসহকারে রাখা আছে। এ কক্ষের মেঝেতে লাল রঙের কার্পেট পাতা আছে। তাতে ভক্তরা বসে গ্রন্থসাহেব পাঠ শোনেন। কক্ষের চার দিকে বারান্দা আছে।
গুরুদুয়ারা নানকশাহীতে বর্তমানে ভাই আজাদবিন্দার সিং প্রধান গ্রন্থির দায়িত্ব পালন করছেন।
গুরু নানকশাহীতে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা দুবার গ্রন্থসাহেব পাঠ ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। তা ছাড়া প্রতি শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত সাপ্তাহিক জমায়েত ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। পুরোহিত গ্রন্থসাহেব পাঠ ও কীর্তন করেন। সঙ্গীতশিল্পী কিরণচন্দ্র রায় এই গুরুদুয়ারার অতিথি নিবাসে থেকে দীর্ঘ দিন এখানে কীর্তন পরিবেশন করেন। কীর্তন ও প্রার্থনা শেষে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। এখানে শুক্রবারে আগত অতিথিদের জন্য মধ্যাহ্নভোজেরও ব্যবস্থা আছে। গুরুদুয়ারায় আয়োজিত বার্ষিক অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে গুরু নানকের জন্মবার্ষিকী, দশম গুরু গোবিন্দ সিং এর জন্মবার্ষিকী, খালসা সাজনা দিবস, নগর কীর্তন, লোহরী এবং পয়লা বৈশাখ। অনুষ্ঠানগুলো এখানে অত্যন্ত ধুমধামের সাথে পালন করা হয়।
গুরুদুয়ারায় কারো প্রবেশে বাধা নেই, জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব বয়সী নারী ও পুরুষ এখানে প্রবেশ, প্রার্থনায় অংশগ্রহণ এবং প্রসাদ পেতে পারেন। ঢাকায় বসবাসরত শিখ সম্প্রদায়ের লোকজন নিয়মিত এ গুরুদুয়ারায় আসেন। তা ছাড়া অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনকেও শুক্রবার এই উপাসনালয়ে আসতে দেখা যায়। স্থানীয় ভক্ত ও বিদেশী দাতাদের সাহায্যে প্রতিষ্ঠানটির ব্যয় নির্বাহ হয়।


আরো সংবাদ



premium cement