১৮ মে ২০২৪, ০৪ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলকদ ১৪৪৫
`


‘আমরা একটু বাঁচতে চাই’

আতঙ্কে রাত কাটছে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারটির - ছবি : নয়া দিগন্ত

রাতে ঠিক মতো একটু ঘুমাতে পারি না, কে বা কারা দরজায় লাথি মারে, জালানাসহ মূলগেট টানা-টানি করে, ঘরের চালায় ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে, সব সময়ই আতঙ্কে থাকি। বাবা মারা যাওয়ার পর এভাবেই প্রতিটি দিন কাটছে আমাদের। কত দিন আর মুখ বুঝে এতো অত্যাচার সহ্য করবো। আমরা একটু বাঁচতে চাই ভাই? কারো অভিভাবক হারিয়ে গেলে আপন মানুষ সহ চেনা মুখগুলো যে মুহূর্তেই পর হয়ে যায় তা আগে কখনো জানা ছিল না। প্রায় দুই বছর আগে আব্বু মারা যান। তারপর থেকে আমাদের জমিজমা লুটে পুটে খাওয়ার জন্য আপন চাচারাই এখন আমাদের শত্রু হয়ে দাড়িয়েছে। রাত পোহালে আমরা কোথায় যাই, কী করি, আমাদের পিছনে সর্বদা ছায়ার মতো লেগে থাকেন তারা। কারণে অকারণে গায়ে পড়ে সঙ্ঘাত সৃষ্টি করতে চান। এখন যে কোনোভাবে মাসহ আমাকে মেরে ফেলতে পারলেই তাদের সব চাওয়া পাওয়া পূর্ণ হয়। শুনেছি বাবার শূন্যতা নাকি চাচারাই পূরন করেন। কিন্তু আমাদের বেলায় সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন আমরা যেন তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাড়িয়েছি। আর কতো নির্যাতনের শিকার হবো আমরা। বেঁচে থাকার কোনো অধিকার কি আমাদের নাই?

চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ নিয়ে অসহায়ত্বের কথাগুলো জানালেন বাগেরহাটের শরনখোলা উপজেলার ধানসাগর ইউনিয়নের নলবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবির) ৩২ ব্যাটারলিয়ানের (অবসরপ্রাপ্ত) ল্যান্স নায়েক মোঃ-গোলাম সরোয়ার বাবুল সর্দারের বড় মেয়ে সাদিয়া সুলতানা সাথী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার নলবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা মৃত আব্দুল আজিজ সর্দারের বড় ছেলে মুক্তিযোদ্ধা মোঃ গোলাম সরোয়ার বাবুল ২০০৭ সালে চাকরি হতে অবসরে আসেন। পরে ২০১৪ সালে তার বাবার সম্পত্তি ভাগ ভাটোয়ারা নিয়ে ভাইদের সাথে বিরোধ সৃষ্টি হয়। ওই সময় কয়েক ভাই মিলে বাবুলকে শারিরীকভাবে লাঞ্চিত করেন। পরে তিনি ৩নং নলবুনিয়া মৌজার ৩৬৪ নং খতিয়ান থেকে তার ভোগ দখলীয় আট শতক জমি ওই এলাকার সাধারন মানুষের স্বাস্থ্য সেবার জন্য দান করলে সেখানে ২০১৪ সালে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেন তৎকালীন সরকার। পরবর্তীতে নলবুনিয়া আব্দুল আজিজ সর্দার বাড়ীর ওই কমিউনিটি ক্লিনিকে ২০১৫ সালে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার পদে তার বড় মেয়ে সাদিয়া সুলতানা সাথীর চাকরি হয়। এরপর থেকেই ভাইদের সাথে দা-কুমড়া সম্পর্কের সৃষ্টি হয় অবসরপ্রাপ্ত ওই বিজিবি কর্মকর্তার। তারপর হতে মুক্তিযোদ্ধা বাবুলের কন্যা সাদিয়াকে ক্লিনিক থেকে তাড়াতে নানা প্রকার ষড়যন্ত্র শুরু করেন বাবুলের আপন ছোট ভাই মোঃ ছগির সর্দার, মোঃ কবির সর্দার, মোঃ কামরুল ইসলাম বাদল সর্দার, মোঃ সবুর সর্দার, বোন মোসাঃ শিল্পী বেগম ও চাচাতো ভাই আব্দুস ছাত্তার সর্দার সহ স্থানীয় একটি কুচক্রী মহল। ওই চক্রের মুল হোতা আব্দুস ছাত্তার সর্দারের ইন্ধনে গত পাঁচ বছরে সাদিয়ার বিরুদ্ধে বহু কাল্পনিক অভিযোগ স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন মহলে দায়ের করে তাকে হয়রানি করার পাশাপাশি ক্লিনিকে হামলা পর্যন্ত চালিয়েছেন ছগির সর্দার। এমনকি জোরপূর্বক ক্লিনিকের অভ্যন্তরের একটি মূল্যবান কড়াই গাছ কর্তন করে তা আত্মসাত করেন ছগির সর্দার। স্ত্রীসহ চারজন সন্তান রেখে মুক্তিযোদ্ধা বাবুল ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর হঠাৎ করে মারা যান। কিছুদিন পর থেকে তার ছেলে-মেয়েদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেন বাবুলের ভাইয়েরা। আর এসবের কলকাঠি পিছন থেকে নাড়ছেন বাবুলের প্রতিবেশি ও চাচাত ভাই আব্দুস ছাত্তার সর্দার।

এক পর্যায়ে নির্যাতন সহ সম্পত্তি বিরোধ নিস্পত্তির জন্য চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে শরনখোলা থানা পুলিশের কাছে মুক্তিযোদ্ধা বাবুলে স্ত্রী মমতাজ বেগম একটি অভিযোগ করেও কোনো সু-ফল পাননি । উল্টো প্রতিপক্ষরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে চলতি বছরের মার্চ মাসে ক্লিনিক সংলগ্ন এলাকায় ওই পরিবারের ভোগ দখলীয় সম্পত্তির মাটি খননে বাঁধা দেয় এবং মমতাজ বেগম সহ তার অধীনস্থ শ্রমিকদেরকে মারধর করে তাড়িয়ে দেয় ছগির ও সবুর সর্দার সহ প্রতিপক্ষরা।

সিভিল সার্জনের কাছে দেয়া অভিযোগে স্বাক্ষর করা ওই এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ছত্তার সর্দার ও ছগির সর্দার আমাদের সরকারি প্রণোদনা পাইয়ে দেয়ার কথা বলে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছে। পরবর্তীতে তারা কী করেছে তা আমরা জানি না।

তাছাড়া এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস ছালাম হাওলাদার, সংরক্ষিত আসনের মহিলা ইউপি সদস্য মিসেস দুলিয়া লোকমান, সুলতান সর্দার, নবী হোসেন সর্দার, আব্দুল লতিফ হাওলাদার ও আঃ জব্বার ফরাজী সহ অনেকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা বাবুল সর্দারের সাথে দীর্ঘদিন ধরে তার ভাইদের জমিজমা নিয়ে বিরোধ ছিল। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার পর তার জানাজা নামাজের অনুষ্ঠানে আব্দুস ছাত্তার সর্দার সহ অন্যরা লাশের খাটিয়া ধরে গ্রামবাসীদের সামনে ঘোষণা দিয়েছিলেন মৃত বাবুলের পরিবারের উপর তারা আর কোনো দিন অত্যাচার করবে না। কিন্তু অল্প দিনের ব্যাবধানে ওই পরিবারের উপর আবার যে নির্যাতন শুরু করে তারা সে দিনের শপথ ভঙ্গ করেছেন।

এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ মঈনুল হোসেন টিপু বলেন, সম্পত্তি নিয়ে উভয়গ্রুপের মধ্যে সমস্যা আছে। আমি কয়েকবার মিমাংসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। এছাড়া একদিন ওই ক্লিনিকে গিয়ে আমি বন্ধ পেয়েছি। তবে সেদিন নাকি ছুটির দিন ছিল।

এছাড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার এম এ খালেক খান বলেন, সহকর্মী বাবুল মারা যাওয়ার পর সম্পত্তি বিরোধের বিষয়টি একবার নিস্পত্তি করা হয়েছে। বর্তমান বিষয়ে আমার জানা নাই।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ ফরিদা ইয়াসমিন জানান, অভিযোগের বিষয়টি আমিও খোঁজ খবর নিয়েছি। ওই ক্লিনিকে কোনো ধরনের অনিয়ম পাওয়া যায়নি। অভিযোগের বাদি সাদিয়ার চাচা ছগির ও সবুর সর্দারদের সাথে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ থাকায় বার বার তারা সাদিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিচ্ছেন।

তবে আব্দুস ছাত্তার সর্দার বলেন, ওই পরিবারের সাথে আমার কোনো দ্বন্দ নেই। আমার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করে থাকলে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

অন্যদিকে ছগির সর্দারসহ অন্যরা বলেন, আমরা তাদের কোনো হয়রানি করছি না। জমি নিয়ে সমস্যার ইতোমধ্যে সমাধান হয়েছে। তবে স্থানীয়রা ক্লিনিকে সেবা বঞ্চিত হওয়ায় আমরা একটি অভিযোগ দিয়েছি। যাতে তাকে এখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হয়।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল