২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মাইগ্রেনে আক্রান্তরা রোজা রাখতে কী করবেন

- ছবি - বিবিসি

মাইগ্রেনের মাথাব্যথার কারণে ঘরের নীরব আর অন্ধকার কোণায় গিয়ে আশ্রয় খোঁজেননি- এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। এই ব্যথা তীব্রতর হলে বমিও করেন অনেকে। সাথে বাড়তি পাওনা থাকে হতাশা আর মুড সুইং। এ কারণেই যারা মাইগ্রেনে ভোগেন তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে অনেক পরিবর্তন আনেন, খাবার-দাবাড়ের অভ্যাসে পরিবর্তন আনেন, যাতে করে মাইগ্রেন নিয়ে বসবাস কিছুটা সহজ হয়।

অনেকেই নিয়ম করে সকালের নাস্তা করেন কিংবা অনেকেই আবার কফি পানের অভ্যাস গড়ে তোলেন। আবার অনেকেই নিয়মিত ওষুধ খেয়ে থাকেন। তাই রমজান এলে অনেকেই কিছুটা চিন্তায় পড়ে যান যে পরিবর্তিত রুটিনের সাথে কিভাবে তাল মিলিয়ে চলবেন।

নিউরোসার্জন ডা. আহমেদ আল-তামিমি বিবিসি উর্দুকে বলেছেন, ‘রমজানের সময় মাইগ্রেনের ব্যথা বেড়ে যাওয়া বা এতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাও বেড়ে যায়। এ কারণে এ সময় রোগীদের খাবার দাবার এবং জীবনযাত্রা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে যাতে করে ব্যথা সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়।'’

অন্যদিকে পুষ্টিবিদ ফাতিন আল নাশাশ বলেছেন, ‘রমজান শুরু হওয়ার আগে থেকেই যদি কিছু প্রস্তুতি নেয়া যায় তাহলে রোজার সময় মাইগ্রেনের ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।’

মাইগ্রেন কী?
ডা. আল-তামিমি বলেন, ‘মাইগ্রেন হচ্ছে ক্রনিক নিউরোলোজিক্যাল ডিসঅর্ডার বা দীর্ঘমেয়াদি স্নায়ুবিক রোগ। সাধারণত মাথার এক পাশে নিয়মিত মাঝারি বা তীব্র ব্যথা অনুভূত হয় এবং এটি সাধারণ মাথাব্যথা থেকে পুরোপুরিই আলাদা।

এই ব্যথা একবারে টানা দুই থেকে তিন দিন ধরে চলতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মাইগ্রেনের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যায়নি। তবে বিশ্বের প্রতি সাতজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন মাইগ্রেনে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।

সংস্থাটির ২০১৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে মাইগ্রেনে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি থাকে। এই হার পুরুষের তুলনায় অন্তত তিনগুণ বেশি। কারণ নারীদের হরমোনজনিত পরিবর্তনের কারণে মাইগ্রেনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। বমি বমি ভাব কিংবা বমি, হালকা মাথাব্যথা এবং উচ্চ শব্দ নিতে না পারার মতো ছোট-খাট উপসর্গ দেখা দেয়া থেকে শুরু হয়ে পরে এটি তীব্রতর ব্যথায় রূপ নেয়।

ডা. আল-তামিমি বলেন, ‘মাইগ্রেন অ্যাটাকের পর রোগীর কোনো কাজে মনোযোগ দেয়াটা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। তার মেজাজের ওপরও ব্যাপক প্রভাব পড়ে। যার কারণে তার দৈনন্দিন কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। মাইগ্রেনের অ্যাটাকের সময় বা এর পরে মাথাব্যথার লক্ষণ ছাড়াও হতাশা, কোনে কাজ মনোযোগ দিতে না পারা এবং কথা বলতে সমস্যা হওয়ার মতো উপসর্গও থাকতে পারে। এগুলো সাময়িক বা দীর্ঘমেয়াদি- দুই রকমেরই হতে পারে।’

চিকিৎসকদের মতে, মাইগ্রেনের এখনো স্থায়ী কোনো চিকিৎসা নেই। অর্থাৎ কোনো ওষুধ দিয়ে মাইগ্রেন চিরতরে সারিয়ে তোলা সম্ভব নয়। কিন্তু রোগীর উপসর্গ ভেদে কিছু ওষুধ সেবনের মাধ্যমে কিছু উপসর্গ কমিয়ে আনা যায়। যেমন- ব্যথার তীব্রতা এবং এতে আক্রান্ত হওয়ার হার কমে যায়।

রমজানে কিভাবে রোগীরা আক্রান্ত হতে পারেন?
অনেকেই এটা ভেবে চিন্তিত থাকেন যে রোজার সময় যেকেনো মুহূর্তে মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হয়ে যেতে পারে এবং শুরু হলেও ওষুধ খেতে পারবেন না। আর এ কারণে ব্যথার তীব্রতা আরো বেশি বাড়তে পারে। ফলে তারা মাইগ্রেন অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে থাকেন।

নিউরো সার্জন ডা. আহমেদ আল-তামিমি বিবিসি উর্দুকে বলেন, ‘রমজানের সময় মাথাব্যথা হতে পারে দেহে পানি বা তরলের অনুপস্থিতির কারণে। রক্তে গ্লুকোজ ও ক্যাফেইনের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে রক্তচাপও কমে যেতে পারে। আর এ কারণে দেখা দিতে পারে মাথাব্যথা।’

চিকিৎসকরা বলেন, সেহরিতে যদি ওষুধ খাওয়া যায়, ইফতারের পর প্রচুর পরিমাণে তরল পান করা হয় তাহলে তা বিকল্প হতে পারে। একইসাথে বেশি রাত না জেগে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাতে হবে।’

একজন মাইগ্রেন আক্রান্ত রোগীর জন্য সকালে উঠে কিছু না খাওয়াটাও ক্ষতিকর হতে পারে।

পুষ্টিবিদ ফাতিন আল নাশাশ বিবিসি উর্দুকে বলেন, ‘সকালের এই খাবার শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ ধরে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর কারণে মাইগ্রেন অ্যাটাক হওয়ার আশঙ্কা নেই। এটি রোধ করতে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়াটা জরুরি।’

আল-নাশাশ বলেন, ‘রমজানের শুরুর কয়েকটা দিন মাইগ্রেন আক্রান্তদের জন্য কিছুটা কষ্টকর হয় খাবার-দাবার ও জীবনযাপনে হঠাৎ করে পরিবর্তন আসার কারণে।’

মাইগ্রেন আক্রান্তরা কিভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
মাইগ্রেন আক্রান্তদের জন্য রমজান শুরুর আগে কিভাবে প্রস্তুতি নেয়া যেতে পারে সে বিষয়ে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন পুষ্টিবিদ আল-নাশাশ।

তিনি বলেন, ‘কফি এবং এ ধরনের উদ্দীপক খাবার ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে। যাতে করে রমজানের সময় দেহে এদের উপস্থিতি কমে গেলেও সমস্যা না হয়।’

এর জন্য কফি পান করা কমিয়ে আনা যেতে পারে। রমজান শুরুর আগে থেকে দিনে প্রধান খাবারের মাঝামাঝি সময়ে ছোটখাট কোনো খাবার বা নাস্তা না করা থেকে বিরত থাকতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করতে হবে যাতে দেহে পানিশূন্যতা তৈরি না হয়। একইসাথে রমজানের সাথে মানিয়ে নিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানোটাও দরকারি।

ঋতুস্রাবের সময় নারীদের প্রচুর পরিমাণ ম্যাগনেসিয়ামযুক্ত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এতে করে রক্তবাহী শিরা-উপশিরা শিথিল থাকে। একইসাথে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি এবং স্বাস্থ্যকর ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত মাছ খাওয়া যেতে পারে।

যদি কেউ মনে করে যে তার মাথাব্যথা হতে পারে, তাহলে যেসব খাবার খেলে তার মাথাব্যথা হয়, সেহরি ও সকালের নাস্তায় সেসব খাবার এগিয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। যেমন চকলেট, পনিরসহ দুগ্ধজাতীয় খাবার ইত্যাদি।

এর পরিবর্তে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে রুটি, শিম, ছোলা, ওটস ও যব দিয়ে বানানো রুটি, আঁশ সমৃদ্ধ খাবার, খেজুর, কলা এবং পটাসিয়াম রয়েছে এমন সব শাক-সবজি।

মাইগ্রেন বিষয়ক যুক্তরাজ্য ভিত্তিক দাতব্য সংস্থা দ্য মাইগ্রেন ট্রাস্ট এর তথ্য অনুযায়ী, কারো যদি মাইগ্রেন থাকে এবং এরপরও যদি তিনি রোজা রাখার প্রস্তুতি নিতে চান তাহলে তাকে যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে তা হচ্ছে-

১. ওষুধ
ওষুধ খেলে রোজা ভেঙে যাবে। এ কারণে রোজা শুরুর আগেই চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে। তাহলে তিনি আপনাকে নির্দেশনা দিতে পারবে যে আপনি চিকিৎসা নিচ্ছেন তার আওতায় আপনি রোজা রাখতে পারবেন কি না। আর রাখলেও আপনি কখন ওষুধ খাবেন। এক্ষেত্রে সেহেরির সময় ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হতে পারে।

তবে সেটিও রমজানের কমপক্ষে একমাস আগে থেকে শুরু করতে হবে যাতে শরীর এর সাথে মানিয়ে নেয়ার পর্যাপ্ত সময় পায়।

ওষুধ খাওয়ার পরিবর্তে মাইগ্রেনের আরো অনেক ধরনের ওষুধ রয়েছে। সেগুলোও আপনাকে দেয়া হতে পারে। তবে এসবের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

২. ক্যাফেইন
যারা নিয়মিত ক্যাফেইন গ্রহণ করে থাকেন তাদের মনে হতে পারে যে হঠাৎ করে ক্যাফেইন নেয়া বন্ধ করে দিলে হয়তো মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হতে পারে।

আপনি যদি প্রচুর পরিমাণে কফি, চা বা কোকাকোলা খেলে অভ্যস্ত হয়ে থাকেন তাহলে রমজানের সময় তা বন্ধ করে দিলে মাইগ্রেনের মাথাব্যথা আরো খারাপ হতে পারে। এর জন্য বিকল্প হচ্ছে, রমজান শুরুর আগে থেকেই ধীরে ধীরে ক্যাফেইন গ্রহণ বন্ধ করে দিতে হবে।

ধীরে ধীরে কমানোর ফলে এটি মাইগ্রেনের তীব্র ব্যথা হওয়ার আশঙ্কা কমিয়ে আনবে। এতেও কাজ না হলে রোজা শুরুর আগে অর্থাৎ সেহরিতে আপনি কিছু পরিমাণ ক্যাফেইন গ্রহণ করতে পারেন। তবে এর সাথে প্রচুর পরিমাণ পানি পান করতে ভুলবেন না।

৩. পানিশূন্যতা
সারাদিন রোজা রাখার পর পানিশূন্যতা পূরণ করাটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। তাই এটি পূরণে রোজা ভাঙার পর ইফতারির পর প্রচুর তরল খেতে ভুলবেন না।

একইভাবে সেহরিতেও পর্যাপ্ত তরল খাবার গ্রহণ করুন। মিষ্টি জাতীয় পানীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। কারণ এটি আপনার পানির পিপাসা আরো বাড়াবে।

৪. খাবারের সময়ে পরিবর্তন
ঠিক সময়ে খাবার না খেলে যদি আপনার মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হয় তাহলে ভোর থেকে সারাদিন না খেয়ে থাকা নিয়ে হয়তো আপনি দুশ্চিন্তায় পড়তে পারেন। এটি কাটাতে সেহরিতে ভরপেট খাবার খান।

বিশেষ করে উচ্চ প্রোটিন যুক্ত খাবার যেমন- মাংস, মাছ, ডিম, বাদাম ও বিভিন্ন ধরনের বীজ, পূর্ণ আঁশযুক্ত শর্করা জাতীয় খাবার যেমন বাদামী চাল, ওটস বা পূর্ণ আঁশযুক্ত রুপি খেতে পারেন।

যতটা সম্ভব প্রক্রিয়াজাত খাবার বিশেষ করে যাতে বেশি পরিমাণ চিনি থাকে তা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন।

৫. ঘুম
রমজানে যদি আপনার ঘুমের নিয়মে বেশি ব্যাঘাত ঘটে যেমন- এর জন্য যদি আপনাকে অনেক আগে-ভাগে ঘুম থেকে জেগে উঠতে হয়, তাহলে মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হওয়ার একটা আশঙ্কা থাকে।

এটি এড়াতে এবং আপনার শরীরকে অভ্যস্ত করে তুলতে রমজান আসার আগে থেকেই এই সময়ে অ্যালার্ম দিয়ে একইসময়ে ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করতে পারেন।

এছাড়া রমজানে একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং একইসময়ে ঘুম ভাঙার অভ্যাস গড়ে তুললে তাও মাইগ্রেন এড়াতে সহায়ক হতে পারে।

পুষ্টিবিদ ফাতিন আল নাশাশ বলেন, ’একজন রোগী রোজা রাখতে পারবেন কি না তা সঠিকভাবে বলতে পারবেন তার চিকিৎসক। সে কতটা ঘনঘন মাইগ্রেনের ব্যথার শিকার হচ্ছে, তার তীব্রতা কতটা সেটার ওপর নির্ভর করবে যে সে শারীরিকভাবে সক্ষম কি না। যেমন- কোনো রোগীর যদি মাথাব্যথার কারণে বমি হয় তাহলে তার পক্ষে রোজা রাখা সম্ভব নয়। কারণ তার প্রচুর পরিমাণে পানি ও তরল দরকার।’

নিউরোসার্জন ডা. আহমেদ আল-তামিমি বলেন, ‘যেসব রোগীর তীব্র মাইগ্রেন অ্যাটাক হয় না এবং মাথাব্যথার সাথে যে সহজেই মানিয়ে নিতে পারে, তারা স্বাভাবিক নিয়মেই রোজা রাখতে পারেন। কিন্তু কারো যদি ঘন ঘন মাথাব্যথা হয় এবং তার তীব্রতাও বেশি থাকে তাহলে তাদের ব্যথা কমানোটা আগে জরুরি। এর জন্য তাদের চিকিৎসা নেয়া উচিত এবং প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা উচিত।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement