২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্মৃতি হারালে...

স্মৃতি হারালে... -

কিছুদিন আগে আমার চেম্বারে একজন বৃদ্ধাকে নিয়ে আসলেন একজন মধ্যবয়সী নারী। বৃদ্ধা অসুস্থ, তাও ৪-৫ বছর হলো। কিছুই মনে রাখতে পারেন না। কি খেয়েছেন তাও মনে থাকে না। প্রশাব- পায়খানা অনেক সময় বিছানা বা সোফায় করে দেন। মাঝে মাঝে মল হাতে নিয়ে দেয়ালে লাগিয়ে দেন। কিন্তু বেচারার কোন বিকার নেই। ছেলেমেয়েকে চিনেনা। মাঝে মাঝে ফাঁকা পেলেই নিজের কাপড় চোপড় গুছিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে চান। কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞেস করলে বলেন, আমার বাড়ি যাচ্ছি। কিন্তু সমস্যা হলো অন্যখানে। খুব নাকি মিথ্যা কথা বলেন তিনি। বৃদ্ধার ছেলে বিদেশে থাকেন। মাকে খুব ভালোবাসেন। মাঝে মাঝে ফোন করে মায়ের সাথে কথা বললে তাকে জানান তিনি কিছুই খান নাই, তাকে কেউ খেতে দেয় না। তাকে মারধর করে সবাই। এ পর্যন্ত কথা বলে মধ্যবয়সী নারী কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তিনি বলছিলেন যে তার সংসার ভেঙে যাচ্ছে। তার স্বামী মাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। মায়ের মুখে এসব শুনে সব বিশ্বাস করেছেন। এখন প্রতিদিনই ঝগড়া হচ্ছে।
বৃদ্ধার ছেলে না বুঝলেও চিকিৎসক হিসেবে আমি বুঝতে পারি। বৃদ্ধা আসলে ইচ্ছে করে মিথ্যা বলছেন না। তিনি রোগে আক্রান্ত হয়েই এমনটা বলছেন। তিনি যে রোগে আক্রান্ত তাকে বলে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিলোপ।

ডিমেনশিয়া কি?
ডিমেনশিয়া ইংলিশ শব্দ। বাংলায় অর্থ করলে দাঁড়ায় বুদ্ধিবৈকল্য বা স্মৃতিলোপ। জন্মের পর একটি শিশু বিভিন্ন কিছু শিখতে শুরু করে। নানান বিষয় তার মস্তিষ্কে জমা হতে থাকে। যত বয়স বাড়ে তত তার জ্ঞান বাড়তে থাকে। একটা সময় পরিপক্কতা আসে। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে তার মেধা কমতে শুরু করে। স্মৃতি থেকে অনেক কিছু হারিয়ে যায়। কিন্তু তারপরও নিজের প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে পারে। এমন একটা সময় আসে যখন নিজের দৈনন্দিন কাজ অন্য কারো সাহায্য ছাড়া করতে পারে না তাকে ডিমেনশিয়া বলে।
ডিমেনশিয়া নিউরোলজিক্যাল একটি রোগ। এতে আক্রান্ত ব্যক্তির স্মৃতিলোপ পায়। শুধু স্মৃতিলোপই না সাথে কথা বলার সমস্যা, মনোসংযোগ, এক্সিকিউটিভ ফাংশন বা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এ সমস্যাগুলো অল্পমাত্রায় কমলে কিন্তু ডিমেনশিয়া বলে না। এগুলো এমন পর্যায়ে কমতে হবে যে আক্রান্ত ব্যক্তির দৈনন্দিন কাজকর্ম যেমন চাকরি বাজার, ব্যবস্যা ইত্যাদি ব্যাহত হবে।

পরিসংখ্যান
বিশ্বব্যাপী ডিমেনশিয়ার প্রকোপ কিন্তু অনেক। প্রায় ৫০ মিলিয়ন লোক ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। এর বেশিরভাগ প্রায় ৬০ শতাংশ কিন্তু নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশের মানুষ।
এক গবেষণায়য় দেখা গেছে ৬৫ বছরের পর প্রতি ৮ জনে ১ জন স্মৃতিভ্রমে আক্রান্ত হন।
প্রতি বছর প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে ডিমেনশিয়ায় নাম লেখায়। গবেষণায় দেখা গেছে ২০২৫ সালের মধ্যে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তদের সংখ্যা ৮৫ মিলিয়ন ও ২০৫০ সালের মধ্যে ১৫০ মিলিয়ন হতে পারে।
ডিমেনশিয়া নিয়ে বাংলাদেশে ২০১৯ সালের আগে জাতীয় পর্যায়ে কোনো সমীক্ষা হয়নি। তবে সম্প্রতি জাতীয় নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট (নিনস) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। এতে দেখা যায়, বর্তমানে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে ডিমেনশিয়ার প্রাদুর্ভাব বা ব্যাপকতা ৮ দশমিক ১ শতাংশ। সংখ্যার বিচারে যা ১১ লাখ। সমীক্ষায় বলা হয়, আগামী ২০৪১ সালে দেশে এসব রোগীর সংখ্যা হবে প্রায় ২৪ লাখ। অর্থাৎ বর্তমান সংখ্যার চেয়েও প্রায় তিন গুণ বেশি। কাজেই আমাদের দেশেও কিন্তু ডিমেনশয়ার অনেক রোগী আছে।

আলঝেইমার্স ডিমেনশিয়ার মুল কারণ:
ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিলোপ বলতে আমরা বৃদ্ধদের চিন্তা করি। তা ঠিক। কিন্তু শুধু বেশি বয়সীদের হয় তা কিন্তু না। তরুণদেরও হতে পারে এটি। সাধারণত ৬০ বছরের বেশি বয়স্করা ডিমেনশিয়ায় বেশি ভুগেন। বয়স বাড়লে আক্রান্তের ঝুঁকি বেড়ে যায়। দেখা গেছে ৮৫ বছরের বেশি বয়সীদের ২০-৪০ শতাংশ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হন। ডিমেনশিয়ার অনেক কারণ আছে। আলঝেইমার্স ডিজিজ নামে রোগটি ডিমেনশিয়ার মুল কারণ। ডিমেনশিয়ার ৬০-৭০ ভাগ জায়গা নিয়ে আছে এটি। এছাড়া স্ট্রোককেন্দ্রিক ডিমেনশিয়া, ডিএলবি, পারকিনসন্স ডিজিজ ডিমেনশিয়াতে স্মৃতিলোপ হতে পারে।
এছাড়া মস্তিষ্কের দীর্ঘমেয়াদি ইনফেকশন, নরমাল প্রেসার হাইড্রোকেফালাস, হাইপোথাইরয়েড, ভিটামিন বি১২ স্বল্পতা, মস্তিষ্কের টিউমার, এলকোহল সেবন নানাবিধ কারণে ডিমেনশিয়া হতে পারে।
আলঝাইমার্স রোগের লক্ষণ:
আলঝেইমার্স রোগীদের শুরুতে স্মৃতি কমে যেতে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তি মনে রাখতে পারেন কম। কোন জিনিস খুজে পেতে কষ্ট হয়, টাকা পয়সার হিসেব রাখতে পারেন না। অফিসের কাজ আগে ঠিকমত করতে পারলেও এখন পারছেন না। ড্রাইভিং করতে গেলে এক্সিডেন্ট করা বা পথ ভুলে যাওয়া। এসব লক্ষণ নিয়ে শুরু হয় আলঝেইমার্স রোগের। ধীরে ধীরে বাড়তে থেকে স্মৃতিলোপ। এর সাথে যুক্ত হয় কথা বলার সমস্যা, সিদ্ধান্ত নেয়ার অক্ষমতা।
আচরণগত সমস্যা : শুরুতে খুব পরিচিত জায়গা ভুলে যান। স্টাইলিশ কেউ হঠাত করে ছেঁড়া কাপড়চোপড় পড়া শুরু করেন। যিনি সব সময় চুল পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখতেন তার চুল থাকে উষ্কখুষ্ক। মুড খুব দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। নিজের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন থাকেন।
মানসিক সমস্যা : শুরুতে আক্রান্ত ব্যক্তি তার সমস্যা বুঝতে তাই তিনি দুশ্চিন্তা করেন। পরিচিত কাউকে চিনতে না পারার কারণে লজ্জিত হন। ডিপ্রেশন তাকে ঘিরে ধরে। কিন্তু পরে তিনি বেশ এগ্রেসিভ হয়ে যান। যে কাউকে মারধর করতে চান। তার মধ্যে নানান মানসিক সমস্যক দেখা দেয়। তিনি পরিচিতদের অপছন্দ করেন, মনে করেন তারা তাকে মেরে ফেলবেন। যে জীবনসঙ্গীকে ভালবেসেছেন নিজের থেকেও বেশি শেষ বয়সে এসে তাকে সন্দেহ করা শুরু করেন।
রোগ বাড়তে থাকলে যেখানে সেখানে মল-মুত্র ত্যাগ করেন। খাবার গিলতেও ভুলে যান। এক লোকমা খাবার নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকেন। এভাবেই এক সময় মৃত্যুর মুখে পতিত হন।

রোগ নির্ণয় :
এ রোগ নির্ণয় করার কোন টেস্ট নাই। তাই পরিবারের সদস্যদের কথার ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে মেন্টাল স্টেট পরীক্ষা করে ধারনা পাওয়া যায়। অনেক রোগ আছে যাতে স্মৃতিভ্রম হতে পারে যেমন থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা, ডিপ্রেশন, স্ট্রোক, ব্রেন টিউমার ইত্যাদি। এ রোগগুলোর কিন্তু চিকিৎসা আছে। চিকিৎসা করালে স্মৃতিলোপ ভাল হয়ে যায়। তাই স্মৃতিভ্রমের সমস্যা দেখা মাত্র নিউরোলজিস্টের শরণাপ্নন হবেন। আবার বলছি কোনভাবেই দেরি করবেন না।

চিকিৎসা:
আলঝেইমার্স রোগের বেশ কিছু ওষুধ আছে। ওষুধ সেবন করলে রোগী অনেকখানি ভালো থাকেন। এছাড়া রোগীর অন্যান্য সমস্যারও চিকিৎসা আছে। তাই দেরি করবেন না। তবে সমস্যা হলো এ রোগের ওষুধ দীর্ঘদিন ধরে সেবন করতে হয়। ওষুধের দাম একটু বেশি।
অনেকেই আছেন রোগীর উন্নতি না হলে অস্থির হয়ে যান। একের পর এক চিকিৎসক পরিবর্তন করেন। এতে কিন্তু চিকিৎসা ব্যাহত হয়। চিকিৎসায় উন্নতি হবে তবে তা ধীরে ধীরে। তাই অস্থির হবেন না।
আলঝেইমার্স রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দেখাশুনা করা জরুরী। এরা শিশুর মত হয়ে যান তাই তাদেরকে শিশুর মতই টেককেয়ার করতে হবে। আমরা মনে করি বুড়ো বয়সে ভিমরতি করছেন। শিশুদের ব্যাপারগুলো খুব সহজে মানতে পারলেও বয়স্কদেরটা পারি না। তাই অহেতুক খারাপ ব্যবহার করি। এতে আক্রান্ত ব্যক্তি আরোও মানসিক চাপে পড়েন। তাই এ রোগে আক্রান্তদের সেবা করতে হবে খুব যতœ নিয়ে একেবারেই শিশুর মত করে। পরিবারে খুব হাসিখুশি পরিবেশ রাখার চেষ্টা করতে হবে।
আলঝেইমার্স আক্রান্তদের শারীরিক ভাবে কর্মক্ষম রাখলে রোগ আস্তে চলা নীতি মেনে চলে। তাই তাদেরকে নিয়ে বাইরে হাটতে যান।
এ রোগে আক্রান্তরা সুর্য ডোবার সময় খুব আপসেট হন যা সারারাত ধরে চলতে থাকে। তাই সূর্য ডোবার আগেই ঘরের দরজাজানালা বন্ধ করে লাইট জ্বালিয়ে দিন।
আলঝাইমার্স রোগ খুব খারাপ হওয়ার আগেই তার জমিজমা, সম্পদের ব্যবস্থা করতে পারেন। না হলে পরে ঝামেলায় পরতে পারেন।
যাদের পরিবারে এ রোগী আছেন বা যারা তাদের সেবাযতœ করেন তাদের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। ভালবাসার মানুষটির এমন অবস্থা সহজে মেনে নিতে পারেন না। এমনটি হলে চিকিৎসকের পরার্মশ নিন। নিজেকে সময় দিন।
প্রতিরোধ
আলঝেইমার্স রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে অনেকেই জানতে চান। এটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। এখন পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে তা হল শাকসবজি, মাছ, বাদাম বেশি করে খেলে ও শারীরিক পরিশ্রম করলে এ রোগের আক্রান্তের সম্ভবনা কমে। এছাড়া ধুমপান, মদপান না করলে ঝুঁকি কমে। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ রাখলে প্রতিরোধের সম্ভবণা থাকে।

লেখক : নিউরোলজিস্ট
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স (নিনস)


আরো সংবাদ



premium cement
ভারতে দ্বিতীয় পর্বে ৮৮ আসনে ভোট খালেদা জিয়ার সাথে মির্জা ফখরুলের ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ অব্যাহত পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা আটক জীবন্ত মানুষকে গণকবর আগ্রাসন ও যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৃষ্টির জন্য সারা দেশে ইসতিস্কার নামাজ আদায় আরো ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট তাপপ্রবাহ মে পর্যন্ত গড়াবে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঢাকার ভূমিকা চায় যুক্তরাষ্ট্র বিদ্যুৎ গ্যাসের ছাড়পত্র ছাড়া নতুন শিল্পে ঋণ বিতরণ করা যাবে না

সকল