চোখের ওষুধ ব্যবহারে সতর্ক হোন
- প্রফেসর (অব:) ডা: সৈয়দ এ কে আজাদ
- ০৬ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:২০, আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:৩৪
বিভিন্ন কারণে চোখে সমস্যা হতেই পারে। সমস্যা হলে যেতে হবে চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে অনেকে নিজেই চিকিৎসক হয়ে ওঠেন। ওষুধের দোকান থেকে কিনে আনেন চোখের ড্রপ। এতে তিনি যে স্থায়ী অন্ধত্ব বরণ করতে পারেন- এ কথা তার মাথায় একবারের জন্যও আসে না। তাই চোখের ওষুধ ব্যবহারে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন দরকার।
চোখে সমস্যা হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া একান্ত জরুরি। আবার চিকিৎসা নিতে গেলে যে বিষয়গুলো জানানো জরুরি তা হলো- রোগীকে প্রথমেই জানতে হবে তার চোখের ড্রপে কোনো ধরনের অ্যালার্জি হয় কি না। অ্যালার্জির ইতিহাস থাকলে সেই ড্রপের নাম চিকিৎসা নেয়ার আগেই চিকিৎসককে জানাতে হবে। দেহে চোখের রোগ ছাড়া অন্য কোনো রোগ আছে কি না। যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, হাঁপানি, বাত রোগ ইত্যাদি থাকলে চিকিৎসককে জানাতেই হবে।
চোখের চুলকানির কারণে চিকিৎসক অ্যালার্জির চিকিৎসা হিসেবে কখনো কখনো স্বল্প সময়ের জন্য স্টেরয়েড আইড্রপ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এতে রোগী বেশ আরাম পান; কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এ ড্রপ মাসের পর মাস ব্যবহার ঠিক নয়। এতে চোখে ছানি রোগ এবং চাপ বেড়ে গিয়ে (গ্লুকোমা) চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশে বর্তমানে অনিয়ন্ত্রিত স্টেরয়েড ব্যবহারজনিত অন্ধত্বের হার ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ ব্যবহারও ঠিক নয়। এতে চোখের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং ঘন ঘন চোখে ইনফেকশন হয়ে থাকে। গ্লুকোমা রোগের কারণে চোখের ড্রপ ব্যবহারকারীর ক্ষেত্রে কিছু সাবধানতা আবশ্যক। কারণ বিটাব্লুকার-জাতীয় চোখের ড্রপ, যেমন- টিমোলোল মেলিয়েট হাঁপানি রোগীর শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে দেয়। হৃদরোগীরও অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে হাঁপানি ও হৃদরোগীর গ্লুকোমা রোগের চিকিৎসায় অন্য গ্রুপের ওষুধ ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে। এ ছাড়াও ওষুধ প্রয়োগের পর নেত্রনালীতে কিছুটা চাপ দিয়ে রাখলে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হয়।
যাদের চোখের ভেতর প্রদাহ বা ইউভাইটিস রয়েছে, সে ক্ষেত্রে পাইলোকারপিন ও ল্যাটানোপ্রস্ট-জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যায় না। এতে চোখের প্রদাহ বেড়ে যায়। আঘাতের কারণে অথবা অন্য যেকোনো কারণে যদি কর্নিয়ায় ঘা হয়, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া স্টেরয়েড ড্রপ ব্যবহার করলে কর্নিয়ায় ঘা বেড়ে গিয়ে কর্নিয়া ছিদ্র হয়ে যেতে পারে। এতে চোখ চিরতরে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। শুষ্ক চোখ, কর্নিয়ার অ্যাবরশন, ভিটামিন ‘এ’ অভাবজনিত রোগে স্টেরয়েড ব্যবহার ঠিক না।
চোখের জ্বালাপোড়া
ডা: আবু আহনাফ
চোখ জ্বালাপোড়া কমবেশি সবারই হয়ে থাকে। চোখের অন্য কোনো সমস্যা থেকে লক্ষণ হিসেবে জ্বালাপোড়া করে থাকে। এসব সমস্যার মধ্যে সাধারণভাবে ড্রাই আই সিনড্রম অন্যতম। আরো রয়েছে কনজাংটিভাইটিস, ব্লেফেরাইটিস, পিঙ্ক আই, অ্যালার্জি, ফটো ফোবিয়া, রোজেসিয়া, ওয়েজনার’স গ্র্যানুলোম্যাটোসিস ইত্যাদি। পরিবেশগত কারণেও চোখ জ্বালাপোড়া করে থাকে। যেমনÑ ধুলোবালু, রোদ, ধূমপান, বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য। অ্যালার্জি হিসেবে রয়েছে পরাগরেণু, ধুলা, মোল্ড, পশুর পশম ইত্যাদি। নানা ধরনের সুগন্ধি দ্রব্যও চোখ জ্বালার কারণ হয়ে থাকে। বয়সজনিত কারণে শরীর তার তেলগ্রন্থির নিঃসরণ কমিয়ে দেয়। ফলে চোখে শুকনো ভাবের সৃষ্টি হয়। এর জন্য চোখে জ্বালাপোড়া হতে পারে। কোনো কোনো ওষুধ সেবনের কারণেও চোখ জ্বালাপোড়া করতে পারে। তাই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
অসম্ভব চোখ জ্বালা হয় কনজাংটিভাইটিস হলে। কনজাংটিভাইটিসের প্রধান কারণ ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস সংক্রমণ। এ ছাড়া অ্যালার্জি অথবা কন্টাক্ট লেন্স সম্পর্কিত জটিলতাও এর জন্য দায়ী। শরীরের কোথাও জীবাণুর সংক্রমণ ঘটলে যেমন- ব্যাকটেরিয়ার কারণে চামড়ায় ইনফেকশন হলে, অর্থাৎ ধরুন কারো চামড়ায় ফোড়া বা চুলকানি হয়েছে। আপনি আপনার হাত দিয়ে সেগুলো চুলকানো এবং ওই হাত কোনোভাবে চোখে লাগল কিংবা ওই হাত দিয়ে চোখ চুলকালেন, তাহলে ওই জীবাণু চোখে গেল এবং চোখ চুলকানি ও জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে গেল। অথবা কারো চোখ উঠেছে, এমন ব্যক্তির রুমাল বা তোয়ালে ব্যবহার করলেও চোখে জীবাণুর সংক্রমণ ঘটতে পারে। ফলে কনজাংটিভাইটিস হয়ে চোখ জ্বালা হতে পারে। আমাদের মতো দেশে ‘ব্যাসিলাই’ নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার কারণে অ্যাপিডেমিক কনজাংটিভাইটিস হয়ে থাকে, যা অত্যন্ত মারাত্মক আকার ধারণ করে মহামারী রূপে দেখা দেয়।
গনোরিয়া এক ধরনের মারাত্মক যৌনরোগ। এর জীবাণুর নাম নাইসেরিয়া গনোরিয়া। গনোরিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের এ জীবাণুর সংক্রমণে কনজাংটিভাইটিস হতে পারে। এ ধরনের রোগীদের প্রথমে ডান চোখ এবং পরে বাম চোখে সংক্রমণ ঘটে। গনোরিয়া আক্রান্ত কোনো মহিলা যখন সন্তান প্রসব করে তখন তার শিশুটি ওই জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়; যাকে বলা হয় অপথ্যালমিয়া নিওনেটোরাম বা নবজাতকের চোখ ওঠা। বড়দের মতো শিশুটিরও তখন অন্যান্য লক্ষণের সাথে চোখ জ্বালা করে।
যেসব ভাইরাসে চোখ প্রদাহ ঘটে থাকে তারমধ্যে রয়েছে হারপিস ও অ্যাডোনা ভাইরাস। ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও আরেকটি জীবাণুর সংক্রমণে চোখে প্রদাহ হয়ে থাকে যার নাম ‘ক্যামিডিয়া’। ব্যাকটেরিয়ার অনুপাতে এরা অনেক ছোট এবং ভাইরাসের অনুপাতে বড়। কিন্তু দুটোর বৈশিষ্ট্যই ক্যামিডিয়ায় বিদ্যমান। এদের আক্রমণে ট্র্যাকোমা হয়, যা এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী চোখ ওঠা এবং সময়মতো এর চিকিৎসা না হলে বছরের পর বছর তা থাকতে পারে। সাধারণত যারা অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়ায় বসবাস করেন তাদেরই ট্র্যাকোমা বেশি হয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই ট্র্যাকোমা ঠেকানোর প্রধান উপায়। এই রোগ অত্যন্ত সংক্রামক। আঙুলের স্পর্শ বা ব্যবহৃত রুমাল-তোয়ালে থেকে সহজেই অন্যদের চোখে তা সংক্রমিত হতে পারে। তাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবনধারাই এ রোগ ঠেকাতে পারে।
ব্লেফ্যারাইটিসের কারণেও চোখে জ্বালা হতে পারে। সব বয়সের মানুষেরই এটা হতে পারে। অসংক্রামক বলে পরিচিত এ রোগ ব্যাকটেরিয়ার কারণেও সংক্রমিত হতে পারে। এটা কখনো কখনো চোখের দৃষ্টিশক্তিরও অনিষ্ট সাধন করতে পারে। এ রোগ সাধারণত চোখের মেইবোমিয়ান গ্লান্ডস প্রদাহের কারণে হয়ে থাকে।
আলোর সংবেদনশীলতাই ফটোফোবিয়ার জন্ম দেয়। কখনো কোনো জীবাণু সংক্রমণ বা রাসায়নিক দ্রব্যও এ সংবেদনশীলতা তৈরি করতে পারে। ফটোফোবিয়ার সাথে সম্পর্কিত সমস্যাগুলো হলো- কালার ভিশন ডিফেক্টস, কনজাংটিভাইটিস, ক্যারাটাইটিস ও আইরিটিস ইত্যাদি। এর কারণে ড্রাই আই সিনড্রমও তৈরি হতে পারে।
চোখ জ্বালাপোড়ার সাথে পরিবেশের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ধুলোবালু, নোংরা আবর্জনা, ধূমপান, রোদের প্রখরতা, রাসায়নিক দ্রব্য ও আবহাওয়াগত প্রভাব ইত্যাদি অনেক কিছুই জড়িত। তাই চোখের সমস্যায় সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। আলোচনায় জেনেছি, সংক্রমণের মাধ্যমেই চোখের সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। তাই সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচার জন্য অনন্য পথ হলো স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন থাকা।