২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
বাজেট বিশ্লেষণে সিপিডি

ভোটের জন্য গোষ্ঠীস্বার্থে সংস্কারের উদ্যোগ নেই

সিপিডির বাজেট পর্যালোচনায় অতিথিরা : নয়া দিগন্ত -


বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ও মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ। এ চাপ মোকাবেলায় বাজেটে কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপই নেই। সামনে জাতীয় নির্বাচনের কারণে বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থে প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এমন মন্তব্য করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর হবে চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। কঠিন সময়ের এই বাজেটে কঠিন কিছু ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটি নেয়া হয়নি। আয়কর রিটার্নের প্রমাণপত্র পেতে করদাতাদের ন্যূনতম দুই হাজার টাকা প্রদানের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী; যা সাংঘর্ষিক, অন্যায্য ও বৈষম্যমূলক। আর জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগসহ বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী এবং বাস্তবতাকে গ্রহণ না করেই একটি আকাক্সক্ষার বাজেট। চলমান যে অর্থনৈতিক চাপ তাতে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করেছেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির যেসব প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, তা অলীক এবং অর্জনযোগ্য নয়।

রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে গতকাল প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর বিস্তারিত বিশ্লেষণ তুলে ধরে সিপিডির পক্ষ থেকে এসব তথ্য জানানো হয়। মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখিত পর্যালোচনা তুলে ধরেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, এক দিকে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়েছে, অন্য দিকে ন্যূনতম কর দুই হাজার টাকা করা হয়েছে। যাদের করযোগ্য আয় নেই, তারাও এই করের আওতায় পড়বেন। এ কারণে উদ্যোগটি নৈতিকতার দিক থেকে ঠিক নয়, আবার যৌক্তিকও নয়। তিনি বলেন, বাজেটে এমন কিছু রাজস্বব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, যাতে কিছু পণ্যমূল্য বাড়বে। যার প্রভাব সরাসরি মানুষের তথা ভোক্তার ওপর পড়বে। বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। বাজেটে যেসব প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই বাস্তবভিত্তিক নয়। তাই এসব লক্ষ্য অর্জন শেষ পর্যন্ত হবে না। প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে আর্থিক খাত সংস্কার, পুঁজিবাজার ও আইএমএফের শর্তের ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হয়নি। এমন বাজেট ‘বাস্তবতাহীন’।

অর্থনীতির পরিস্থিতি তুলে ধরে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী, যা মানুষের জীবনে আঘাত করছে। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণও ক্রমেই বাড়ছে; যা তারল্যের ওপর একধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। রফতানি প্রবৃদ্ধির হার নিম্নমুখী, রেমিট্যান্সপ্রবাহ প্রবৃদ্ধিও নিম্নমুখী, বৈদেশিক মুদ্রারও অভাব কিছুটা দেখা দিচ্ছে। এই রিজার্ভও নিম্নমুখী হচ্ছে। ফলে আমদানি যতটুকু করা দরকার সেটি করা সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যাপক একটি ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। এসব চাপের কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ভঙ্গুর হয়ে গেছে।

জিডিপি ও বিনিয়োগের প্রক্ষেপণ নিয়ে সিপিডির ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, জিডিপির এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেই ধরনের প্রক্ষেপণ এখানে করা হয়েছে, সেখানে আমরা গত অর্থবছরে এবং তার আগের অর্থবছরের সাথে এই অর্থবছরের তুলনা করেছি। সেখানে যে অনুমিতিগুলো করা হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারেও আমাদের বক্তব্য হচ্ছে যে, এসব অনুমিতি অনেকগুলো অর্থনীতির যে সূচকগুলো, সেই সূচকগুলোর যে প্রবৃদ্ধি এবং প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবতার সাথে তেমন কোনো মিল নেই।

সিপিডি বলছে, আমরা দেখছি যে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। গত অর্থবছরেও সেটা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছিল। পরবর্তীতে এটিকে নামিয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে যে, এই আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশ হবে। আমরা যদি ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ, সরকারি বিনিয়োগ এবং জিডিপির রেশিও দেখি, হার দেখি, সেখানে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, সেটি ধরা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ। এখানে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির অংশ হিসেবে ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ ২০২৩-২৪ অর্থবছর ধরা হয়েছে। আসলে ২০২২-২৩ অর্থবছর আমরা দেখেছি, যেটা ধরা হয়েছিল, তার চেয়ে কম এ পর্যন্ত হয়েছে। আর সেটি ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। এখান থেকে কিভাবে এতটা জাম্প দিয়ে ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ হবে? এটি আমাদের কাছে উচ্চাকাক্সক্ষা মনে হচ্ছে। এই যে ঘুরে দাঁড়ানোর এবং ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক বছরের মধ্যে এতখানি উল্লম্ফন হবে, সেটি অনেকটাই একটা বিরাট আকাক্সক্ষা বলা যায়।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অনুমিতিগুলো বাস্তবতার সাথে মিল থাকে না। বাস্তবতাকে গ্রহণ না করে আকাক্সক্ষার বাজেট করা হয়েছে। কাঠামোগত, অনুমিতিগত দুর্বলতার কারণে বাজেট বাস্তবায়নে আবারো আমরা নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবো। আর্থিক খাতের সংস্কারে দীর্ঘ দিন ধরে একটা ব্যাংকিং কমিশনের কথা বলেছি। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে ঋণখেলাপি ছিল ২১ হাজার কোটি টাকা। আজ সেটির পরিমাণ এক লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। এটি কেন হচ্ছে, কারা করছেন? এটি নিয়ে কারো কী কোনো দুশ্চিন্তা নেই, কারো ঘুম হারাম হচ্ছে না।

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মূল্যস্ফীতির অভিঘাত থেকে কিছুটা স্বস্তি দেয়ার জন্য করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তার আওতাও বাড়ানো হয়েছে। তবে পরিমাণে খুব কম বাড়ানো হয়েছে, যা নিম্নআয়ের মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, ডাইরেক্ট ট্যাক্সের (প্রত্যক্ষ কর) সুবিধাভোগী বড় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। তাদের আমরা টাচ (স্পর্শ) করতে চাচ্ছি না। ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স (পরোক্ষ) বাড়াতে চাচ্ছি। সরকারের হাতে খুব বেশি রাজস্বও নেই। আইএমএফের শর্তানুযায়ী- যেসব সুবিধা কমিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছে, সেগুলোতে হাত দেয়া হয়নি। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে এটি করা হয়েছে বলে মনে করি। তার মধ্যে রয়েছে- কর কাঠামোতে হাত না দেয়া, ব্যক্তিশ্রেণীর আয়করে হাত না দেয়া, এক্সপোর্ট ইনসেনটিভে হাত না দেয়া। এ বছর থেকে সেগুলোতে হাত দেয়ার কথা ছিল। সম্ভবত সরকার নির্বাচনের পরে এ সংস্কারে হাত দেবে। তিনি বলেন, বাজেটের মাত্র তিন জায়গায় আইএমএফের কথা বলা হয়েছে। সেখানে সংস্কার কিংবা শর্তের কথা বলা হয়নি। সংস্কারসম্পর্কিত বিভিন্ন সূচকে আইএমএফের শর্তের প্রতিফলন কম বেশি দেখতে পাচ্ছি। যদিও তা পর্যাপ্ত নয়। এখনো সরকার আইএমএফ নির্দেশিত সংস্কারের দিকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছে। বাস্তবতা অনুধাবন করছে না। কিন্তু সেটির লক্ষ্যে যে সংস্কার নেয়া দরকার, সেদিকে এখনো পুরোপুরি ঢোকেনি। সাবসিডি (ভর্তুকি) মোটামুটি একই জায়গায় রাখা হয়েছে। কৃষি ও জ্বালানি খাতে মূল্য সমন্বয়ের বিষয়গুলো নির্বাচন-পরবর্তীকালে আমরা দেখতে পাবো।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রস্তাবিত স্মার্ট বাজেটে পুঁজিবাজার নিয়ে কিছু নেই। দুর্ভাগ্যবশত আইএমএফের সংস্কার কাঠামোর ভেতরে পুঁজিবাজারসংক্রান্ত কোনো শব্দ নেই। তাই পুঁজিবাজারসংক্রান্ত শব্দ বাজেটেও নেই। থাকলে হয়তো আমরা দেখতে পেতাম সরকার কতটুকু উদ্যোগ নিয়েছে। স্মার্ট বাজেটের জন্য স্মার্ট পুঁজিবাজারের উদ্যোগ প্রয়োজন।তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, বাজেটে অনেক কিছুই অনুপস্থিত। ইডিএফ নিয়ে বাজেট বক্তৃতায় কিছু বলা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কত টাকা ধার নেবেন তাও উল্লেখ করা হয়নি। হুন্ডি ও অর্থ পাচার নিয়ে কোনো কিছু বলা হয়নি। আয় বৈষম্য নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতায় কিছু বলা হয়নি। মোট কথা চলতি অর্থবছরের বাজেটের দুর্বলতা এবারো বাজেটে দেখলাম।

 


আরো সংবাদ



premium cement