২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দুর্নীতিতে বাংলাদেশের এক ধাপ অবনতি

দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্কোর
-


অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় দুর্নীতির ধারণাসূচকে (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স বা সিপিআই) এক ধাপ অবনমন ঘটেছে বাংলাদেশের। এবার বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্কোরে রয়েছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া বলে জানিয়েছে জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। সংস্থাটি বলছে, গত বছরের তুলনায় দুর্নীতি ধারণাসূচকে বাংলাদেশের স্কোর ও অবস্থানে এক ধাপ অবনমন হয়েছে। আর স্কোরে এশিয়ার মধ্যে চতুর্থ সর্বনিম্নে রয়েছে বাংলাদেশ। আর টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এই প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বলছেন, দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা এখনো উদ্বেগজনক বলেই প্রতীয়মান হয়। বাংলাদেশের চলমান দুর্নীতি আরো ঘনীভূত ও গভীরভাবে বিস্তৃত হয়েছে। বিশেষ করে সরকারি ক্রয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। করোনা মহামারীর সময় কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নানা সরঞ্জাম ক্রয় ও বিতরণেও দুর্নীতি হয়েছে। দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে জবাবদিহিতা নেই। বৈষম্যের হাতিয়ার হলো দুর্নীতি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।


রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবি কার্যালয়ে গতকাল দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এর সারমর্ম তুলে ধরেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। এ সময় টিআইবির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) ড. সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (আউটরিচ কমিউনিকেশন) শেখ মঞ্জুর-ই আলম উপস্থিত ছিলেন।
সিপিআই ২০২২ অনুযায়ী ১০০-এর মধ্যে বৈশ্বিক গড় স্কোর ৪৩; আর বাংলাদেশের স্কোর ২৫, যা ২০২১-এর তুলনায় এক পয়েন্ট কম। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা এখনো উদ্বেগজনক বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতার কারণে ‘বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত বা বাংলাদেশের অধিবাসীরা সবাই দুর্নীতি করে এ ধরনের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। যদিও দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্যদূরীকরণ, সর্বোপরি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে কঠিনতম অন্তরায়, তথাপি দেশের সব জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি ও তা প্রতিরোধে ব্যর্থতার কারণে দেশ বা জনগণকে কোনোভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যাবে না।


সূচক অনুযায়ী ২০১২-২০২২ পর্যন্ত বাংলাদেশের অবস্থানের তুলনামূলক বিশ্লেষণ : গত ১১ বছরে সিপিআই সূচকের বিশ্লেষণ বলছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের স্কোর ২০১৪ ও ২০১৫ সালের অনুরূপ ২৫; আর নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ২০২০-এর অনুরূপ ১২তম, যা এই সময়কালে সর্বনিম্ন। শেষ ১১ বছরে বাংলাদেশের স্কোর ঘুরে ফিরে ২৫ থেকে ২৮-এর মধ্যেই আটকে আছে। এর মধ্যে টানা চার বছরসহ মোট ছয়বার বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৬, এবারসহ তিনবার ২৫ এবং একবার করে ২৭ ও ২৮। আর নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান সর্বোচ্চ চারবার ১৩তম, দুইবার ১৪তম, এবারসহ দুইবার ১২তম এবং একবার করে ১৫, ১৬ ও ১৭তম, যা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের সার্বিক কোনো অগ্রগতি যেমন নির্দেশ করে না, তেমনি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে অভিকর স্থবিরতার প্রমাণ দেয়। এমনকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন অঙ্গীকার এবং দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন পর্যায়ের ঘোষণা সত্ত্বেও উল্লিখিত সময়কালে আমাদের এই নিম্ন স্কোর ও অবস্থান প্রমাণ করে যে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও কাঠামোগত দুর্বলতায় বাংলাদেশের অবস্থানের বাস্তবিক উন্নতি হচ্ছে না; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবনমন ঘটছে।


গত ১০ বছরের প্রবণতা বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে (২০১২-২০২২) স্কোরে সেরা লাভকারী আফগানিস্তান (৮ থেকে ২৪), আর্মেনিয়া (৩৪ থেকে ৪৬), অ্যাঙ্গোলা (২২ থেকে ৩৩), এস্তোনিয়া (৬৪ থেকে ৭৪), গ্রিস (৩৬ থেকে ৫২), লাওস (২১ থেকে ৩১), ভিয়েতনাম (৩১ থেকে ৫২)। আর অবস্থা খারাপ হয়েছে- অস্ট্রেলিয়া (৮৫ থেকে ৭৫), কানাডা (৮৪ থেকে ৭৪), সাইপ্রাস (৬৬ থেকে ৫২), হাঙ্গেরি (৫৫ থেকে ৪২), কাতার (৬৮ থেকে ৫৮), সিরিয়া (২৬ থেকে ১৩), তুরস্ক (৪৯ থেকে ৩৬)।


দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের তুলনা : টিআই বলছে, গত ২০২২ সালের সিপিআই অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু ভুটান তালিকার প্রথম সারিতে ২৫তম স্থান পেয়েছে। এ অঞ্চলের আটটি দেশের মধ্যে আফগানিস্তান ও নেপালের স্কোর ২০২১-এর তুলনায় যথাক্রমে ৮ ও ১ পয়েন্ট বেড়েছে। আর ভুটান, মালদ্বীপ ও ভারতের স্কোর অপরিবর্তিত রয়েছে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের স্কোর ১ পয়েন্ট অবনমন ঘটেছে। তবে উচ্চক্রম অনুযায়ী অবস্থানের দিক থেকে ২০২১ সালের তুলনায় আফগানিস্তানের অভূতপূর্বভাবে ২৪ ধাপ উন্নতি হয়েছে। নেপাল ও শ্রীলঙ্কার এক ধাপ উন্নতি হয়েছে। আর অবশিষ্ট সবগুলো দেশের অবস্থানই অপরিবর্তিত রয়েছে।


আন্তর্জাতিক সূচক অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভুটান ২০২১ সালের মতো ৬৮ স্কোর নিয়ে ২৫তম অবস্থানে রয়েছে। এরপর মালদ্বীপ ও ভারত যৌথভাবে অপরিবর্তিত ৪০ স্কোর নিয়ে উচ্চক্রম অনুযায়ী ২০২১ সালের মতো ৮০তম অবস্থানে রয়েছে। শ্রীলঙ্কার স্কোর গতবারের তুলনায় ১ পয়েন্ট কমে ৩৬ হলেও, উচ্চক্রম অনুযায়ী ১ উন্নতি হয়ে ১০১তম অবস্থানে রয়েছে। আর নেপাল ১ স্কোর বেড়ে ৩৪ পয়েন্ট পেয়েছে এবং উচ্চক্রম অনুযায়ী সাত ধাপ উন্নতি হয়ে ১৯০তম অবস্থানে রয়েছে। এরপর পাকিস্তান গতবারের তুলনায় ১ পয়েন্ট কম পেয়ে ২৭ স্কোর করেছে এবং উচ্চক্রম অনুযায়ী অপরিবর্তিত ১৪০তম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ গতবারের তুলনায় ১ পয়েন্ট কম ২৫ স্কোর নিয়ে উচ্চক্রম অনুযায়ী অপরিবর্তিত ১৪৭তম অবস্থানে রয়েছে। সর্বশেষ আফগানিস্তান ২০২১-এর চেয়ে ৮ পয়েন্ট বেশি পেয়ে ২৪ স্কোর নিয়ে উচ্চক্রম অনুযায়ী ২৪ ধাপ উন্নতি হয়ে ১০০তম অবস্থানে রয়েছে, যা শুধু দক্ষিণ এশিয়াই নয়, সূচকে অন্তর্ভুক্ত বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে পয়েন্টের উন্নতি হিসেবে চতুর্থতম।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement