১৯ মে ২০২৪, ০৫ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলকদ ১৪৪৫
`


২০২৩ সাল : সঙ্কট ঘনীভূত হতে পারে আর্থিক অঙ্গনে

-

বাংলাদেশের জন্য ২০২৩ সালের আগমন নানা সঙ্কটের মধ্য দিয়ে ঘটছে। রাজনৈতিক অঙ্গনের অচলাবস্থা, সামাজিক ক্ষেত্রের অস্থিরতাকে ছাড়িয়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বড় সঙ্কটের দ্বারপ্রান্তে। এ সঙ্কট সবচেয়ে প্রবল হয়ে উঠছে বৈদেশিক বাণিজ্য, লেনদেন ও বিনিময় হারের ক্ষেত্রে। অর্থনীতির রক্তসঞ্চালক হিসেবে পরিচিত ব্যাংক খাতও একের পর এক জটিল সঙ্কটের মুখে। আস্থা সঙ্কট ব্যাংকগুলো থেকে ব্যাপক আমানত তোলার কারণ হচ্ছে। বৈদেশিক ধার পরিশোধে অক্ষমতার কারণে বিভিন্ন ব্যাংকের রেটিং কমিয়ে দিয়েছে মুডিস। শেয়ারবাজারে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের বাজার সম্পর্কে নিরাশ করে তুলছে।
যে ধরনের বৈশ্বিক পরিবেশ অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে সেসবের উন্নতি হলে পরিস্থিতি আরো ভালো হবে বলে আশা করেন অনেকে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ২০২৩ সালে বন্ধ হয়ে যাবে এমন আশাবাদী চিত্র দেখা যাচ্ছে না। এই যুদ্ধের কারণে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে যে উত্তাপ-উত্তেজনা বিদ্যমান বিশ্বপরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলছে তার অবসান ঘটার ক্ষেত্রেও এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
বৈদেশিক খাত বিপদের ঘনঘটা : বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈদেশিক খাত ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকে সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষের ৪৫.৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বৈদেশিক রিজার্ভ ২৬ শতাংশ কমে ৩৩.৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। নিট হিসাবে এই রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলারের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ এর চেয়েও কম বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
গত এক বছরে বৈদেশিক বিনিময় হারে সবচেয়ে অস্থির সময় পার হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫.৮০ টাকা। ২০২২ সালের শেষ কর্মদিবসে এই বিনিময় হার ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১০৫ টাকায় উন্নীত হয়েছে। গত এক দশকে এক বছরে টাকার এত বেশি মূল্য পতন কোনো বছরই হয়নি।
২০২২-২৩ অর্থবছরের পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৮.৮ বিলিয়ন ডলার, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ২.১ শতাংশ বেশি হলেও তার আগের বছরের চেয়ে ১৯ শতাংশের মতো কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৮.৬০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২১ শতাংশ কম ছিল। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ২.৬ শতাংশ।
বৈদেশিক খাতের আয়ের প্রধান খাত রফতানিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পাঁচ মাসে ২১.৯ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১১ শতাংশের মতো বেশি। আগের অর্থবছরের এই পাঁচ মাসে রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৪.৩ শতাংশ। সে তুলনায় এখনকার পরিস্থিতি খুব একটা ইতিবাচক নয়, যদিও নভেম্বর ২২ মাসে ২৬ শতাংশ রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক খাতের সঙ্কট ঘোচানোর জন্য শুরু থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেয়া হয়। এর ফলে চলমান অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ২৭.৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হয়, যা আগের বছরের তুলনায় ৬.৭২ শতাংশ বেশি। কিন্তু আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫১.৪ শতাংশ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই ধরনের উচ্চ ভিত্তির উপর আরো আমদানি বেড়ে যাওয়ার কারণে বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি ও সার্বিক দুই হিসাবেই।
২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার রেকর্ড ঘাটতি সৃষ্টি হয় বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের চলতি হিসাবে। আগের অর্থবছরে এই চার মাস শেষে চলতি হিসাবের ঘাটতি ছিল ৩.৮ বিলিয়ন ডলার। চার মাসে সাড়ে ১৮ শতাংশ চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়েছে। একই সময় সার্বিক বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের হিসাবে ঘাটতি আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৪.৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
বৈদেশিক খাতে চাপ সৃষ্টির একটি বড় কারণ হলো সরকারি-বেসরকারি বৈদেশিক ঋণ। ডিসেম্বরের মাঝামাছি নাগাদ বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ৯৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ রয়েছে ৮৩ বিলিয়ন ডলারের মতো। বাকিটা স্বল্পমেয়াদি ঋণ। মোট বৈদেশিক ঋণের মধ্যে ২০২৩ সালে সরকারি খাতে ২.৫ বিলিয়ন ডলার এবং বেসরকারি খাতের ১৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে হবে।
২০২৩ সালে ৭০ থেকে ৭৫ বিলিয়ন ডলার হতে পারে আমদানি ব্যয়। আর রফতানি আয় হতে পারে ৫২ থেকে ৫৫ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্সের যে ধারা তাতে এটি ২০ বিলিয়ন ডলারের কোঠায় থাকতে পারে। ফলে ২০২৩ সালে বৈদেশিক খাতের যে চাপ তা অব্যহত থাকতে পারে। একই সাথে বাংলাদেশী টাকা ডলারের বিপরীতে আরো মান হারাতে পারে।
চাপে ব্যাংক খাত : ব্যাংক খাত ২০২২ সালের শেষার্ধ থেকে চাপে পড়ে যায়। এই চাপের বড় কারণই হলো নামেবেনামে ঋণ দেয়া। রাজনৈতিক প্রভাবে এসব ঋণের যথাযথ অতিরিক্ত জামানত ও অন্যান্য ডকুমেন্ট ঠিকমতো না রেখেই ঋণ দেয়া হয়। এসব নিয়ে সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ব্যাপকভাবে আমানত উত্তোলন শুরু হয়। সরকারের মুখ্য সচিব মাসাধিককালে ৫০ হাজার কোটি টাকা আমানত উত্তোলন হওয়ার পর তা আবার ব্যাংকে ফিয়ে আসছে বলে উল্লেখ করেন।
খেলাপি ঋণ কমাতে অনেক ক্ষেত্রে ঢালাও সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণের কিস্তি পরিশোধে দেয়া হয়েছে বিশেষ ছাড়। গ্রাহকের যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, ডিসেম্বরের মধ্যে তার ৭৫ শতাংশ পরিশোধ করলেও তাকে আর খেলাপি করা যাবে না বলা হয়েছে। এ সুবিধার পরও বাড়ছে খেলাপি ঋণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। বছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ ২০২২ সালের মার্চ মাস শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকায় পৌঁছায়। দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ জুনে এ অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকায়, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এ অঙ্ক এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।
তবে আইএমএফসহ অনেকেই খেলাপির এই অঙ্কের ব্যাপারে একমত নন। তারা মনে করেন, অবলোপনকৃত ঋণ, মামলার মাধ্যমে নিয়মিত করে রাখা আদায় অযোগ্য ঋণ এবং কৃত্রিমভাবে নিয়মিত দেখানো ঋণ হিসাব করা হলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে।
ব্যাংক খাতে অনাস্থার একটি বড় কারণ ভয়াবহ ঋণ কেলেঙ্কারি। বছরের শুরুতে ব্যাংকপাড়ায় আলোচনায় উঠে আসে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের নাম। ব্যাংকের মালিকানায় থাকা জয়নুল হক সিকদার পরিবারের সদস্যদের আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনের মাধ্যমে অনিয়মে জড়িত থাকার খবর আসে। তথ্য গোপন ও অর্থপাচারের দায়ে ব্যাংকটিকে ৫৫ লাখ টাকা জরিমানা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া নানা জালিয়াতির দায়ে ব্যাংকটির কার্ড বিভাগের কার্যক্রম বন্ধ, দু’টি শাখার এডি লাইসেন্স বাতিলসহ ব্যাংকটির পরিচালক রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদারের বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব বন্ধ করতেও বলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এ ছাড়া অনিয়মে বড় কয়েকটি গ্রুপকে দেয়া ঋণ আদায় না হওয়ায় বেড়েছে খেলাপি ঋণও। এখন ব্যাংকটির মন্দ ঋণের পরিমাণ ২৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
বছরজুড়ে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা ঘটলেও শেষ দিকে এসে আলোচনায় স্থান পায় চারটি ইসলামী ব্যাংকের বৃহৎ কেলেঙ্কারি। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো থেকে নামে-বেনামে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে একটি প্রভাবশালী গ্রুপ। ঋণের অর্থ পাচারও হয়েছে। অনেক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে দেয়া ঋণের বিপরীতে নেয়া হয়নি জামানত, মানা হয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মনীতিও। এসব অনিয়ম ফাঁস হওয়ার পর আতঙ্ক সৃষ্টি হয় আমানতকারীদের মধ্যে। অনেকে আমানত তুলে নেন। আবার কেউ কেউ টাকা তুলে রাখেন অন্য ব্যাংকে। এতে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো থেকে আশঙ্কাজনক হারে আমানত কমে যায়। এক মাসের ব্যবধানে একটি ব্যাংকের আমানত কমে যায় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা না নেয়া হলেও দেয়া হয়েছে নানা ধরনের নীতিসহায়তা। সর্বশেষ ঋণ অনিয়ম তদারকি করতে বেসরকারি শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ দিকে ব্যাংকগুলো ডলার সঙ্কটের কারণে ঋণপত্রের দায় শোধে অপারগ হয়ে পড়লে বৈশ্বিক রেটিং সংস্থা মুুডিস ব্যাংকের ঋণমানের অবনয়ন শুরু করে। ছয় ব্যাংকের মান অবনয়নের পর আরো ব্যাংকের ঋণমান রিভিউ করার কথা জানায় সংস্থাটি।


আরো সংবাদ



premium cement
শিবপুরে পুকুর থেকে মহিলার লাশ উদ্ধার বন্দীদের মুক্ত করতে আলোচনায় বসুন : নেতানিয়াহুকে বন্দীদের পরিবার প্রাণঘাতী ব্যাকটিরিয়ার তালিকা প্রকাশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বার্সাতে থাকার ব্যাপারে এখানো আত্মবিশ্বাসী জাভি বান্দরবানে কেএনএফের আস্তানায় যৌথ বাহিনীর অভিযান, নিহত ৩ দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করুন : প্রধানমন্ত্রী তাহলে ব্যাংকে কি মাস্তান-মাফিয়ারা ঢুকবে : কাদেরকে রিজভী গাজা থেকে ইসরাইলের চতুর্থ লাশ উদ্ধার মাদরাসা শিক্ষার্থী থেকে মালয়েশিয়ার নামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি বশির ইবনে জাফর মিরপুরে লাঠি হাতে নিয়ে অটোরিকশা চালকদের সড়ক অবরোধ ভালুকায় বৃদ্ধা সামর্থ বানুর মানবেতর জীবনযাপন

সকল