২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এসডিজি অর্জনে বৈশ্বিক রোডম্যাপের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদফতর জেনারেল এসেমব্লি হলে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনের উদ্বোধনী সেশনে অংশ নেন: পিআইডি -

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিড-১৯ পরিস্থিতি থেকে স্থায়ীভাবে উত্তরণ নিশ্চিত করে ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য একটি বৈশ্বিক রোডম্যাপের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী গতকাল মঙ্গলবার টেকসই উন্নয়নের ওপর নবম বার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভার্চুয়ালি বক্তব্য প্রদানকালে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে ফিরে যাওয়ার জন্য একটি সাহসী ও উচ্চাভিলাষী বৈশ্বিক রোডম্যাপ প্রণয়ন করা প্রয়োজন, যাতে কেউ পেছনে পড়ে না থাকে।’
আর্থ ইনস্টিটিউট, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, গ্লেøাবাল মাস্টার্স অব ডেভেলপমেন্ট প্র্যাকটিস এবং ইউএন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশনস নেটওয়ার্ক সম্মেলনটির আয়োজন করে।
শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে পাঁচ দফা প্রস্তাবনা রেখেছেন, যাতে এসডিজিএস অর্জন নিশ্চিত করতে যথাযথভাবে বৈশ্বিক কোভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতি মোকাবেলা করা প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই বৈশ্বিক মহামারী থেকে টেকসই উত্তরণের ওপরেই এখন এসডিজি’র সাফল্য নির্ভর করছে। এখন বিশ্বের সব স্থানে ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা সময়ের দাবি এবং তা অতি জরুরি।’ তিনি দ্বিতীয় প্রস্তাবনায় বলেন, ‘২০৩০ এজেন্ডা বাস্তবায়নে আমাদের সম্পদের যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে, তা অবশ্যই কমাতে হবে।’ তৃতীয় প্রস্তাবনায় শেখ হাসিনা বলেন, চলমান বৈশ্বিক মহামারীর অভিঘাতের কারণে ১৯৯৮ সালের পর এই প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছেÑ এ জন্য আমরা উদ্বিগ্ন। তিনি আরো বলেন, অধিকন্তু, আমাদের পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক সুরক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনীর ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী চতুর্থ প্রস্তাবনায় বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি কোভিড-১৯ পরিস্থিতি থেকে পুনরুদ্ধারের পদক্ষেপগুলো ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের বিপর্যয় বা দুর্যোগ মোকাবেলায় জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণকে পূর্ণতা দেবে।’ সর্বশেষ প্রস্তাবনায় তিনি বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নে অবশ্যই পর্যবেক্ষণ জোরদার করা ও যান্ত্রিক সহায়তার ওপর আরো গুরুত্ব দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের সমন্বয় বাড়ানো উচিত।
জরুরি পরিস্থিতি ও বিপর্যয় মোকাবেলায় যথাযথ ও সময়োপযোগী সহায়তা পদক্ষেপ নিশ্চিত করার ওপরও তিনি গুরুত্বারোপ করেন। প্রধানমন্ত্রী মহামারী ও অন্যান্য জরুরি পরিস্থিতির জন্য প্রতিটি স্তরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রস্তুতি বৃদ্ধির পরামর্শ দেন।
২০৩০ এজেন্ডাকে একটি বৈশ্বিক চুক্তি আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘এটি সবার অন্তর্ভুক্তিতে আমাদের টেকসই বৈশ্বিক উন্নয়নের একটি ব্লুপ্রিন্ট। কোনো দেশ একা এই এজেন্ডা অর্জন করতে পারবে না। এই এজেন্ডা অর্জনে আমাদের বৈশ্বিক সহযোগিতা ও সংহতি বাড়াতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, আমরা ইতোমধ্যে ডিকেড অব ডেলিভারি এবং অ্যাকশন অব দ্য এজেন্ডাতে প্রবেশ করলেও লক্ষ্য এখনো দূরেই রয়ে গেছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এমনকি কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর আগেও অনেক দেশ এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে ছিল না। এই মহামারী তাদেরকে সেই পথ থেকে আরো পিছিয়ে দিয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, কোভিড-১৯ বিশ্বকে হতাশ করেছে। এই বৈশ্বিক মহামারী বহু মানুষের জীবন কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি এর কারণে অসংখ্য মানুষ তাদের জীবিকা হারিয়েছে। মহামারীর কারণে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছে ও ক্ষুধার্ত রয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, মহামারীর কারণে শিক্ষার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, বিশেষত শিশুদের শিক্ষা।
বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি এই মহামারীতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এর ফলে আমাদের উন্নয়নের অর্জন ও এসডিজিএস অগ্রগতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ এ ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রস্তুতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে অ্যাডাপটেশন ও মিটিগেশন প্রচেষ্টায় পথিকৃৎ। আমরা সম্প্রতি একটি উচ্চাভিলাষী ও আধুনিক এসডিজি পেশ করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা সবুজ উন্নয়নের মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জন, লবণাক্ততা সহিষ্ণুতা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে প্রাধান্য দিয়ে ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রোসপারিটি প্ল্যান’ গ্রহণ করেছি।’ ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০২১ এর বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৫ সাল থেকে এসডিজি সূচকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি লাভ করেছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে প্রথম পাঁচটি দ্রুততম অর্থনৈতিক অগ্রগতির দেশের অন্যতম এবং জিডিপিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৪১তম।
এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার প্রদান : এ দিকে জাতিসঙ্ঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশনস নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) দারিদ্র্য দূরীকরণ, পৃথিবীর সুরক্ষা এবং সবার জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণের সার্বজনীন আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের সঠিক পথে অগ্রসরের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার’ প্রদান করেছে। সোমবার নিউ ইয়র্কে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ পুরস্কার গ্রহণ করে বলেন, তিনি বাংলাদেশের জনগণকে এটি উৎসর্গ করছেন।’
মোমেন সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের পর টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে (এসডিজি) দ্রুত এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে এ পুরস্কার পাওয়াকে দেশের সফলতার গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে অভিহিত করেন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন কৌশলবিদ অধ্যাপক জেফ্রি ডি. সচ’র নেতৃত্বে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১২ সালে এসডিএসএন প্রতিষ্ঠা করা হয়। টেকসই উন্নয়নের জন্য বাস্তবভিত্তিক সমাধান জোরদারে বিশ্বের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগানোই এ প্লøাটফর্মের লক্ষ্য।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক শেখ হাসিনাকে ‘জুয়েল ইন দি ক্রাউন অব দি ডে’ হিসেবে তুলে ধরেন এবং সচ বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনাভাইরাস চলাকালেও এসডিজি প্রচারণা কার্যক্রম চালাতে তার নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। এ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘এ পুরস্কার হচ্ছে এসডিজি’র লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে জোরালো দায়িত্ব পালনের একটি প্রমাণপত্র।’
জলবায়ু ইস্যুতে বলিষ্ঠ পদক্ষেপের আহ্বান : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সঙ্কট মোকাবেলায় জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বিশেষ করে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে জলবায়ু বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি নিয়ে জল্পনা কল্পনার মধ্যেই গত সোমবার তিনি এই আহ্বান জানান। জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের সপ্তাহব্যাপী অধিবেশনের আগে বিশ্বনেতাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে প্যারিস চুক্তি কঠোরভাবে বাস্তবায়নে তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস নিউ ইয়র্কে যৌথভাবে এ বৈঠকের আয়োজন করেন।
শেখ হাসিনা উন্নত দেশগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেন, বিশ্বব্যাপী গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনে সামান্য অবদান রাখা সত্ত্বেও বাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য দেশের ভয়ঙ্কর শিকারে পরিণত হয়েছে। তিনি পৃথিবীকে রক্ষায় বর্ধিত তহবিল নিয়ে জলবায়ু জনিত সমস্যা সমাধানের জন্যে নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান।

 


আরো সংবাদ



premium cement