১৯ মে ২০২৪, ০৫ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলকদ ১৪৪৫
`


গ্রাহকের টাকায় সম্পদের পাহাড় রাসেল দম্পতির

ইভ্যালির সিইও-চেয়ারম্যান রিমান্ডে
ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও এমডির রিমান্ড মঞ্জুরের পর নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ: নয়া দিগন্ত -

আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি ব্রান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে গ্রাহকদের অস্বাভাবিক সব অফার দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে হাতিয়ে নিয়েছে বিশাল অঙ্কের টাকা। গ্রাহকের টাকায় সম্পদের পাহাড় গড়েছেন রাসেল দম্পতি। নতুন গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পুরনো গ্রাহকদের অল্প অল্প পণ্য ফেরত দিত দেশের আলোচিত অনলাইনে পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি। গ্রাহকদের টাকা দিয়ে গ্রাহকদের পণ্য ডেলিভারি করার ফাঁদে ইভ্যালির দায়ও বেড়েছে আকাশচুম্বী। দুই লাখের বেশি গ্রাহক, বিভিন্ন মার্চেন্ট ও ডিলারদের কাছে এই দায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। কোথায় আছে এই টাকা, এই প্রশ্নই এখন সর্বত্র। ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো: রাসেল এই এক হাজার কোটি টাকার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এমনকি অতীতে ইভ্যালির পক্ষ থেকে যে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব দেখানো হয়েছে সেখানেও সেই সম্পদের সঠিক কোনো হিসাব নেই। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইভ্যালির দায়ের বিপরীতে তাদের চলতি সম্পদ রয়েছে ৯০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর সম্পত্তি, স্থাপনা ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে রয়েছে ১৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। ইভ্যালির বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ টাকা রয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি গেটওয়েতে ৩০-৩৫ কোটি টাকা আটকা রয়েছে। কোম্পানির প্রায় ২৫-৩০টি যানবাহন রয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে সাভারে রাসেলের ৭-৮ কোটি টাকা মূল্যের জায়গা-জমিসহ অন্যান্য সম্পদ রয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ইভেন্টে স্পন্সর করা, নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠা, প্রচার প্রচারণা ও লোভনীয় অফার অনুসারে গ্রাহকদের কাছে পণ্য ডেলিভারী করেও মোটা অঙ্কের দায় বাড়িয়েছে ইভ্যালি।
লাভজনক প্রতিষ্ঠান না হলেও ইভ্যালি গ্রাহকদের এই টাকা দিয়েই প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের ব্যয় করত। রাসেল ও তার স্ত্রী পদাধিকার বলে নিজেরা মাসিক পাঁচ লাখ টাকা করে ১০ লাখ টাকা বেতন নিতেন। প্রতি মাসে দুই হাজার স্থায়ী স্টাফ ও ১৭০০ অস্থায়ী স্টাফকে বেতন দিতে ব্যয় করা হতো ৫ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যবসায় মন্দা থাকায় ১৩০০ স্টাফকে মাসে দেয়া হতো দেড় কোটি টাকারও বেশি। তারা স্বামী স্ত্রী কোম্পানির টাকায় ব্যক্তিগত দু’টি দামী গাড়ি (রেঞ্চ রোভার ও অডি) কিনেছিলেন। ভাড়াকৃত স্পেসে ধানমন্ডিতে প্রধান কার্যালয় এবং কাস্টমার কেয়ার স্থাপিত হয়। একইভাবে ভাড়াকৃত স্পেসে আমিনবাজার ও সাভারে দু’টি ওয়ার হাউজ চালু করা হয়। এ ছাড়া ইভ্যালির এই এক হাজার কোটি টাকার কোনো সঠিক হিসাব পাওয়া না গেলেও তাদের কাছে যে চলতি সম্পদ রয়েছে সেগুলো দিয়ে মাত্র ১৬ শতাংশ গ্রাহকের দায়মুক্তি সম্ভব বলে জানা গেছে।
এ দিকে দায় বাড়তে বাড়তে ইভ্যালি খাদের কিনারায় পৌঁছে যাওয়ায়, বিদেশী কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা দেশের বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে দায়সহ বিক্রি করার পরিকল্পনা ছিল রাসেলের। এ পরিকল্পনামাফিক বিভিন্ন দেশও ভ্রমণ করেন এমডি রাসেল। শুধু বিক্রি নয়, দায়মুক্তির জন্য বিভিন্ন ছক কষেছিলেন তিনি। কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে ইভ্যালি বিক্রি করতে না পারলে দেউলিয়া ঘোষণার পরিকল্পনাও করেছিলেন তিনি। এমনকি প্রতিষ্ঠানের তিন বছর পূর্ণ হলে, শেয়ারবাজারে অন্তর্ভুক্তির অপকৌশল করেছিলেন। এ জন্য মাঝেমধ্যে ফেসবুক লাইভে এসে গ্রাহকদের ধৈর্য ধরতে বলতেন।
এখানেই শেষ নয়, দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির কাছে কোম্পানি শেয়ারের বিক্রির অফার দিয়ে প্রলুব্ধ করে দায় চাপানোও ছিল পরিকল্পনার অংশ। গতকাল শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর কুর্মিটোলায় র্যাব সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব পরিকল্পনার তথ্য জানান। ব্যবসায়িক অপকৌশল হিসেবে নতুন গ্রাহকদের ওপর দায় চাপিয়ে পুরনো গ্রাহকদের আংশিক টাকা ফেরত অথবা পণ্য ফেরত দেয়া হতো জানিয়ে র্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন বলেন, ইভ্যালির দায়ের সর্বমোট পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার বেশি। গ্রাহকের সংখ্যা ৪৪ লাখ। কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে লোকসানি কোম্পানি, কোনো ব্যবসায়িক লাভ করতে পারেনি। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার রাসেল জানিয়েছে, ইভ্যালি ছাড়াও তার আরো কয়েকটি ব্যবসায়িক প্লাটফর্ম রয়েছে। এর মধ্যে ই-ফুড, ই-খাতা, ই-বাজার ইত্যাদি দিয়েই ইভ্যালির ব্যবসায়িক কাঠামো শুরু হয়েছিল। তার ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি ছিল তৈরিকারক ও গ্রাহক চেইন বা নেটওয়ার্ক থেকে বিপুল টাকা তুলে নেয়া।
র্যাব জানায়, গত ফেব্রুয়ারির পর থেকে ইভ্যালি কাউকে পণ্য দিতে পারেনি। গ্রাহকরা যখন দীর্ঘ দিন ধরে পণ্য পাচ্ছিল না, তখন রাসেল টি১০, টি৭, টি৫ অফার চালু করেন। এই অফারগুলোর মাধ্যমে টুথপেস্ট, টুথব্রাশের মতো সাধারণ পণ্য দিচ্ছিলেন তিনি।
ইভ্যালি দম্পতি রিমান্ডে : অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে গুলশান থানায় এক ভুক্তভোগী গ্রাহকের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার রাসেল ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল শুক্রবার দুপুরে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আতিকুল ইসলামের আদালতে তাদের হাজির করা হয়। এরপর গুলশান থানায় প্রতারণার অভিযোগে করা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ওয়াহিদুল ইসলাম।
অপর দিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী মনিরুজ্জামান লিটন তাদের রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম আসামিদের বিরুদ্ধে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ দিন বেলা ২টার দিকে তাদের আদালতে হাজির করে আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। দুপুর আড়াইটার দিকে আসামিদের তোলা হয় আদালতে। এর আগে বেলা ১টায় র্যাব সদর দফতর থেকে রাসেল দম্পতিকে র্যাবের সাদা প্রাইভেটকারে করে গুলশান থানায় আনা হয়। সেখান থেকেই পরে নেয়া হয় আদালতে।
রিমান্ড আবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, আসামিরা সঙ্ঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের লিডার এবং অত্যন্ত ধুরন্ধর ও কৌশলী। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা একেক সময় একেক রকম কথাবার্তা বলেন। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর কৌশলে এড়িয়ে যান।
অফিস বন্ধ হলেও সচল অ্যাপস : ইভ্যালির এমডি রাসেল ও তার স্ত্রী গ্রেফতারের পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ধানমন্ডির প্রধান কার্যালয়। গতকাল সকালে ধানমন্ডিতে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, শাটার খুলে প্রবেশ ও বের হচ্ছেন ভবনটির অন্য বাসিন্দারা। ভবনটির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা জাহাঙ্গীর বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেলের পর থেকেই অফিস ছাড়েন ইভ্যালির কর্মীরা। গতকাল কেউ অফিসে আসেননি। ইভ্যালির পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগও করেননি। সকাল ৯টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত অবস্থানকালে ইভ্যালি কার্যালয়ের সামনে কোনো গ্রাহককে দেখা যায়নি।
এ দিকে ইভ্যালির কার্যালয় বন্ধ থাকলেও সচল আছে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ। এখনো ইভ্যালি অ্যাপস ওপেন করলে কম দামে পণ্য কেনার অফার দেখা যাচ্ছে। আগের মতোই বিভিন্ন ব্রান্ডের মোটরসাইকেল, টেলিভিশন ফ্রিজসহ বিভিন্ন পণ্য দেখা যাচ্ছে ইভ্যালি অ্যাপস ওপেন করলেই। ইভ্যালির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে বৃহস্পতিবার রাতে এক পোস্টে জানানো হয়েছে, ঘাটতি মেটাতে বিনিয়োগ পাওয়ার চেষ্টা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
ভুক্তভোগী গ্রাহক ও কর্মীদের মানববন্ধন : ইভ্যালির এমডি রাসেলের মুক্তির দাবিতে শাহবাগে মানববন্ধন করেছে ইভ্যালির গ্রাহক, পাইকারি বিক্রেতা ও কর্মীরা। গতকাল বেলা ৩টার দিকে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে জড়ো হতে শুরু করেন তারা। এরপর সোয়া ৩টার দিকে ব্যানার নিয়ে শাহবাগ মোড়ে মানববন্ধন করেন। তাদের দাবি, রাসেলকে আটক রেখে এর কোনো সমাধান হবে না। বরং তাকে সুযোগ দেয়া হোক।
মানববন্ধনে ইভ্যালির গ্রাহকরা রাসেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন। এ সময় তাদের হাতে সেইভ ইভ্যালি, সেইভ ই-কমার্স, আই সাপোর্ট ইভ্যালি, সেইভ রাসেল ইত্যাদি প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। তারা এক দফা এক দাবি, রাসেল ভাইয়ের মুক্তি চাই; বাংলাদেশের ই-কমার্স ধ্বংস হতে দেবো না; ষড়যন্ত্রের কালো হাত, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন। এর আগে, রাসেল ও তার স্ত্রী গ্রেফতারের সময় তাদের মোহাম্মদপুরের বাসার সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন শতাধিক ভুক্তভোগী গ্রাহক।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার বিকেলে মোহাম্মদপুরের নিলয় কমপ্রিহেনসিভ হোল্ডিংয়ের বাসায় (হাউজ ৫/৫এ, স্যার সৈয়দ রোড) অভিযান চালিয়ে ইভ্যালির সিইও মো: রাসেল এবং তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনকে গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এর আগে গত বুধবার রাতে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে মো: রাসেল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা (নম্বর-১৯) দায়ের করেন আরিফ বাকের নামে ইভ্যালির একজন গ্রাহক।


আরো সংবাদ



premium cement
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ভিক্ষুক, মোট সম্পত্তি ৭.৫ কোটি ভারতের কোভ্যাক্সিনেও রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইসরাইল সরকারে ভয়াবহ দ্বন্দ্ব : নেতানিয়াহুকে গাঞ্জের পদত্যাগের আলটিমেটাম রাফায় ইসরাইলি হামলা, সরে যেতে বাধ্য হয়েছে ৮ লাখ ফিলিস্তিনি চেন্নাইকে বিদায় করে বেঙ্গালুরুর ‘অবিশ্বাস্য’ প্লে অফ মনের মিনার ভেঙে পড়েনি মার্কিন প্রশাসনের ‘বাকস্বাধীনতা’র মুখোশ শিগগিরই মাগুরায় রেললাইন চালু হবে : রেলমন্ত্রী সংসদ ভবনের সামনে স্বেচ্ছাসেবক লীগের ২ গ্রুপের সংঘর্ষে ছাত্রলীগকর্মী নিহত জুজুৎসুর সম্পাদকের যৌন নিপীড়নের তথ্য দিলো র্যা ব পানচাষীদের পরিশ্রমের ফসল জিআই স্বীকৃতি : প্রতিমন্ত্রী

সকল