৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


জলাবদ্ধতা আর যানজটে ভোগান্তি

-

মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে রাজধানীসহ সারা দেশে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরেই এ বৃষ্টিপাত হচ্ছে। গতকাল বুধবার দুপুরের পর রাজধানীতে মুষলধারায় বৃষ্টিপাত হয়। এতে অনেক সড়কে পানি জমে যায়। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে কোনো সড়কে গণপরিবহন সঙ্কট আবার কোনো সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় নগরবাসীকে।
বাস-অযোগ্য শহরের তালিকায় বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ঢাকা। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০২১ সালের বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার নাম রয়েছে ১৩৭ নম্বরে। অর্থাৎ, বাস-অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা চতুর্থ। বসবাসের অযোগ্যতার অন্যতম কারণ অবকাঠামোগত দুর্বলতা। ঢাকার দুই মেয়র বিভিন্ন সময় রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু সে তুলনায় এখনো উপকার পায়নি নগরবাসী। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, অপরিকল্পিতভাবে ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে, বর্ষা মৌসুমে যে বৃষ্টি হয় তা ধারণ করার ক্ষমতা ঢাকা শহরের নেই। যে কারণে বৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে জলাবদ্ধতা হতে থাকে।
মৌসুমি বায়ুর কারণে রাজধানীতে গত কয়েক দিন ধরেই বৃষ্টিপাত হচ্ছে। গতকালও দুপুরে বেশ জোরেশোরে বৃষ্টিপাত হয়। আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ মো: ওমর ফারুক বলেন, দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীতে বৃষ্টি শুরু হয়। কিছুক্ষণ বৃষ্টি হওয়ার পর তা আবার থেমে যায়। তবে একেবারেই বৃষ্টি থেমে যাবে এমন নয়। বৃষ্টি আবার শুরু হতে পারে। এ সময় তিনি আগামী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানিয়ে বলেন, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অনেক জায়গায় এবং ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে।
দুপুরের বৃষ্টির কারণে মুগদা হাসপাতালের সামনে রাস্তায় প্রায় হাঁটু সমান পানি জমে যায়। একইভাবে মিরপুরের বিভিন্ন সড়কসহ রাজধানীর অনেক সড়কে পানি জমে যায়। বৃষ্টির সময় এবং বৃষ্টি থামার পর রাজধানীর গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, জিরো পয়েন্ট, পল্টন, প্রেস ক্লাব, দৈনিক বাংলা, বিজয় নগর, কাকরাইল, শান্তিনগর ও মালিবাগের আশপাশের সড়কে যানজট দেখা গেছে। গুলিস্তান থেকে রামপুরা যেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর বাসে উঠেছেন ইসতিয়াক হোসেন। তিনি বলেন, বৃষ্টিতে গুলিস্তানের কিছু কিছু জায়গায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। সেই পানি পেরিয়ে বাসে ওঠার চেষ্টা করলাম, পারলাম না। দুই সিটে একজন যাত্রী নেয়ায় আগে থেকেই বাস পরিপূর্ণ। তাই মাঝপথ থেকে যাত্রীরা বাসে উঠতে পারছেন না। তিনি বলেন, গুলিস্তান থেকে বিজয়নগর আসতেই দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে। বৃষ্টির পর একদিকে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি, অন্যদিকে যানজটের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ভিক্টর ক্লাসিক বাসের চালক সাজেদুর রহমান বলেন, বৃষ্টিতে মানুষ বিভিন্ন জায়গায় আটকে ছিল। বৃষ্টি শেষ হওয়া মাত্রই সবাই রাস্তায় এসেছেন। তাই বৃষ্টির পর সড়কে যাত্রীর চাপ এবং যানজট দুটোই বেড়েছে। এছাড়া রাস্তায় পানি জমে থাকলে যানজট এমনিতেই সৃষ্টি হয়। গুলিস্তানে বাসের জন্য অপেক্ষা করা সিরাজুল ইসলাম নামের আরেক যাত্রী বলেন, সড়কে পানি জমে আছে। এর মধ্যে আবার শত শত যাত্রী বাসের অপেক্ষায় আছে। অনেকেই বাসে উঠতে পারছেন না। বৃষ্টি হলেই আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের ভোগান্তি পোহাতে হয়।
বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময়ও নগরবাসীকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। রাজধানীর কিছু কিছু সড়কে দেখা দেয় তীব্র যানজট। আবার কোনো কোনো সড়কে বাসই ছিল না। একদিকে যানজট, অন্যদিকে গণপরিবহন সঙ্কটে নাকাল হতে হয় ঘরমুখী মানুষকে। এর সাথে যুক্ত হয় মাথার ওপর গুঁড়ি বৃষ্টি। আটকে পড়া অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও বাসে উঠতে পারছিলেন না। সব ধরনের অফিস-আদালত খোলা থাকা সত্ত্বেও গণপরিবহনগুলোতে অর্ধেক যাত্রী নেয়ার সরকারি নির্দেশনা থাকায় কর্মমুখী মানুষের ভোগান্তি আরো বেড়ে যায়। বিকেলের পর সড়কে বেশির ভাগ বাসের দরজাই ছিল বন্ধ, মাঝপথে যাত্রী তুলছিল না কোনো বাস। ফলে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ে। বাধ্য হয়েই কেউ রিকশায়, কেউবা হেঁটেই বাসার দিকে রওনা হন।
সরেজমিন ঘুরে রাজধানীর আসাদগেট, ধানমন্ডি-২৭, ধানমন্ডি-৩২, পান্থপথ সিগন্যাল, কাওরানবাজার, বাংলামোটর, মালিবাগ, মৌচাক, তেজগাঁও, কাকরাইল, শান্তিনগর, পল্টন, গুলিস্তান ও মতিঝিল এলাকায় তীব্র থেকে তীব্রতর যানজটের দেখা মিলেছে। রাজধানীর কাওরানবাজার থেকে গাবতলী যাওয়ার জন্য গণপরিবহনে উঠতে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন শরিফ আহমেদ নামে এক বেসরকারি চাকরিজীবী। তিনি বলেন, দুই সিটে একজন করে যাত্রী নিয়ে পূর্ণ অবস্থায় গেট বন্ধ রেখে বাসগুলো আসছে। তাই কোনো বাসেই উঠতে পারছি না। এদিকে রাস্তায় এক ধরনের যানজট সৃষ্টি হয়েছে। শত শত মানুষ বৃষ্টিতে ভিজছেন, কিন্তু বাসে উঠা যাচ্ছে না। শাহবাগ মোড় থেকে মিরপুর-১০ নম্বরের বাসে ওঠার চেষ্টা করছিলেন আরিফুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, কেউ বাসে উঠতে পারছেন না। কারণ সব বাসের গেট বন্ধ, মাঝপথে কোনো যাত্রী তারা তুলছে না। এ অবস্থায় যাত্রীদের ভোগান্তির শেষ নেই। এদিকে, রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে বাড্ডা পর্যন্ত লম্বা যানজট দেখা গেছে। দীর্ঘ যানজট ছিল মহাখালী থেকে বনানী সড়কেও। আবার, মহাখালী ফ্লাইওভার পার হয়ে জাহাঙ্গীর গেট থেকে বিজয় সরণি সিগন্যাল পর্যন্ত ছিল যানবাহনের দীর্ঘ সারি। এদিকে, মগবাজার, উত্তরা, মিরপুরসহ বেশকিছু এলাকার রাস্তায় ছিল না পর্যাপ্ত গণপরিবহন।
সিএনজি অটোরিকশা-রাইড শেয়ারিংয়ে অতিরিক্ত ভাড়া : গণপরিবহন সঙ্কটের সুযোগে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা ও রাইড শেয়ারিংয়ের বাইকগুলোকে বেশি ভাড়া হাঁকতে দেখা গেছে। বাড্ডা লিংক রোড থেকে মুগদাগামী এক ব্যক্তি বলেন, অনেকক্ষণ ধরে সিএনজির জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু সড়কে খুব বেশি সিএনজি নেই। যেগুলো আসছে, সেগুলো অনেক বেশি ভাড়া চাচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণের মেয়র : গতকাল সাপ্তাহিক পরিদর্শন কাজে বের হন ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। এ সময় তিনি জলাবদ্ধতা নিরসনে কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হাতে নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের স্বল্পমেয়াদি কাজ হলো, স্তূপ আকারে যে বর্জ্য ছিল সেগুলো পরিষ্কার করা; যাতে করে পানি নিষ্কাশন ও পানি প্রবাহের সুযোগটা হয়। মধ্যমেয়াদি আমরা কিছু কার্যক্রম নিয়েছি, সেটা হলো, যেখানে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন, নর্দমাগুলোকে সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন, আধারের জায়গাটা সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন, সেসব জায়গুলোতে অবকাঠানো উন্নয়ন করা। এরই মাঝে আমরা দরপত্র সম্পন্ন করেছি, আমাদের কাজ চলছে। প্রায় ১০৩ কোটি টাকার অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম আমরা হাতে নিয়েছি। পরবর্তীতে হবে দীর্ঘমেয়াদি। আমরা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছি। সেটার আওতায় আমরা দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। সেটা হবে অত্যন্ত পরিকল্পিত। কারণ আমরা লক্ষ্য করি, অপরিকল্পিতভাবে যে ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে, বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি হয় তা ধারণ করার ক্ষমতা ঢাকা শহরের নেই। যে কারণে বৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে জলাবদ্ধতা হতে থাকে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান কার্যক্রমকে স্বল্পমেয়াদি উল্লেখ করে মেয়র আরো বলেন, আমাদের এখন যে কার্যক্রম চলছে সেটা স্বল্পমেয়াদি। বর্তমানে যে ধারণক্ষমতা আছে, যে অব্কাঠামো আছে, সেখানে যেন অন্ততপক্ষে পানি যেতে পারে, নিষ্কাশন হতে পারে এবং পরবর্তীতে নদীতে প্রবাহিত হতে পারে। আমরা এই পর্যন্ত যতটুকু করেছি, তাতে কিছু সুফল আমরা পাচ্ছি। কিন্তু তার সাথে সাথে মধ্য মেয়াদি কার্যক্রমে আমাদেরকে সফল হতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রমে আমাদেরকে হাত দিতে হবে।
ব্যারিস্টার তাপস বলেন, আমরা যে পরিকল্পনা নিয়েছি তাতে অল্প বৃষ্টি হলে এক ঘণ্টার মধ্যে, মাঝারি বৃষ্টি হলে দুই ঘণ্টার মধ্যে এবং অতিভারী বৃষ্টি হলেও তিন ঘণ্টার মধ্যে পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।


আরো সংবাদ



premium cement