২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সিপিডির জরিপ

করোনায় বেকার ৬২ ভাগ মানুষ

৫২ ভাগ আধপেটা ; প্রবৃদ্ধির তথ্য-উপাত্ত ঠিক নেই
-

করোনার সময় দেশের ৬২ শতাংশ মানুষ কোনো-না-কোনোভাবে কাজ হারিয়েছেন। ৭৮ শতাংশ মানুষ কম খরচ করেছেন এবং ৫২ শতাংশ মানুষ খাবার খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। এ সময় বেশি কাজ হারিয়েছেন সেবা খাতের মানুষ। তারা পেশা পাল্টে সেবা থেকে কৃষিকাজে নিয়োজিত হয়েছেন। যদিও তাদের অন্তত ৯০ শতাংশই আত্মনিয়োজিত, পরিবারকে সাহায্য এবং দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজে যুক্ত হয়েছেন। কৃষি খাতে এখন এক কোটি উদ্বৃত্ত জনশক্তি রয়েছে। এ সময় বেশির ভাগপরিবার খাবার খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি আসক্তিতে ভোগার কোনো যুক্তি নেই। কারণ এখানে প্রবৃদ্ধির তথ্য-উপাত্তই ঠিক নেই। সেখানে প্রবৃদ্ধি খুঁজতে যাওয়া মানে অন্ধকারে কালো বিড়াল খোঁজা।
‘কোভিডকালে আয় ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতি : কিভাবে মানুষগুলো টিকে আছে’ শীর্ষক খানা জরিপের ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সংলাপে এ তথ্য উঠে আসে। দুই হাজার ৬০০ খানার ওপর গত জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত জরিপটি করা হয়। সঙ্গত কারণেই কোভিডের দ্বিতীয় ধাক্কার কোনো চিত্র উঠে আসেনি এতে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও অক্সফাম ইন বাংলাদেশ যৌথভাবে জরিপটি করেছে। আর্থিক সহায়তায় ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। জরিপের ফলাফলের ওপর গতকাল বুধবার অনলাইনে সংলাপের আয়োজন করে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।
প্রতিষ্ঠানটির জরিপে উঠে এসেছে কাজ হারানো বেশির ভাগ মানুষই নতুন করে কর্মসংস্থানে ফিরে এসেছেন। কিন্তু এরপরও আয় কমে গেছে। সেই সাথে কমেছে কর্মঘণ্টা। আয় কমে যাওয়ায় ৫২ শতাংশ মানুষ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। আবার অনেকের ঋণ বেড়েছে। কেউ কেউ সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছেন। জরিপে জানা গেছে, কোভিডের কারণে ৭৮ শতাংশ মানুষই কম খরচ করেছেন। অন্তত ৫ শতাংশকে সম্পদ বিক্রি করতে হয়েছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান প্রশ্ন তোলেন, সরকার কি এ ধরনের জরিপের ফলাফল শুনছে? নাকি নিজেদের মতো করেই বা নিজেরা যা ভাবছে, সেভাবেই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে? সাবেক তত্ত্বাবধায় সরকারের উপদেষ্টা ও স্কয়ার গ্রুপের কর্ণধার তপন চৌধুরী বলেন, কোভিডের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। এদের দিকে এখন বেশি নজর দিতে হবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘কোভিডের কারণে মানুষ খাওয়া কমিয়েছে। নব্য গরিব হয়েছেন অনেকে। বৈষম্য বাড়ছে। কোভিডের অভিঘাত সবচেয়ে বেশি পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। অথচ আমরা প্রবৃদ্ধি-আসক্তিতে ভুগছি। তথ্য-উপাত্তই যেখানে নেই, সেখানে প্রবৃদ্ধি খুঁজতে যাওয়া মানে অন্ধকারে কালো বিড়াল খোঁজা।’
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) শ্রম খাতবিষয়ক সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা অতিমাত্রায় প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকি দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম হয়েছি কি না। অথচ প্রবৃদ্ধির ফল মুষ্টিমেয় লোক ভোগ করছে।’ রিজওয়ানুল ইসলামের প্রশ্ন, ‘প্রবৃদ্ধি অবশ্যই চাই। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি কি অন্তর্ভুক্তিমূলক? এ দিয়ে বেকারত্বের হার কতটা কমাতে পেরেছি? দারিদ্র্যের হার কতটা নামিয়ে আনতে পেরেছি? বৈষম্য কমাতে কী করেছি?’
এ দিকে জরিপের তথ্য তুলে ধরে তৌফিক বলেন, ‘৬২ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তারা কখনো-না-কখনো কর্ম হারিয়েছেন। তবে সবাই একই সময়ে হারাননি। বেশির ভাগ মানুষ গত বছরের এপ্রিল-মে মাসে কাজ হারিয়েছেন, যখন সাধারণ ছুটি বা লকডাউন চলছিল।’ তিনি জানান, যারা চাকরি হারিয়েছেন, তাদের প্রায় ৮৫ শতাংশ এক মাসের বেশি সময় কর্মহীন ছিলেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছেÑ আমরা যখন জরিপ করি তখন প্রায় সবাই চাকরি ফেরত পেয়েছেন। সে হিসাবে কর্মসংস্থানের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে।’
নতুন কর্মসংস্থানের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা দেখতে পেয়েছি, এ কর্মসংস্থানটা এসেছে মূলত কৃষি খাত থেকে। কৃষি খাতে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। সেই তুলনায় আমাদের সেবা খাত যেটা কর্মসংস্থানের সব থেকে বড় জায়গা, সেখানে আমরা দেখছি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রায় দেড় শতাংশের মতো কমে গেছে। শিল্প খাতে কর্মসংস্থান প্রায় ৪ শতাংশ বেড়েছে।’
জরিপের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি কর্মসংস্থান সেবা খাত থেকে কৃষি খাতের দিকে গেছে। ফলে আমরা যে ধরনের কাঠামোগত রূপান্তরের কথা বলি, সেই রূপান্তর যতটা আধুনিক খাতে হওয়ার কথা ছিল, সেটি পেছনের দিকে চলে গেছে।’
রিসার্চ ফেলো তৌফিক আরো বলেন, ‘আমরা দেখেছি এই যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলো তার প্রায় ৯০ শতাংশ হয় স্ব-নিয়োজিত খাতে গেছেন অথবা তাদের পরিবারকে সহযোগিতা করছেন। অথবা দৈনিক শ্রমিকের কাজ করছেন। ফলে যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, তা মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে হয়েছে।’
জরিপে কর্মঘণ্টার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি দৈনিক প্রায় ৪ শতাংশের মতো কর্মঘণ্টা কমেছে। সব থেকে বেশি কর্মসংস্থান যে কৃষি খাত দিয়েছে, সেখানে কর্মঘণ্টা কমে গেছে। এতে আমরা বুঝতে পারছি আগে যেখানে কমসংখ্যক শ্রমিক দিয়ে কৃষিক্ষেত্রে কাজ করা যেত, সেখানে এখন অধিক হারে শ্রমিক যুক্ত হচ্ছে।’
কাজ হারানোরা নতুন কর্মসংস্থানে ফিরলেও আয় কমে গেছে বলে সিপিডির জরিপে উঠে এসেছে। এ বিষয়ে তৌফিক বলেন, ‘কর্মসংস্থান ফিরলেও আমরা জরিপে দেখেছি প্রায় ৪৫ শতাংশ পরিবার জানিয়েছেÑ আগে তাদের যে আয় ছিল, এখন তার থেকে কম আয় হচ্ছে। আয় কমার এই হার গড়ে ১২ শতাংশের মতো। এর মধ্যে সব থেকে বেশি কমেছে কৃষি খাতে। প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ আয় কমেছে কৃষি খাতে। একই সাথে উৎপাদন খাতেও সাড়ে ১২ শতাংশের ওপরে আয় কমেছে।’ তিনি বলেন, ‘আয় কমার চিত্র আমরা বয়সভেদেও দেখেছি। সেখানে আমরা দেখেছি সব বয়সের কর্মীদের আয় কমেছে। ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের আয় বেশি কমেছে। তাদের আয় কমেছে ১৫ শতাংশের ওপর। ৩০-৪৯ বছর বয়সীদের আয় কমেছে ১০ শতাংশের ওপর।’
জরিপের তথ্য তুলে ধরে সিপিডির এই রিসার্চ ফেলো বলেন, ‘৪২-৪৩ শতাংশ জানিয়েছেন তাদের কর্মপরিস্থিতি আগের থেকে খারাপ। প্রায় ৮৬ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা আগের মতো যথেষ্ট আয় করছেন না। অর্থাৎ তারা যে ধরনের আয়ের প্রত্যাশা করেন, এখন তার থেকে কম আয় করছেন। সুতরাং তারা তাদের কাজের ক্ষেত্রে সন্তুষ্ট নয়।’ তিনি জানান, জরিপে উঠে এসেছে, নতুন যে কর্মসংস্থান হয়েছে তার মধ্যে বেশির ভাগ যুবক, যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। নতুন কর্মসংস্থান প্রায় ৬৫ শতাংশ এই বয়সীদের। ৩০-৬৪ বছরের বয়সীদেরও বড় অংশ নতুন কর্মসংস্থানে যুক্ত হয়েছে, এ ক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে ৩২ শতাংশের ওপরে। এদের বড় অংশ নারী। এই নারীদের অনেকে কৃষি খাতেও যুক্ত হয়েছেন।


আরো সংবাদ



premium cement