২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চলে গেলেন প্রবীণ আইনবিদ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক

-

প্রবীণ আইনবিদ ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর আদ্-দ্বীন হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
আদ্-দ্বীন হাসপাতালের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: নাহিদ ইয়াসমিন জানান, সকাল সাড়ে ৮টায় ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের মৃত্যু ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। তিনি বলেন, স্যারের একুয়েস্টামিক স্ট্রোক, সিভিয়ার ইউরিন ইনফেকশন ছিল। সর্বশেষ তিনি সেফটিক শক, মাল্টি অরগান ডিস ফাংশন সিনড্রোম অবস্থায় স্যার সাড়ে ৮টায় আমাদের আইসিইউতে মৃত্যুবরণ করেন।
সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে রফিক-উল হকের প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তার লাশ ৪৭/১ পুরানা পল্টনের বাসায় নেয়া হয়। বাদ জোহর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বেলা ২টায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি প্রাঙ্গণে তৃতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। নামাজে জানাজা শেষে তার লাশ বনানী কবরস্থানে বেলা ৩টায় স্ত্রীর কবরের পাশে দাফন করা হয়।
ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বিশাল অবদান রেখেছেন। তার মৃত্যুতে দেশ একজন অভিজ্ঞ আইনবিদকে হারাল। রাষ্ট্রপতি রফিক-উল হকের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান ।
শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সংবিধান সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।’ প্রধানমন্ত্রী একটি মিথ্যা মামলায় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে তাকে গ্রেফতার করার পর জেল থেকে মুক্তির জন্য আইনি লড়াইয়ে এগিয়ে আসায় ব্যারিস্টার রফিকের ভূমিকার কথা গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন।
শোক : তার মৃত্যুতে আরো শোক প্রকাশ করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি প্রবীণ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান, অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন, বাংলাদেশ জাতীয় আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট শাহ মো: খসরুজ্জামান, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ, বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল প্রমুখ। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি ও গণফোরাম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ, বাংলাদেশ ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের সভাপতি অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম এবং মুসলিম লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট বদরুদ্দোজা সুজা।
সুপ্রিম কোর্টে শেষ নামাজে জানাজা : দীর্ঘদিনের কর্মস্থল সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বেলা ২টা ১৫ মিনিটে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের তৃতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, রেলমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরুসহ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
নামাজে জানাজা শেষে লাশে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। এ সময় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের সাংবাদিকরা।
আদ্-দ্বীন হাসপাতালে চিকিৎসা : গত ২১ অক্টোবর বুধবার ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। গত ১৫ অক্টোবর শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে আদ্-দ্বীন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাকে হাসপাতালের ভিআইপি কেবিনে রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়। তিনি হাসপাতালে ডা: রিচমন্ড রোল্যান্ড গোমেজের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। ২০১৭ সালে বাম পায়ের হাঁটুতে অস্ত্রোপচারের পর থেকে তার চলাফেরা সীমিত হয়ে পড়ে।
বর্ণাঢ্য জীবন : ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বর্ণাঢ্য জীবনে আইন পেশায় প্রায় ৬০ বছর পার করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে হিন্দু আইনের ক্লাস নিয়েছেন। এ ছাড়া রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত, পাকিস্তান ও ব্রিটেনের নাগরিক হওয়ার বিরল সম্মান অর্জন করেছেন। ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার কারণে তিনি ইন্দিরা গান্ধী, নেহরু ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য পেয়েছেন।
রফিক-উল হকের স্ত্রী ডা: ফরিদা হক ২০১১ সালে ইন্তেকাল করেন। তার ছেলে ব্যারিস্টার ফাহিম-উল হক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২ নভেম্বর কলকাতার সুবর্ণপুর গ্রামে। ১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, ১৯৫৭ সালে দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ১৯৫৮ সালে এলএলবি পাস করেন। ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে বার এট ল’ সম্পন্ন করেন। ১৯৬৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে এবং ১৯৭৩ সালে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে আইন পেশা শুরু করেন তিনি। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাথে কাজ করেছেন। বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুই নেত্রী যখন কারাগারে তখন তাদের জন্য অকুতোভয়ে আইনি লড়াই করেন তিনি। একই সাথে দুই নেত্রীর সমালোচনা করতেও পিছপা হননি তিনি। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ভাবমর্যাদা রক্ষায় বরাবরই সোচ্চার ছিলেন রফিক-উল হক। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও আইনি বিষয় নিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন বর্ষীয়ান এই আইনজীবী। উচ্চ আদালতকে সহযোগিতা করতে অনেকবার হয়েছেন অ্যামিকাস কিউরি বা আদালতের বন্ধু। তার সান্নিধ্যে এসে আইন পেশায় সফল হয়েছেন অনেকে। ১৯৯০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রফিক-উল হক কিন্তু কোনো সম্মানী নেননি। পেশাগত জীবনে তিনি কখনো কোনো রাজনৈতিক দল করেননি তবে সঙ্কটকালে রাজনীতিবিদরা সবসময় তাকে পাশে পেয়েছেন।
উপার্জিত অর্থ ব্যয় করেছেন সমাজসেবায় : ব্যারিস্টার রফিক-উল হক জীবনের উপার্জিত অর্থ ব্যয় করেছেন সমাজসেবায়। যেখানে সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন মানবতার সেবায়। বলতে গেলে তেমন টাকাপয়সা রাখেননি ব্যাংকে। মানুষের সেবার লক্ষ্য নিয়েই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন বেশ কয়েকটি হাসপাতাল, এতিমখানা, মসজিদ ও মেডিক্যাল কলেজ।
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি ১০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন সুবর্ণ ক্লিনিক; ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা রাখেন তিনি। বারডেম হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ ও নূরজাহান ওয়ার্ড, আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালের চেয়ারম্যান, আদ্-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ছিলেন রফিক-উল হক। ২৫টিরও বেশি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি সরাসরি জড়িত। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে আর্থিক অনুদানসহ নানা সহযোগিতা দিয়ে গেছেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement