ইংল্যান্ডর দ্বিতীয় নাকি ক্রোয়েশিয়ার প্রথম। ১৯৬৬ সালের পর আজ কি পুনরায় ফাইনালের টিকিট পাবে ইংলিশরা? না কি ইতিহাস গড়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বফুটবলের সর্বোচ্চ আসরে নাম লেখাবে ক্রোটরা। ইংল্যান্ড সর্বশেষ ১৯৯০ সালের ইতালি বিশ্বকাপে সেমি ফাইনাল খেলেছিল। আর ক্রোয়েশিয়া ১৯৯৮ সালে। তবে লক্ষণীয় বিষয় ৯০-এ যখন ইংল্যান্ড সর্বশেষ সেমিফাইনাল খেলেছিল পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে তখন দলের বর্তমান স্কোয়াডের ২৩ ফুটবলারের ১৭ জনেরই জন্ম হয়নি। তাহলে বুঝুন কত নবীন ফুটবলারের উপস্থিতি রয়েছে কোচ গ্যারেথ সাউথগেটের দলে।
১৯৯০ সালের ৪ জুলাই ইংল্যান্ডের সেমি ফাইনাল ম্যাচ ছিল পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে। সে সময় দুনিয়ার আলোই দেখেননি রাশিয়ায় আসা ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ দলের ১৭ সদস্য। দলের আরেক সদস্য ড্যানি রসের জন্ম অবশ্য এর দুই দিন আগে। ১ জুলাই ক্যামেরুনের বিপক্ষে কোর্য়াটার ফাইনাল ম্যাচ খেলেছিল ইংল্যান্ড। এর পরের দিন দুনিয়াতে আসেন ড্যানি রস।
ক্রোয়েশিয়ান ফুটবলার ডুজে সেলেতা কারের বয়স আরো কম। ১৯৯৮ এর ৮ জুলাই ফ্রান্সের বিপক্ষে সর্বশেষ সেমি ফাইনাল ম্যাচ ছিল ক্রোয়েশিয়ার। ওই দিন ডুজে সেলেতার বয়স ছিল এক বছর নয় মাস। তিনি তাদের দলের সবচেয়ে কমবয়সী ফুটবলার।
এই কমবয়সী ইংলিশ ফুটবলারেরই একজন এরিখ ডিয়ের। ২৪ বছরের এই ফুটবলারের জন্ম ১৯৯৪ এর ১৫ জানুয়ারী। টটেনহ্যাম হটসপুরে খেলা এই ফুটবলারের মতে, ‘আমার মনে করিনা এখনই এমন কিছু অর্জন করে ফেলেছি। আমরা আরো কিছু পাওয়ার জন্য ক্ষুধার্ত। সেই সাফল্য নিয়েই হোটেলে এবং দেশে ফিরতে চাই।’ এই মিডফিল্ডার যোগ করেন, ‘আশা রাখি আমরা যে সাফল্যের ধারায় আছি তা অব্যাহত রাখতে পারবো। এতে কোনো ছাড় নয়। এছাড়া অন্য কিছু ভাবার সুযোগই নেই। বলেন, আমাদের সমস্ত মনযোগই এখন আজকে ক্রোয়েশিয়ার ম্যাচের দিকে।’ আরো জানান, এই আসরের আরো সামনে এগুতে হলে আজকের রাতটা ভালোভাবেই পার করতে হবে। আমরা প্রত্যেক ম্যাচই উপভোগ করেছি। এখন বাড়তি কিছুর জন্য আজ জিততে হবে।
এই ১৭ ফুটবলারই গত বছর অনূর্ধ্ব -২০ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে চ্যাম্পিয়ন করিয়েছে। গোলরক্ষক পিকফোর্ডও ১৯৯০ এর সেই সেমি ফাইনালের পর জন্ম নেয়া ফুটবলার। ইংলিশদের এই তারুন্য নির্ভর দলের প্রশংসা জার্মানীর ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ জয়ী ফুটবলার ইয়ুর্গ্যান ক্লিন্সম্যানের মুখেও। তার মতে, এই দলটির অধিকাংশেরই বয়স কাছাকাছি। গত বছর দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব -২০ বিশ্বকাপ দেখেছিলেন ক্লিন্সম্যান। কারণ তার ছেলে সেই আসরে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে। তার মতে, সুইডেনের বিপক্ষে যা খেলেছে ইংল্যান্ড আজ তেমনটা খেললেই চলবে। যদিও ক্রোয়েশিয়া সম্পূর্ন ভিন্ন দল।
এদিকে ক্রোয়েশিয়ান ডিফেন্ডার সিমে ভারসারজিকোর মতে, আজকের ম্যাচ ডেনমার্ক বা রাশিয়ার বিপক্ষে খেলা ম্যাচের চেয়ে কঠিন। ইংলিশরা বেশ সংঘঠিত। শারারীক ভাবে শক্তপোক্ত এবং মান সম্পন্ন একটি দল। তবে আমরাও পিছিয়ে নেই। আমাদেরও কোয়ালিটি ফুটবলারের সংখ্যা অনেক।
উল্লেখ করলেন, ইংল্যান্ড দলের দুর্বলতা আমাদের জানা। সেটাকে পুঁজি করেই ৯০ মিনিট বা ১২০ মিনিটে সুযোগ কাজে লাগাতে চাই। এজন্যইতো আমরা আজ সেমি ফাইনালে। আমরা রাশিয়ায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি। এবার ফাইনালে খেলার স্বপ্ন পূরণের পালা।
আরো পড়ুন :
অবশেষে ইংল্যান্ড ও ক্রোয়েশিয়ার সামনে ফাইনাল খেলার স্বপ্ন
বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে পিছনে ফেলে দীর্ঘ সময় পরে ইংল্যান্ড ও ক্রোয়েশিয়ার সামনে সুযোগ এসেছে স্বপ্নের ফাইনাল নিশ্চিত করার।
১৯৯০ সালে সর্বশেষ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলেছিল। কিন্তু পেনাল্টি শ্যুট আউটে তুরিনে জার্মানীর কাছে পরাজিত হয়ে বিদায় নেয়। আট বছর পরে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর প্রথমবার বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে ক্রোয়েশিয়া স্বাগতিক ফ্রান্সের কাছে সেমিফাইনালে পরাজয়ের স্বাদ পায়। ২৮ বছর আগে ইতালির ঐ বিশ্বকাপে গ্যারি লিনেকার, পল গ্যাসকোয়েনরা ইংল্যান্ডকে সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল। অন্যদিকে ম্যানেজার মিরোস্লাভ ব্লাজেভিচের অধীনে ক্রোয়েশিয়া যখন শেষ চারে পৌঁছায় তখন তা বেশ অপ্রত্যাশিতই ছিল।
রাশিয়ায় দুই দল যখন সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে তখন অতীত কোন স্মৃতি সামনে আনতে চাচ্ছেনা। যদিও ক্রোয়েশিয়ান খেলোয়াড়দের প্রতিনিয়ত ১৯৯৮’র প্রজন্মের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। কিন্তু মিডফিল্ডার ইভান রাকিটিচ বলেছেন, ‘১৯৯৮ সালে যা হয়েছিল আমরা তেমনভাবে নিজেদের ওপর কোন চাপ সৃষ্টি করতে চাচ্ছিনা। তারা যা করেছে তা দুর্দান্ত ছিল। কিন্তু আমরা নিজেদের ইতিহাস নিজেরাই রচনা করতে চাই। যা কিছু ইতিবাচক সেগুলোই আমরা উপভোগ করতে চাই।’
১৯৯০ সালে ইংল্যান্ডের পরাজয় এবং একইসাথে ১৯৬৬ সালের পরে ৫২ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন, এসবই এখন ইংল্যান্ডকে নতুন ভোরের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু ইংলিশ ডিফেন্ডার এ্যাশলে ইয়ং এসমস্ত অতীত পিছনে রেখেই এগুতে চান, ‘এই মুহূর্তে কি হচ্ছে আমরা এখন সেগুলো নিয়ে মনোযোগী হতে চাই, অতীতে কি হয়েছে তা নিয়ে নয়। আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছি।’
একইসাথে তিনি আরো বলেছেন সেমিফাইনালে লুকাস মড্রিচদের দিকে না তাকিয়ে নিজেদের যোগ্যতার দিকেই বেশী গুরুত্ব দেয়া উচিত। সুইডেনকে কোয়ার্টার ফাইনালে ২-০ গোলে পরাজিত করে শেষ চার নিশ্চিত করেছিল ইংল্যান্ড। ২০০৪ সালের ইউরোর গ্রুপ পর্বের পরে বড় কোন টুর্ণামেন্টে এই প্রথম ইংল্যান্ড ক্রোয়েশিয়ার মুখামুখি হচ্ছে। ঐ ম্যাচটিতে থ্রি লায়ন্সরা ৪-২ গোলে জয়ী হয়েছিল। এই নিয়ে চারবারের মোকাবেলায় দুই দলই দুটি করে ম্যাচ জিতেছে। তবে ২০০৭ সালে ইংল্যান্ডের ৩-২ গোলে পরাজিত হওয়াটা ছিল দারুন হতাশার। ঐ ম্যাচে পরাজিত হয়েই ইংল্যান্ড ২০০৮ ইউরো খেলতে ব্যর্থ হয়েছিল।
এ পর্যন্ত বিশ্বকাপের ম্যাচগুলোর নিরিখে মড্রিচকে রাশিয়া অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু ৩৩ বছর বয়সী ইয়ং বলেছেন মড্রিচকে আটকানোর জন্য ম্যাচের সব গুরুত্ব সেদিকেই রাখাটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তার চেয়ে বরং নিজেদের খেলার উপর মনোনিবেশ করতে হবে। ম্যাচ পূর্ববতী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘তারা কোন কারন ছাড়া সেমিফাইনালে খেলতে আসেনি। তাদের দলে মড্রিচের মত একজন অসাধারণ খেলোয়াড় রয়েছে। মোট কথা সব জায়গায় তারা দারুন খেলছে। সে কারনেই প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা অত্যন্ত কঠিন। আমাদের তাদের প্রতি বেশী মনোযোগী হলে চলবে না। নিজেদের খেলা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। ম্যাচে জয়ী হতে হলে আমরা আসলে কি করতে পারি।’
সেমিফাইনালে পথে ক্রোয়েশিয়া ডেনমার্ক ও স্বাগতিক রাশিয়ার বিপক্ষে দুটি পেনাল্টি শ্যুট আউট রক্ষা করেছে। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থান অর্জণ করার পরে এটাই তাদের সর্বোচ্চ সাফল্য। নক আউট ম্যাচগুলোতে ঐ ধরনের নার্ভাস পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার মানসিকতা সেমিফাইনালে কাজে আসবে বলে বিশ্বাস করেন রাকিটিচ। ১৯৮২ সালের পরে বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথমবারের মত দুটি ইউরোপীয়ান দেশকে হারানোর সুযোগ এখন ইংল্যান্ডের সামনে। বার্সেলোনা তারকা রাকিটিচ বলেছেন, আমাদের সেই শক্তি আছে। আমরা মাঠে বেশ সংঘবদ্ধ ভাবে খেলছি। সেমিফাইনালে পৌঁছানোয় আমরা বেশ গর্বিত ও খুশী। কিন্তু আমরা এখানেই থামতে চাইনা। ক্রোয়েশিয়ার মত একটি ছোট দেশের জন্য এটা দুর্দান্ত একটি ফল।
পেশীর ইনজুরি কাটিয়ে জর্ডান হেন্ডারসনের খেলা এখনো অনিশ্চিত। আর এটাই ইংল্যান্ডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। লুকা মড্রিচ, রাকিটিচদের নিয়ে সাজানো ক্রোয়েশিয়ার মধ্যমাঠকে সামলানোর জন্য গ্যারেথ সাউথগেটের তারুন্যনির্ভর দলে হেন্ডারসনের মত অভিজ্ঞদেরও প্রয়োজন রয়েছে।
এবারের বিশ্বকাপে এ পর্যন্ত ১১টি গোল করেছে ইংল্যান্ড। ১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপ জয়ী দলটিও পুরো বিশ্বকাপে ১১টি গোল করেছিল। ইংল্যান্ডের জয়ে ৬ গোল করে অধিনায়ক হ্যারি কেন বেশ ভালভাবেই গোল্ডেন বুট অর্জনের দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন। ইংলিশদের ১১টি গোলের মধ্যে আটটিই এসেছে সেট পিস থেকে।