গত কয়েক বছরের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে (ঢাবি) ১৩টি নতুন বিভাগ চালু করা হয়েছে। ফলে বেড়েছে শিক্ষার পরিসর। পাশাপাশি পুরনো কিছু বিভাগেও আসন বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে নতুন পুরনো বিভাগ মিলিয়ে বেড়েছে বিশ^বিদ্যালয়ের মোট আসন সংখ্যাও। তবে নতুন বিভাগ চালু এবং বছরান্তে আসন বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়ছে না অবকাঠামোগত এবং শিক্ষা উপকরণের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। বর্তমানে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়ে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অপ্রতুল ব্যবস্থাপনার সাথে সাথে অপরিকল্পিতভাবে শিক্ষা পরিসর বৃদ্ধির ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার গুণগতমান ব্যাহত হচ্ছে বলে অভিমত শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের। শিক্ষার পরিসর বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতিও গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৮-১৯ এই পাঁচ শিক্ষাবর্ষে মোট আসন বেড়েছে ৭২৫টি। চলতি ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে গতবারের চেয়েও ২০টি আসন বৃদ্ধি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর আগে গত চার শিক্ষাবর্ষে বেড়েছে ৭০৫ আসন। সব মিলিয়ে গত পাঁচ শিক্ষাবর্ষে আসন বেড়েছে মোট ৭২৫টি। এর মধ্যে সর্বাধিক ২৮৩টি আসন বেড়েছে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে। আর সর্বনিম্ন ২০টি আসন বেড়েছে এবার। এর মধ্যে প্রতি বছর গড়ে ১৪৫টি আসন বেড়েছে।
প্রশাসনিক ভবনের সূত্র মতে, ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ছয় হাজার ৪৩৩টি আসন ছিল। পরবর্তীতে ১৪৯টি আসন বৃদ্ধি করে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে তা ছয় হাজার ৫৮২ তে। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ৭৩টি আসন বৃদ্ধি করায় ছয় হাজার ৬৫৫, ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ১৪৮ আসন বৃদ্ধিতে ছয় হাজার ৮০০ এবং সর্বশেষ ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে মোট আসন সংখ্যা দেখানো হয়েছে সাত হাজার ৮৩টি। এ বছর ২৮৩টি আসন বেড়েছে। উল্লেখ্য ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ১৪৮টি আসনের হিসাব পাওয়া গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক ভবন সূত্রে ২০০ আসন বৃদ্ধির কথা জানা যায়।
অন্যদিকে, ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তির দিক থেকে নতুন বিভাগ বেড়েছে ১৩টি। এগুলো হলো নৃত্যকলা, ফলিত গণিত, ফার্মাসি, রোবোটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, ইংলিশ ফর স্পিকার অব আদার ল্যাংগুয়েজেস (ইএসওএল), ফ্রেন্স ল্যাংগুয়েজ অ্যান্ড কালচার (এফএলসি), চাইনিজ ল্যংগুয়েজ অ্যান্ড কালচার (সিএলসি), যোগাযোগ বৈকল্য, অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ, আবহাওয়া বিজ্ঞান, হেলথ সায়েন্স, জাপানিজ ল্যাংগুয়েজ অ্যান্ড কালচার (জেএলসি), মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিভাগ। এ ছাড়া খোলার অপেক্ষায় রয়েছে ভূমিবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
এদিকে শিক্ষার পরিসর বৃদ্ধি পেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে মান উন্নয়ন হচ্ছে না। আবার প্রতি বছরের বর্ধিতহারে শিক্ষার্থী ফেল করায় বিদ্যমান ব্যবস্থায় চাপ বাড়ছে। আবাসন, পরিবহন, শ্রেণিকক্ষ, গ্রন্থাগার ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানসম্মত সুবিধা পাচ্ছেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ফলে সার্বিকভাবে শিক্ষার গুণগতমান ব্যাহত হচ্ছে।
সর্বশেষ ২০১৩ সালে শিক্ষার্থীদের জন্য নির্মিত হয় বিজয় একাত্তর হল। ছাত্রীদের জন্য রোকেয়া হলে ৭ মার্চ ভবন তৈরি করা হয়েছে। কেবল গণিত ও ফলিত গণিত বিভাগদ্বয়ের জন্য একমাত্র অ্যাকাডেমিক ভবন (এ এফ মুজিবুর রহমান গণিত ভবন) তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া মোকাররম ভবন, সামাজিক বিজ্ঞান ভবন এবং কলাভবনের কিছু সংস্কার শেষ ও সম্প্রসারণের কাজ অব্যাহত থাকলেও মূলত নতুন কোনো অ্যাকাডেমিক ভবন বাড়েনি। এমনকি নতুন চালু হওয়া অনেক বিভাগে শিক্ষকসঙ্কট, শ্রেণিকক্ষ সঙ্কট এবং শিক্ষকদের নিজস্ব রুমের সঙ্কট রয়েছে। কোনো কোনো বিভাগে কারিকুলাম চূড়ান্তেও দেরি হচ্ছে। স্থান সঙ্কুলানের অভাবে অনেক বিভাগে শিক্ষার্থীদের জন্য কম্পিউটার ল্যাব, সেমিনার কক্ষ নেই।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন, শ্রেণিক্ষক সঙ্কট দিন দিন মারাত্মক আকার ধারণ করছে। নিজস্ব যানবাহনের অভাবে পর্যাপ্ত পরিবহন সুবিধা পাচ্ছেন না ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করা শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা দিয়ে আবাসন সঙ্কট নিরসন সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি হল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় হলগুলোতে আসন পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা। যে হারে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন সে হারে হল খালি না হওয়ায় আবাসন সঙ্কট নিরসন সম্ভব হচ্ছে না। দীর্ঘ দিনের পুরনো গ্রন্থাগারেও শিক্ষার্থীদের স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। গ্রন্থাগারে পাওয়া যাচ্ছে না শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় বই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি না করে অব্যাহত আসন ও বিভাগ বৃদ্ধির সমালোচনা করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, এ অব্যাহত প্রক্রিয়াকে আমি ক্যান্সারের সাথে তুলনা করি। ক্যান্সার যেমন ধীরে ধীরে শরীরের কর্মক্ষমতা নষ্ট করে দেয়, এটাও তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সেক্টরে সমস্যার সৃষ্টি করে। এর ফলে নতুন করে সৃষ্টি হয় আবাসন, শ্রেণিকক্ষ, পরিবহন সঙ্কট, শিক্ষার্থীরা পান না গ্রন্থাগারে পর্যাপ্ত সুবিধা। শ্রেণিকক্ষ ও এর আকার বৃদ্ধি না পেলেও শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানসম্মত শিক্ষাপ্রদান ও গ্রহণ ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষকদের নিজস্ব কক্ষের ব্যবস্থা করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। নিজের মতামত ব্যক্ত করে এ বিষয়ে ঢাবির দর্শন বিতর্কধারার সভাপতি হাবিবুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, আসন বৃদ্ধির আগে যে বিভাগগুলো আছে তাদের মান এবং বিভাগের শিক্ষকদের মান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে গুণগত বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন না বাড়ানোর বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন হিসেবে সম্প্রতি চিঠি পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষার্থী আসন না বাড়াতে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইউজিসি। গত ৩১ জুলাই ইউজিসিতে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী গত ১০ জুলাই একনেক সভায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা আর না বাড়ানোর জন্য অনুশাসন দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামান জানান, এখনো আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো চিঠি আসেনি।
তবে দেশের আর্থ-সামাজিক দিক বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন বৃদ্ধিকে ইতিবাচকভাবে দেখেছেন শিক্ষাবিদরা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা ও শিক্ষার গুণগত মান এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ জাগ্রত করার পরামর্শ দেন তারা।
এ বিষয়ে জাতীয় অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, যদি ধারণক্ষমতা থাকে তবে ছাত্র নিতে কানো আপত্তি নেই। তবে এর সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের সুযোগ, শিক্ষার মান বাড়াতে হবে, তাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল দিতে হবে, আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক বিকাশের প্রতি গুরুত্বারোপ করে এ শিক্ষাবিদ বলেন, ২৭-২৮ বছর হয়ে গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নেই। এটা আমাকে চিন্তিত করে। ফলে এখানে যে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছে তাদের সাংস্কৃতিক জীবন ও সুষ্ঠু বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ধারণক্ষমতা এবং মানসিকতা সাংস্কৃতিক অনুশীলনের মাধ্যমে আসে। এর সাথে মান বৃদ্ধি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
দেশবরেণ্য এ শিক্ষাবিদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মানও বাড়াতে হবে। তাদের গবেষণা, প্রকাশনা এগুলোও বাড়াতে হবে। কিন্তু এগুলোও বাড়ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় কেবল স্ফিত হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষকদের শিক্ষাগত অনুশীলন বাড়ছে না, গবেষণা দেখা যাচ্ছে না, প্রকাশনা খুবই অল্প। শিক্ষকদের জ্ঞান অনুশীলন, করতে হবে। জ্ঞান দেয়ার জন্য জ্ঞান আহরণ করতে হবে, জ্ঞান সৃষ্টিও করতে হবে। সেটা হচ্ছে কি না তা দেখভাল করতে হবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তানজীম উদ্দিন খান বলেন, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোযোগ থাকা উচিত অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অবকাঠামোগত কিছু উন্নয়ন হলেও তা পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে না। আসন বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধিটা বিবেচনায় নিলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন বৃদ্ধি করা উচিত। যখন ছাত্র সংখ্যা বাড়াব তখন তার আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। একটা সুষ্ঠু পরিবেশে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে পারছে কি না তা নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ঢাবির ওপর শিক্ষার্থী ভর্তির চাপ বেশি। আর যে আসন বাড়ানো হচ্ছে এটা কোনো বড় সংখ্যা না। তবে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মান বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামান বলেন, ইতোমধ্যেই আমাদের ধারণক্ষমতার বেশি শিক্ষার্থী আছে। শিক্ষার্থী বেশি থাকলে মান নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কী উদ্যোগ নেয়া হবেÑ জানতে চাইলে ভিসি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের ব্যবস্থার মাধ্যমে এগুলোর মান উন্নয়নে ক্রমান্বয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আবাসন, পরিবহন, শ্রেণিকক্ষ ও গ্রন্থাগার সুবিধা বাড়াতে হবে। যত জায়গায় শিক্ষার্থী বৃদ্ধির প্রভাব পড়ে সব জায়গায় নজর দিতে হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা