০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ব্যাংক একীভূতকরণ

শুরুতেই হোঁচট

-

দেশে ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি ক্রমে জটিলতর হচ্ছে। এ খাতে গত ১৫ বছর ধরে চলে এসেছে শুধুই অনিয়ম-দুর্নীতি। ছিল না সুশাসনের লেশমাত্র। ফলে পুরো খাতটি এসে উপস্থিত হয়েছে গভীর খাদের কিনারে। সর্বত্র যখন ধসের আলামত স্পষ্ট হতে শুরু করেছে, তখন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এ সংস্কারের অংশ হিসেবে ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু সে উদ্যোগ শুরুতেই হোঁচট খেতে শুরু করেছে।
সবল সরকারি ব্যাংকের সাথে দুর্বল বেসরকারি ব্যাংকের একীভূতকরণের উদ্যোগে কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যাংক দু’টির গ্রাহক, আমানতকারী, ব্যাংকের প্রশাসন ও কর্মীদের মধ্যেই নয়, সার্বিকভাবে পুরো ব্যাংকিং সেক্টরে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সবল ও দুর্বল ব্যাংক একীভবনের এ উদ্যোগ অনেক বিশেষজ্ঞই নেতিবাচক বলে বিবেচনা করছেন। কেউ এটিকে বলছেন ‘ফোর্সড ম্যারেজ’ বা ধরে বেঁধে বিয়ে দেয়া। এর ফল কখনো সুখের হয় না।
ব্যাংক একীভবনের উদ্যোগে বেশির ভাগ আমানতকারী আমানত হারানোর আশঙ্কা করছেন। এমনকি সরকারি বেসিক ব্যাংকে যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান বড় অঙ্কের আমানত রেখেছে তারাও আতঙ্কিত। শুরু হয়েছে আমানতের অর্থ তুলে নেয়ার হিড়িক। এর মধ্যে বেসিক ব্যাংক থেকে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি তুলে নিয়েছেন আমানতকারীরা। একীভবন করা হবে এমন সব ব্যাংকের একই অবস্থা। এ থেকে স্পষ্ট হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার কারো ওপর আমানতকারী তথা দেশের জনগণের ন্যূনতম আস্থাও নেই। ১৫ বছর আগে এদের ওপর জনগণের যে আস্থা ছিল সেটি এরা জোরদার করা তো দূরের কথা, ধরে রাখতেও ব্যর্থ হয়েছে।
এ আস্থাহীনতা বিনা কারণে তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাব, ক্ষমতা দেখিয়ে ব্যাংকগুলোকে অনিয়ম করতে বাধ্য করা- ইত্যাদি চলে এসেছে দীর্ঘকাল ধরে। শেয়ারবাজারে একের পর এক নজিরবিহীন কেলেঙ্কারি ঘটতে দেয়া হয়েছে। যারা কারসাজি করে লাখো মানুষের পুঁজি হাতিয়ে নিয়েছেন তাদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এসব অনুশীলন বন্ধ করতে বা কোথাও কোনো শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতেও পারেনি। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক নিজের রিজার্ভের নিরাপত্তা পর্যন্ত নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। জনগণের আস্থা লোপ পাওয়ার এসবই কারণ।
এ মুহূর্তে আমানতকারীদের মধ্যে যে আতঙ্ক বিরাজ করছে তা দূর করতে না পারলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তি দুর্বলতর হবে। কিন্তু তার চেয়েও বড় বাস্তবতা এই, ব্যাংক একীভবনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে গাইডলাইন দিয়েছিল সেটি পরিপালন হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় ব্যাংক একীভূত করতে অডিটর নিয়োগ করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের দায়দেনা-সম্পদের হিসাব, শেয়ারের দর ঠিক করা, শেয়ারের অংশ নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা ছিল। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকটা পিছিয়ে আসতে শুরু করেছে। একদিকে আমানতকারীদের চাপ, অন্যদিকে প্রভাবশালী ব্যাংক উদ্যোক্তাদের চাপ- সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পিছিয়ে আসা। আর কোনো দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত না করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদিত বেসরকারি ব্যাংকের মালিকরা সবাই ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী। বেশির ভাগ দুর্বল ব্যাংকের মালিক তারা। তাদের চাপে ব্যাংক একীভূতকরণের প্রক্রিয়া বন্ধ হতে পারে এমন কথা উঠেছে।
সেটি হলে ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগ ভণ্ডুল হবে এবং এর অর্থ দাঁড়াবে- পুরো খাতটিকে উত্তাল সমুদ্রে হালছাড়া নৌকার মতো ভাসিয়ে দেয়া।


আরো সংবাদ



premium cement