১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

'আমরা ভাত খায়া রিকশা চালাই, ভাতই তো আমাগো তেল'

ঢাকায় কড়াইল বস্তির কাছে একটি রাস্তার ফুটপাতে নিম্ন আয়ের একটি পরিবারকে ছোট মাছ কিনতে দেখা যায়। এই পরিবারটি জানিয়েছে, তারা বেশ ক'দিন পর এই মাছ কিনেছে। - ছবি : বিবিসি

বাংলাদেশে মাছ, ব্রয়লার মুরগির গোশত ও ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যয় সামলাতে পুষ্টিকর বা আমিষ খাদ্যে কাটছাঁট করতে হচ্ছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকে। নিম্ন আয়ের অনেকে বলেছেন, তারা এখন মাছ, গোশত এমনকি ডিম কেনা কমিয়ে পরিবারের খাবারে লাগাম টানছেন।

পুষ্টি বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাবে সব ধরনের আমিষ খাদ্যে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে যাওয়ায় চড়া বাজারের এই পরিস্থিতি দীর্ঘ সময় চললে পুষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। নিম্ন আয়ের মানুষের প্রশ্ন এখন একটাই যে মাছ, গোশত, ডিমের চড়া বাজার কতদিন থাকবে।

প্রোটিন খাবারে কাটছাঁট
ঢাকায় কড়াইল বস্তিতে নিম্নআয়ের অনেক মানুষের বসবাস। সেখানে কথা হয় ফরিদা বেগমের সাথে। তিনি দিনের প্রথম ভাগে বস্তি থেকে একটু দূরে তিনটি বাসায় পার্টটাইম কাজ করেন। তার স্বামী রিকশা চালান। তাদের দু'জনের আয়ে তিন শিশু সন্তানসহ পাঁচজনের সংসার।

তাদের সংসারে সপ্তাহে দু’দিন ডিম, একদিন ব্রয়লার মুরগির গোশত এবং দু’দিন তেলাপিয়া বা পাঙ্গাশ মাছ খাওয়া হতো। সপ্তাহের বাকি দু’দিন তারা সবজি এবং ডাল দিয়ে ভাত খেতেন। কিন্তু মাছ, গোশত ও ডিমের দাম অস্বাভাবিকবেড়ে যাওয়ায় ফরিদা বেগম এখন শুধু সন্তানদের জন্য সপ্তাহে দু’দিন ডিম কিনে প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছেন।

তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের পোলাপানদের ডিম দিতে পারছি না। তেলাপিয়া ও পাঙ্গাশ মাছ আমরা খেতাম। এখন তা কেনার সামর্থ্য নেই। সপ্তাহে মাছও কিনতে পারছি না। ছেলে মেয়ে মাছ চায়। কিন্তু আমরা তাদের চাহিদা মেটাতে পারছি না।’

তিনি প্রশ্ন করেন, মাছ, গোশত ডিমসহ জিনিসপত্রের অস্থির বাজার কতদিন চলবে? বস্তিতে আড়াই হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় একটি টিনের ঘরে ফরিদা বেগমের পুরো সংসার। সেখানে সকালে যখন ফরিদা বেগমের সাথে কথা হয়, তখন ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তার স্বামী হাবিবুর রহমান। তিনি দুপুরে রিকশা চালাতে বের হবেন।

তিনি জানালেন, আয় না বাড়লেও খাবার খরচ বেড়েছে, যা তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সেজন্য তাদের আমিষ খাদ্যে লাগাম টানতে হয়েছে।

কামাই কম, খরচ বেশি
রিকশাচালক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমাগো রিকশার ভাড়াতো বাড়ে নাই। আমরা ভাড়া বেশি চাইলেই লোকে কয়, তোমাগো রিকশায় কি তেল দিয়ে চলে। কিন্তু তেলতো আমাগো পোড়ে। আমরা ভাত খায়া রিকশা চালাই। ভাতইতো আমাগো তেল। কামাই কম, খরচ বেশি সেটা মানুষ বোঝে না।’

ঘরের পাশেই পানি উঠানোর নলকূপ এবং সেখানেই ফরিদা বেগম দুপুরের খাবার রান্না করছিলেন।
তিনি বলেন, বেশ কিছু দিন ধরে মাছ, গোশত না পেয়ে তার সন্তানরা আজ ডিম খাওয়ার বায়না ধরেছিল। কিন্তু আজ ঘরের ভাড়া দিয়ে হাতে আর পয়সা না থাকায় ডিম কিনতে পারিনি।

ফরিদা বেগম জানান, ‘বাচ্চা চাইছিল ডিমের তরকারি খাইতে। কিন্তু পারি নাই দিতে। আজ ভাতের সাথে বেগুন ভর্তা আর ডাল রান্না করছি’।

কড়াইল বস্তি থেকে একটু দূরে রাস্তার ফুটপাত থেকে ছোট মাছ কিনতে দেখা যায় নিম্ন আয়ের একটি পরিবারকে।

ফুটপাতে চা বিক্রেতা আব্দুর রহমান ও তার স্ত্রী মর্জিনা বেগম চার সন্তান নিয়ে ওই বস্তিতে থাকেন। আব্দুর রহমান বলেন, দাম বেশি হওয়ায় তারা মাছ কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। বেশ কয়েকদিন পর আজ ফুটপাত থেকে এই ছোট মাছ কেনেন সন্তানদের জন্য।

তেলাপিয়া বা পাঙ্গাশ মাছও নাগালের বাইরে
সাধারণ মানুষের মাঝে চাহিদা বেশি, এমন সব আমিষ পণ্যের দাম বেড়েছে। ফার্মের মুরগির এক হালি ডিমের দাম ২৮ টাকা থেকে কয়েক দিনের ব্যবধানে লাফিয়ে ৫০ টাকা হয়েছে। চাষের পাঙ্গাশ কেজি ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তেলাপিয়া মাছের কেজি ১২০ টাকা থেকে হয়েছে ২০০ টাকা। ব্রয়লার মুরগির গোশত কেজি প্রতি ১৪৫ টাকা থেকে ৪০ টাকার বেশি বেড়েছে।

পুষ্টিবিজ্ঞানীদের অনেকে বলেন, এসব পণ্য দিয়েই নিম্ন আয়ের একটা বড় জনগোষ্ঠী এবং মধ্যবিত্তদেরও অনেকে প্রোটিনের চাহিদা মিটিয়ে থাকে।

সর্বশেষ ২০১৯ সালে সরকার এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির যৌথ সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশের দু'কোটির বেশি মানুষের পুষ্টিকর খাবার জোগাড়ের ক্ষমতা ছিল না। এই পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছিল গত কয়েক বছরে। এখন চাহিদা বেশি এমন সব মাছ ও ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় একটা বড় জনগোষ্ঠী আমিষ খাদ্যে কাটছাঁট করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক খালেদা ইসলাম বলেন, মাছ, ডিমসহ আমিষ পণ্যের বেশি দামের বাজার লম্বা সময় ধরে চললে প্রোটিনের অভাবে পুষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের সবজি ও মাছ, গোশত থেকে আমিষের চাহিদা পূরণ হচ্ছিল। এই অবস্থায় আমরা ছিলাম। এখন সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়াতে প্রভাব পড়ছে।

অধ্যাপক খালেদা ইসলাম বলেন, বাজারের এই পরিস্থিতি ক্ষণস্থায়ী হবে বলে তারা আশা করেন। তবে ডাল এবং অনেক সবজি থেকেও আমিষের চাহিদা মেটানো যায় বলে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা যা বলছেন, সেই সবজির দামও ঊর্ধ্বমূখী।

ফলে তারা মনে করেন, নিম্ন আয়ের মানুষ বা এমনকি মধ্যবিত্তরাও প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ঊর্ধ্বমূখী বাজার অল্প সময়েই স্থির হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তার ওপর কতটা বিশ্বাস রাখতে পারছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement