২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দেশে ৩ মাসে বজ্রপাতে মৃত ১৭৭ : বাঁচার উপায় কী?

দেশে ৩ মাসে বজ্রপাতে মৃত ১৭৭ : বাঁচার উপায় কী? - ফাইল ছবি

দেশে ২০২০ সালে বজ্রপাতে ১৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর চলতি বছরে মার্চ থেকে জুনের মধ্যেই ঝরেছে ১৭৭টি তাজা প্রাণ। শুক্রবার এই হিসাবটি দিয়েছে সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম (এসএসটিএএফ)।

চলতি বছর ৬ জুন এক দিনে বজ্রপাতে সর্বোচ্চ ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালের মে মাসে মাত্র দু’দিনে বজ্রপাতে ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ বছর বজ্রপাতে মৃত্যুবরণকারীদের বিভিন্ন গল্প কাঁদিয়েছে অনেককে। যেমন, ফেনীতে তামান্না ও আল আমিন নামে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে পাশাপাশি এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়ার সময়। আম কুড়াতে গিয়ে দিনাজপুরে মারা গেছে অন্য দুই শিশু। তবে বজ্রপাতের শিকার মানুষদের বেশিরভাগই কৃষক, যারা সবার মুখে অন্ন তুলে দিতে মাঠে যান। সেখানেই বজ্রপাতে মরে পড়ে থাকেন। চিরবিদায়ের এত করুণ গল্প যেমন বেদনার। একইসাথে আতঙ্কেরও বটে।

অথচ এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর পরও বিষয়টি খুব একটা দৃষ্টি কাড়তে পারছে না ঊর্ধ্বতন মহলের। দেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর খবর যেভাবে গণমাধ্যম বা সাধারণ মানুষের আলোচনার বিষয় হয়েছে, একইরকম সব মিডিয়ায় গুরুত্ব পাচ্ছে না বজ্রপাতে মৃত্যু।

বজ্রপাত নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের সদস্য সচিব গওহর নাঈম ওয়াহারার মতে, এই উপেক্ষার কারণ বজ্রপাতে মারা যায় সাধারণ মানুষ। কোনো পর্যায়ের নীতি নির্ধারকরা যেহেতু বজ্রপাতের শিকারে পরিণত হন না, তাই এটা নিয়ে তোড়জোড়ও কম। তিনি বলেন, ‘বজ্রপাত কিন্তু সার্বিকভাবে উপকারী। আমাদেরকে কেবল প্রাণক্ষয় এড়াতে হবে। ভূমির উর্বরা শক্তিতে এর অবদান রয়েছে।’

গলদ পূর্বাভাসেই
বজ্রপাত থেকে বাঁচতে যে তিনটি ধাপের কথা বলা হয়, তার প্রথমেই রয়েছে পূর্বাভাস। তবে খোদ আবহাওয়া অধিদফতরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ বজ্রপাত বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল মান্নানের মতে, আবহাওয়া অধিদফতর বর্তমানে যেভাবে পূর্বাভাস দেয় তা খুব একটা কার্যকর নয়। তিনি বলেন, আমরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বলি, এই এলাকায় বজ্রপাত হতে পারে বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এখন সকাল কয়টা থেকে কয়টায় হবে- তা নির্ধারণ করা বাংলাদেশের কনসার্নে কঠিন কাজ। ফলে এ ধরনের সর্তকতা মানুষ শোনে না বলেও মনে করেন তিনি৷

তিনি বলেন, ‘সময় ও স্থান সুনির্দিষ্ট করে আমাদের ওয়েবসাইটে কিছু তথ্য দেয়া থাকে। এগুলো সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করার মতো পর্যাপ্ত সময় আমরাও যেমন ব্যয় করতে পারছি না, কোনো সেক্টর থেকেও সেভাবে করা হচ্ছে না। যার কারণে অনেকে জানেই না, আবহাওয়ার পূর্বাভাস আছে কি না। তবে বর্তমানে একেবারে সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।’

বজ্রপাত বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল মান্নান আরো জানান, তাৎক্ষণিক সতর্কতার এই বিষয়টাকে বলা হয় নাউকাস্টিং। এ ধরনের ফ্রিকোয়েন্সিয়াল ব্যবস্থাপনার জন্য অনেক উচ্চ প্রযুক্তি দরকার। এটা পাওয়ারফুল কম্পুটেশন দরকার, একইসাথে দক্ষ লোক দরকার। এগুলোর সংযোগ করা গেলে এই ধরনের পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। এরপর এই খবর ছড়িয়ে দিতে এলাকায় এলাকায় নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে ও মানুষকে রেসপন্সও করতে হবে।

মৃত্যুর হার কমাতে উপকূলীয় এলাকার দৃষ্টান্ত টেনে এনে তিনি বলেন, আমাদের দক্ষিণাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যুর সংখ্যা কমার কারণ কেবল আগাম সতর্কবার্তা নয়। কেবল ব্যবস্থাপনাও নয়। স্থানীয়দের সচেতনতাও দরকার। দক্ষিণাঞ্চলে সতর্কতার সময়ে কেউ সাইক্লোন সেন্টারে না গেলে পুলিশ দিয়েও নিয়ে আসা হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পূর্বাভাস জানার প্রযুক্তিটা আমাদের ক্ষেত্রে এফেক্টিভ নাই। স্ট্রং রাডার নেটওয়ার্ক ও স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক আমাদের নাই। সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস পেতে হলে রাডারের সাথে স্যাটেলাইট প্রযুক্তির উন্নয়ন করতে হবে।

বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিয়া শাহনাজের মতে, পুরনো ডেটা ও তাৎক্ষণিক ডেটা এআই দিয়ে বিশ্লেষণ করে খুবই সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস দেয়া যেতে পারে। এর জন্য দরকার উদ্যোগ। কিন্তু আমরা সেখানেই থমকে আছি।

‘প্রাকৃতিক প্রতিরোধক ধ্বংস হয়ে গেছে’
ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের সদস্য সচিব গওহর নাঈম ওয়াহারার মতে, এক সময় আমাদের গ্রামে-গঞ্জে মাঠের মধ্যে গাছ থাকতো। কিন্তু আমরা এসব গাছ কেটে ফেলেছি। সেটা তালগাছই হোক বা অন্য গাছ। এসব গাছ আবার লাগাতে হবে। সরকার তালগাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সেই গাছ লাগাচ্ছে রাস্তার পাশে। এটা দিয়ে কিছুই হবে না। আরো বিভিন্ন রকমের প্রকল্প নেবে, রাডার কিনবে। কিছু মানুষের চাকরি হবে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হবে না। তিনি বলেন, দ্রুত বর্ধনশীল গাছ লাগাতে হবে। লাগানোর জায়গাটা হতে হবে বিলের মাঝখানে। খোলা জায়গার মাঝখানে। তাহলেই সেটা বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে পারবে।

উপেক্ষিত বজ্রনিরোধক
বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে সব জনসমাগমের স্থানে বজ্রনিরোধক লাগানোর দাবি করেছেন জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ, বজ্রপাত বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল মান্নান। লাইটনিং অ্যারেস্টার বা বজ্রনিরোধক কী, এটা কিভাবে কাজ করে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা মূলত তামার তার। চমকানো বিদ্যুৎ তামার তার দিয়ে মাটিতে চলে যায়। এটা বিদ্যুৎ সুপরিবাহী। খোলা জায়গা যেখানে আছে, সেখানে ৩০০ ফিট উপরে যদি এই তার স্থাপন করা হয়, তাহলে সেটা দিয়ে বজ্রের বিদ্যুৎ মাটিতে চলে যাবে। তিনি আরো বলেন, তবে সাধারণ তামার তার ফেল করতে পারে। উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তামার তার দিয়ে করতে হবে।

এসএসটিএএফের ৬ দফা
সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম- এসএসটিএএফ বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে ছয় দফা দাবি তুলেছে। দাবিগুলো হচ্ছে-

১. বজ্রপাতের ১৫ মিনিট আগেই আবহাওয়া অধিদফতর জানতে পারে কোন কোন এলাকায় বজ্রপাত হবে। এটাকে মোবাইল মেসেজ আকারে সংশ্লিষ্ট এলাকার সকল মানুষকে জানানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

২. ঝড়/জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের মৃত্যুর হার যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি মৃত্যুর হার বজ্রপাতে। এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘোষণা করলেও এই খাতে বরাদ্দ কম। মানুষের জীবনরক্ষার্থে এই খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

৩. মাঠে, হাওর, বাওরে বা ফাঁকা কৃষি কাজের এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। তার ওপরে বজ্রনিরোধক স্থাপন করতে হবে। যেন বজ্রপাতের সময় কৃষকরা সেখানে আশ্রয় নিতে পারে।

৪. বিদেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে থান্ডার প্রটেকশন সিস্টেমের সকল পণ্যে শুল্ক মওকুফ করতে হবে।

৫. সরকারিভাবে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি বজ্রনিরোধক স্থাপনের ঘোষণা দিতে হবে।

৬. বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা/থান্ডার প্রটেকশন সিস্টেম যুক্ত না থাকলে নতুন কোনো ভবনের নকশা অনুমোদন করা যাবে না।

‘সরকার কী করছে’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: আতিকুল হক বলেন, ‘আমরা হাওর অঞ্চলে একটা প্রকল্প করেছি। সেখানে বিশাল ভূমিতে বজ্রপাতের সময় কৃষকরা কোনো আশ্রয় নেয়ার জায়গা পায় না, জায়গা থাকলেও সেখানে বজ্রনিরোধক থাকে না। তিনি বলেন, নেত্রকোনা থেকে কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ অঞ্চলের জন্য করা এই প্রকল্প আমরা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি।

তিনি বলেন, এই প্রকল্পের আওতায় বজ্রপাত শুরু হলে মাঠে থাকা কৃষকদের তাৎক্ষণিক আশ্রয় নেয়ার মতো কিছু শেল্টার তৈরি করা হবে। ওই এলাকার সরকারি-বেসকারি যেসব ভবনে বজ্রনিরোধক নাই, সেগুলোতে আমরা বজ্রনিরোধক লাগিয়ে দেবো। অন্য এলাকার জন্য সরকার কী করছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এরকম অন্য এলাকায় জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে আমরা কাজ করছি। যেমন, বরেন্দ্র অঞ্চলে আমরা একটা প্রকল্প নিতে চাই।

আগামী বছর বিভিন্ন এলাকায় টিআর-খাবিখার বরাদ্দ দিয়ে বজ্রনিরোধক স্থাপনের কাজ করা হবে বলেও জানান তিনি। শুক্রবারও বজ্রপাত নিয়ে সভা করেছেন জানানোর পর বিকেলে সভার ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এটা নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু করা যায় না। আমরা কাজ করছি।

সূত্র : ডয়েচে ভেলে


আরো সংবাদ



premium cement
‘ফ্রি ভিসার গল্প’ আর শূন্য হাতে ফেরা লাখো শ্রমিক নোয়াখালীতে প্রবাসীর স্ত্রীর ব্যক্তিগত ছবি দেখিয়ে চাঁদা আদায় দেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে, অথচ বিরোধী দল দেখে না : কাদের আশুলিয়ায় বাঁশবাগান থেকে নারী পোশাক শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ফেরত গেলেন, কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট কি আরো জটিল হচ্ছে দিনাজপুরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষ, চালক-হেলপার নিহত মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ সখীপুরে বৃষ্টির জন্য অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা দক্ষিণ ভারতে কেন কাজ করেনি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নতুন আংশিক কমিটি বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা অন্বেষণে থাইল্যান্ডের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

সকল