০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


৭৫ বছর পর পাকিস্তানি মুসলিম বোনের সাথে ভারতীয় শিখ ভাইদের সাক্ষাৎ

গুরমুখ সিং ও বলদেভ সিং ৭৫ বছর পর তাদের বোন মুমতাজ বিবির সঙ্গে মিলিত হলেন। - ছবি : সংগৃহীত

পাকিস্তানি একজন নারী যিনি ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান ভাগের সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন। ৭৫ বছর পর তিনি তার ভারতীয় ভাইদের সাথে এই প্রথমবারের মতো মিলিত হয়েছেন।

উত্তাল ওই সময়ে মুমতাজ বিবি তার শিখ পরিবার থেকে ঘটনাক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, এবং জীবনের দীর্ঘ সময় পাড়ি দিয়ে এসে গত এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের একটি গুরদুয়ারাতে তার দুই ভাই গুরমুখ সিং ও বলদেভ সিং-এর সাথে একত্রিত হন।

এই ঘটনায় উদ্বেলিত তার এক ভাই গুরমুখ সিং বলেন, ‘আমরা যে আমাদের জীবদ্দশায় আমাদের বোনের সাথে মিলিত হতে পেরেছি তাতে আমরা খুবই আনন্দিত।’

উনিশশো সাতচল্লিশ সালের ওই দেশভাগের ফলে ভারত ও পাকিস্তান- এই দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের বাইরে পৃথিবীর ইতিহাসে সে সময় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে নিজেদের বাড়ি ঘর ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে হয়েছিল।

এক হিসেবে বলা হয়, দেশভাগের সময় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ শরণার্থী হন।

এছাড়াও সে সময় সংঘটিত ধর্মীয় দাঙ্গায় নিহত হয় পাঁচ থেকে ১০ লাখ মানুষ।
যেভাবে আলাদা হয়েছিলেন
‘এই সহিংসতায় আমাদের জীবনও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল,’ বলেন গুরমুখ সিং।

দেশভাগের ফলে তাদের বাবা পালা সিং পাকিস্তান থেকে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের পাতিয়ালা জেলায় চলে যান। পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া সহিংসতায় তার স্ত্রীর মৃত্যুর পরেই তিনি ভারতে চলে যান।

‘তিনি ধারণা করেছিলেন যে স্ত্রীর সাথে হয়তো তার কন্যাকেও হত্যা করা হয়েছে। এর পরে তিনি তার শ্যালিকাকে বিয়ে করেন (সে সময় পাঞ্জাব পরিবারে এটাই ছিল সামাজিক রীতি), বলেন বলদেভ সিং।

দুই ভাই-এর মধ্যে কনিষ্ঠ বলদেভ সিং। কিন্তু মুমতাজ বিবি ঘটনাক্রমে পাকিস্তানের একটি মুসলিম পরিবারের হাতে চলে যান, ওই পরিবারটি তাকে দত্তক নেয় এবং তারাই তাকে পেলে-পিঠে বড় করেন।

দুই ভাই-এর জন্য তাদের বোন মুমতাজ বিবির সন্ধান পাওয়াও ছিল বেশ নাটকীয়।

খোঁজ পাওয়া গেল যেভাবে
‘প্রায় দুই বছর আগে আমাদের সন্তানরা সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের বোনের খোঁজ পায়,’ বলেন বলদেভ সিং।

মমতাজ বিবিও তার পরিবারকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।

এ বিষয়ে তিনি পাকিস্তানি এক ইউটিউবার নাসির ধিলনের সাথে কথা বলেন। ইউটিউবে নাসির ধিলনের একটি চ্যানেল আছে যার সাহায্যে দেশভাগের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কয়েকটি পরিবার পুনরায় একত্রিত হতে সক্ষম হয়েছে। ইউটিউবের ওই চ্যানেলটির নাম পাঞ্জাবি লেহার।

মুমতাজ বিবির সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য গুরমুখ সিং পাকিস্তানে তাদের পৈত্রিক নিবাস শেখুপুরা জেলার একটি গ্রামের একজন দোকানদারের সাথে যোগাযোগ করেন।

‘তিনি আমাদেরকে মুমতাজের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন,’ বলেন তিনি।

গুরমুখ সিং স্বীকার করেন যে মুমতাজ বিবির পরিচয়ের ব্যাপারে প্রথম দিকে তাদের পরিবার খুব বেশি আশাবাদী ছিল না।

‘সে কি অন্য কেউ হতে পারে? কিন্তু আমরা ধীরে ধীরে একটা ঘটনার সাথে আরেকটা ঘটনা মেলাতে পারলাম, একের পর এক প্রমাণ পেলাম এবং সে যে আমাদের বোন সেই সত্যটা প্রতিষ্ঠিত হলো,’ বলেন তিনি।

‘এর ফলে আমাদের আনন্দের সীমা রইল না।’
‘এর পরে আমরা যে কোন মূল্যে তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু আমাদের তো ভিসার সমস্যা ছিল,’ বলেন বলদেভ সিং।

কোথায় দেখা হলো
তারা যেসব জায়গায় মিলিত হতে পারেন বলে তাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল তার একটি ছিল শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক দেভকে যেখানে সমাহিত করা হয়েছে সেই কর্তারপুর সাহিব গুরদুয়ারা মন্দির।

এই গুরদুয়ারাটি পাকিস্তানের রাভি নদীর পারে নারোয়াল জেলায় যা ভারতের ডেরা বাবা নানকের মন্দির থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে।

এই কর্তারপুর করিডোরটি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে উদ্বোধন করেন এবং তার পর থেকে হাজার হাজার হাজার ভারতীয় তীর্থযাত্রী ভিসা ছাড়াই ওই করিডোর দিয়ে ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়েছেন।

দেশভাগের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কয়েকটি পরিবারও এই স্থানে একত্রিত হতে সক্ষম হয়েছে। তবে কোভিড মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে কর্তারপুরে তীর্থযাত্রা স্থগিত করা হয়। তবে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে এটি পুনরায় খুলে দেয়া হয়েছে।

এ বছরের ২৪ এপ্রিল দুই ভাই তাদের পরিবার নিয়ে কর্তারপুর সাহিব গুরদুয়ারা মন্দিরে এসে পৌঁছান এবং শেষ পর্যন্ত তাদের বোনের সাথে মিলিত হন। বোন মুমতাজ বিবিও তার পরিবার নিয়ে ওই মন্দিরে হাজির হয়েছিলেন।

‘আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরি এবং কাঁদতে থাকি,’ বলেন বলদেভ সিং। এ সময় তার চোখ ছলছল করে উঠছিল।

‘আমরা বিচ্ছিন্ন হতে চাই নি। আমরা পরস্পরকে প্রতিশ্রুতি দেই যে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা ভিসা সংগ্রহের চেষ্টা করবো। মুমতাজ বিবি সব ফর্ম পূরণ করেছে এবং আশা করছি যে সে আমাদেরকে দেখতে খুব শীঘ্রই ভারতে আসতে পারবে।’

‘আমাদের ধমনীতে তো একই রক্ত বইছে’
মুমতাজ বিবি বেড়ে ওঠেন একজন মুসলিম হিসেবে। গুরমুখ সিং বলেছেন, তাদের পরিবার তার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই তারা এটি মেনে নিয়েছে।

‘যখন আমাদের সাক্ষাৎ হলো তখন আমরা বাকি সবকিছু ভলে গিয়েছিলাম,’ বলেন তিনি।

‘আমাদের বোন মুসলিম, তাতে কী হয়েছে? তার ধমনীতেও একই রক্ত বইছে। আর সবকিছুর চাইতে এটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

‘এটা সত্য যে আমাদের জীবনধারা কিছুটা আলাদা। তারা (পাকিস্তানে) অনেক বেশি মাংস খায়, আমরা খুব কম খাই। কিন্তু গুরু নানক সব মানুষকে সমানভাবে গ্রহণ করার কথা বলে গেছেন।’

মিলনস্থল এই শিখ মন্দির
জানুয়ারি মাসেও আরো একটি পরিবার যারা দেশভাগের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তারা এই কর্তারপুর সাহিব গুরদুয়ারাতে একত্রিত হয়েছিলেন।

তাদের একজন সিক্কা খান, দেশভাগের সময় তিনি তার মায়ের সাথে ভারতে থেকে গিয়েছিলেন। তার ভাই সাদিক খান বাবার সাথে চলে যান পাকিস্তানে।

সিক্কা খান তার হারিয়ে যাওয়া ভাইকে নিয়ে মে মাসে ভারতে ফিরে এসেছেন।

‘কর্তারপুর সাহিব গুরদুয়ারার মাধ্যমে আমাদের মতো বহু মানুষ তাদের হারিয়ে যাওয়া আত্মীয় স্বজনকে ফিরে পেয়েছে,’ বলেন গুরমুখ সিং। তবে ভারত সরকারের কাছে তার একটি অনুরোধ আছে।

‘তারা যেন কর্তারপুর সাহিবে যাওয়া এবং দুটো দেশের মধ্যে ভিসা নেওয়ার প্রক্রিয়া আরো সহজ করে দেয়। আমাদের দেখা হতে ৭৫ বছর লেগেছে। এখন আমরা বার বার দেখা করতে এবং একসাথে সময় কাটাতে চাই, বলেন তিনি।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement