২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমার পরিচয় : আমি একজন মুসলিম

-

(শেষাংশ)
মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও দলাদলি আল্লাহপাকের বড়ই অপছন্দ। তাঁর ভাষায়- ‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা দলে দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য হেদায়াত পাওয়ার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে। যারা এ নীতি অবলম্বন করেছে তারা সে দিন কঠিন শাস্তি পাবে। যে দিন কিছু লোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে ও কিছু লোকের মুখ কালো হয়ে যাবে। তাদেরকে বলা হবে, ঈমানের নিয়ামত লাভ করার পরও তোমরা কুফরি নীতি অবলম্বন করলে? ঠিক আছে, তাহলে এখন এই অস্বীকৃতির বিনিময়ে আজাবের স্বাদ গ্রহণ করো’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৫-১০৬)। দলাদলি, ফেতনা-ফাসাদ, হিংসা-বিদ্বেষ কোনো সাধারণ অপরাধ নয়, একেবারে কুফরির অপরাধ। হাত বাঁধা, আমীন জোরে বা আস্তে বলা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হন সালাতিরা। কিন্তু সালাত আদৌ না পড়া, ঘুষ ও সুদের সাথে জড়িত হওয়া, ওজনে কম ও ভেজাল দেয়া- এসব নিয়ে কোনো বিবাদ নেই বা মসজিদ থেকে বের করে দেয়ার কথাও শোনা যায় না। সব মাজহাব ও আহলে হাদিস সত্যাশ্রয়ী ও দলিলভিত্তিক। যেহেতু অমৌলিক বিষয় সেহেতু দলাদলি না করে এবং কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ ছাড়াই নিজ নিজ পছন্দমতো মাজহাব অনুসরণ করা যায়, এমনকি নিজ মসজিদের ইমাম সাহেবকে অনুসরণ করারও সুযোগ রয়েছে।
আল্লাহপাক চান তাঁর অনুগত (মুসলিম) বান্দা পুরোপুরি তাঁকে মেনে চলুক। আংশিক মানা অর্থ তাঁকে মানার পাশাপাশি শয়তানকেও মানা। তাঁর বাণী- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। কারণ, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (সূরা বাকারা-২০৮)। আমাদের সমাজে নিরেট নাস্তিকের সংখ্যা একেবারে নগণ্য। মানুষ মূলত শিরক করে থাকে। আল্লাহকে মানার পাশাপাশি তার নফস, মানবরূপী শয়তানসহ আরো অনেককে মানে। অথচ আল্লাহর দাবি, ‘আল্লাহর আনুগত্য করো এবং তাগুতকে অস্বীকার করো’ (সূরা আন নহল-৩৬)। আংশিক মানা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কি দ্বীনের কিছু অংশ মানবে এবং কিছু অংশ অমান্য করবে, তাহলে দুনিয়ার জীবনে রয়েছে জিল্লতি ও আখিরাতে রয়েছে ভয়াবহ আজাব’ (সূরা বাকারা-৮৫)।


আমরা এখন রয়েছি ভয়াবহ জিল্লতির মধ্যে। আমরা সালাত, রোজা, হজ, জাকাতকেই মনে করি দ্বীন। অথচ আমাদের ব্যবহারিক জীবনটা একেবারেই কদর্যপূর্ণ। আমাদের চাকরি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, রাজনীতি ও সামাজিক জীবনে ইসলাম সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আমাদের নেতা-নেত্রী, আইন-আদালত ও ব্যবসায়ী শ্রেণী অনর্গল মিথ্যা বলে। অথচ আমাদের নবী সা: বলেছেন, মিথ্যা সব পাপের মা। তিনি আরো বলেছেন, আমার উম্মতরা সব পারে কিন্তু মিথ্যা বলতে পারে না ও বিশ^াসঘাতকতা করতে পারে না। ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন ও আমানত রক্ষা এ জাতি ভুলেই গেছে। এই যাদের চরিত্র তাদেরকে মুসলিম মনে করার প্রশ্নই উঠে না। নিরেট মুনাফিক বৈ আর কিছু নন। আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা হবে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। দুর্ভাগ্য, তারা সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক না হয়ে হয়েছে ঘৃণার পাত্র।
আল্লাহপাক এই মুসলিম উম্মাহকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত, তোমাদের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ করবে, মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে এবং আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা রাখবে’ (সূরা আলে ইমরান-১১০)। আদেশ দান করতে হলে কর্তৃত্বের অধিকারী হতে হয়। আল্লাহ ঈমানদারদের নেতৃত্বের আসনে দেখতে চান। নবী সা:-এর উত্তরাধিকার হিসেবে ঈমানদারদের একই দায়িত্ব এবং সেটি হলো দ্বীন কায়েম করা। আকিমুস সালাত যেমন সালাত কায়েম করা ফরজ তেমনি আকিমুত দ্বীনও (দ্বীন কায়েম) ফরজ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী- ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য সে বিধানই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ তিনি দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমি তোমার কাছে ওহি করে পাঠিয়েছি, উপরন্তু যার আদেশ আমি ইবরাহিম, মূসা ও ঈসাকে দিয়েছিলাম, তোমরা এ দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করো এবং এতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না’ (সূরা আশ শূরা-১৩)।


দ্বীন কায়েমের প্রশ্নে কোনো মতপার্থক্য করার সুযোগ নেই। দ্বীন কায়েমের কাজ একাকী বা বিচ্ছিন্নভাবে করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টা। সঙ্ঘবদ্ধতার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর বাণী- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যেভাবে করা উচিত আর মুসলমান না হয়ে মরো না। তোমরা আল্লাহর রজ্জু শক্তভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (সূরা আলে ইমরান : ১০২-১০৩)। প্রশ্ন উঠতে পারে, আলেমরা এত বিভক্ত এবং এতগুলো ইসলামী দল- মানুষ কোন দলে যাবে? নবী সা:-এর নেতৃত্বে একাধিক দলের কোনো সুযোগ ছিল না এবং সেখানে দল ছিল একক। কিন্তু নবীর অনুপস্থিতিতে একাধিক দল থাকতে পারে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতে নাজাত যদি জীবনের লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলে পরস্পর সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি থাকতেই হবে। যারা উম্মাহর মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করবে তাদের কুফরির পরিণতি ভোগ করতে হবে (সূরা আলে ইমরান : ১০৫-১০৬)। আর ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুর দিকে যদি আহ্বান জানানো হয় তাহলে আল্লাহর বাণী স্মরণ করতে হয়- ‘যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইবে, তার থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না। আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন’ (সূরা আলে ইমরান-৮৫)।


মুসলিম (অনুগত বান্দা) সেই যে ইসলামকে আল্লাহপাক প্রদত্ত একমাত্র দ্বীন হিসেবে বিশ^াস করে, সর্বোত্তম জীবনাদর্শ হিসেবে মেনে চলে এবং দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালায়। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো আদর্শের অধীন একটি মুহূর্তও সন্তুষ্ট জীবন যাপন করে না। সালাত, রোজা, হজ, জাকাত, তাসবিহ-তাহলিল, মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, দান-খয়রাত সব আছে; কিন্তু এই হতভাগা ইসলামের বিজয় চায় না বা ইসলাম প্রতিষ্ঠায় তার কোনো চেষ্টা-প্রচেষ্টাও নেই, সেই ব্যক্তি নিরেট মুনাফিক বৈ আর কিছু নন। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই রাসূলুল্লাহ সা:-এর পেছনে সালাত পড়েছে এবং অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগিও করেছে; কিন্তু হৃদয়ে ছিল ইসলামের শত্রুতা। তাই সে হলো মুনাফিক সরদার। আল্লাহপাক ঈমানদার ও কাফেরকে স্পষ্টভাবে চিত্রায়িত করেছেন- ‘যারা ঈমান এনেছে তারা লড়াই করে আল্লাহর পথে, আর যারা কুফরি করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। সুতরাং তোমরা লড়াই করো শয়তানের বন্ধুদের সাথে। নিশ্চিত জেনে রাখো, শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল’ (সূরা আন নিসা-৭৬)। দু’টি পক্ষ স্পষ্ট, মাঝামাঝি কোনো পক্ষ নেই, যদি থাকে তা হলে সেটি হবে সুবিধাবাদী। এই চরিত্রের মানুষগুলো সময়ে থাকে ঈমানদারদের সাথে আবার থাকে কাফেরদের সাথে, এরাই মূলত মুনাফিক। আল্লাহপাক মুসলিম উম্মাহকে হিফাজত করুন। আমীন।
লেখক : উপাধ্যক্ষ (অব:), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement