১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


ইসলামী রাজনীতি নিয়ে অনাকাক্সিক্ষত বিভ্রান্তি

-

(শেষাংশ)
রাষ্ট্রের প্রাণ হচ্ছে সংবিধান আর গণতন্ত্র হচ্ছে গৌণ। সেই প্রাণ থেকে মুমিনের প্রাণ আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস তোলে দেয়া হয়েছে। তা নিয়ে কারো কোনো আলোচনা, মাথাব্যথা ও মাতামাতি নেই; বরং গৌণ বিষয় নিয়ে চলছে টানাহ্যাঁচড়া ও বাড়াবাড়ি। নবীজী সা: বলেন, ‘ইসলামের সৌন্দর্য হচ্ছে অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়াদি এড়িয়ে চলা’ (তিরমিজি)।
এক শ্রেণীর তরুণ আলেম উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের মধ্যে অহেতুক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। যুক্তি-তর্ক, তথ্য-উপাত্ত, আলোচনা-পর্যালোচনা, গবেষণা, তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, কুরআন-হাদিস, ইজমা-কিয়াসের দলিল ব্যতীত গণতন্ত্রকে মনগড়া কুফরি ও ইচ্ছেমতো হারাম ফতোয়া দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই শুরু করে দিয়েছেন। হতে পারে এটি ইসলামী রাজনীতির বিরুদ্ধে সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র! কাফেরদের তৈরি বিমানে চড়ে হজ করা যদি হালাল হয় তাহলে কাফেরদের তৈরি গণতন্ত্রে চড়ে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা কেন হারাম হবে? গরুর গো-মূত্র খাওয়া হারাম তাই বলে কী এই কথা বলা শুদ্ধ হবে- গরু খাওয়া হারাম? গণতন্ত্রের যেসব ধারা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক তা নিঃসন্দেহে পরিত্যাজ্য। এটি আপেক্ষিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। এখানে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। গণতন্ত্র কোনো মতবাদ বা ধর্ম নয়। একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা মাত্র। গণতন্ত্রকে ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করানো দুরভিসন্ধিমূলক! অতএব, অন্ধকারের সাথে লাঠি দিয়ে লড়াই নয়; বরং বাতি জ্বালালে অন্ধকার অটোমেটিক দূর হয়ে যাবে। চৌদ্দ শ’ বছর আগে অর্ধ পৃথিবীর বাদশাহ হজরত ওমর রা: খলিফা নিয়োগের জন্য ছয়জনের একটি পরামর্শ কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন। আর আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা:-কে শর্তসাপেক্ষে রায় দেয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এ থেকেই প্রতীয়মান মেজরিটি মাস্ট বি গ্র্যান্টেড ধারাটিও ইসলামপরিপন্থী নয়। তবে তা আল্লাহর বিধানের বিপরীত হতে পারবে না। নবীজী সা: বলেন, ‘স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে সৃষ্টির আনুগত্য নয়’। সুতরাং, এ কথা অনায়াসে বলা যায়, নেতৃত্ব নির্বাচন ও রায় দেয়া কনসেপ্টটি ওমর রা: থেকে প্রমাণিত। তখন সেটি সংক্ষিপ্ত আকারে ছিল আর এখন আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। কথায় বলে ‘প্রয়োজন আবিষ্কারের জননী’।
বর্তমান সময়ের ইসলামী পণ্ডিত ও আন্তর্জাতিক ইসলামিক স্কলার আল্লামা শায়খ ইউসুফ আল কারজাভির মতে, ‘বিধর্মীদের কাছ থেকে যেকোনো ভালো আইডিয়া ও পদ্ধতি মুসলমানরা গ্রহণ করার সুযোগ আছে, যদি তা নস কিংবা শরিয়াহর বিধি-বিধানের বিপরীত না হয়। যদি কোনো স্পেসিফিক অংশ শরিয়াহবিরোধী হয় তবে তা সংস্কার করা যেতে পারে। সব মিলে তিনি মনে করেন, গণতন্ত্রের পদ্ধতি ও গণতন্ত্রের সম্ভাব্যতা ইসলামের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। পাশাপাশি মুসলিম রাষ্ট্রে প্রয়োগের ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সম্ভব।’ তিনি উসুলে ফিকহের দু’টি মূলনীতি সামনে আনেন। প্রথমত, ‘যা বাদ দিয়ে আবশ্যকীয় কিছু আঞ্জাম দেয়া যায় না (কাজ বাস্তবায়নে) তখন সেটিও আবশ্যক হয়ে যায়।’ দ্বিতীয়, ‘অমুসলিমদের উদ্ভাবিত কোনো বিধান গ্রহণ করতে আপত্তি নেই, যদি এটি মুসলমানদের জন্য ভালো কিছু বয়ে নিয়ে আসে।’ এই যুক্তির পক্ষে তিনি দু’টি দলিল সামনে এনেছেন। বিশেষ করে নবীজীর সা:-এর সময়ে নেয়া পদক্ষেপ; যেমন- ‘খন্দক তথা পরিখা খনন’ যা মূলত কাফের তথা পারসিকদের যুদ্ধনীতি ছিল। দ্বিতীয়, ‘বদরের অমুসলিম যুদ্ধবন্দীদের দিয়ে মুসলমানদের লেখাপড়া শেখার বিষয়টি।’ তার মতে, ভোট দেয়া মুসলমানদের একটি দায়িত্ব। ভোটকে প্রত্যাখ্যান করলে কিংবা ভোটের সময় চুপ থাকলে বা এড়িয়ে গেলে খারাপ মানুষদের সুবিধা দেয়া হবে, যা অনেক পাপের কারণ হতে পারে। মহাগ্রন্থে আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে পরস্পর সহযোগিতা করো, পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অন্যের সহায়তা করো না’ (সূরা মায়িদাহ-০২)। শায়খ কারজাভি হাফিজাহুল্লাহর মতে, গণতন্ত্রের ধারাগুলো ইসলামী শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি, আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিরোধিতা করে না; বরং জনগণের শাসন নিশ্চিত করে, যা মূলত স্বৈরতন্ত্রের বিরোধিতা করে। গণতন্ত্রে এরকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যে, আল্লøাহর বিধানকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। তিনি মনে করেন, গণতন্ত্র ডিক্টেটরশিপকে প্রত্যাখ্যান ও জনগণের শাসন নিশ্চিত করে। তিনি বলেন, এখানে আল্লাহর শাসন মানে বৈধ শাসক (জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচিত শাসক) ও ইজমার শাসন। গণতন্ত্রের বিষয়ে শায়খ কারজাভি হাফিজাহুল্লাহর একটি উক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ আর তা হচ্ছে- ‘সব কিছু মূল্যায়ন করে ফলাফল নির্ণয় করতে গেলে ইসলামের শূরা পদ্ধতি গণতন্ত্রের মৌলিক সত্তাগুলোকে নিশ্চিত করেছে’ (ইউসুফ আল কারজাভির ইসলামী রাষ্ট্রতত্ত্ব, পৃষ্ঠা-১৬৬)।
বিগত পাঁচ দশক যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন, দেশকে শাসন করেছেন, তারা জাতিকে সামাজিক নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সুশাসন উপহার দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। নীতিহীন রাজনীতি দিয়ে জাতির মুক্তি সম্ভব নয়। জাতি গতানুগতিক রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার গ্লানি আর বহন করতে রাজি নয়। জাতি এখন বিকল্প নেতৃত্ব খুঁজছে। জনগণ পরিবর্তন দেখতে চায়। জনগণ কাক্সিক্ষত মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের প্রতি ঝুঁকছে। এখন জাতির আশার আলো ইসলামী দলগুলো।
ইসলামী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতির নেতৃত্ব দিতে হবে। ওলামায়ে কেরামকে শক্ত হাতে রাষ্ট্রের হাল ধরতে হবে। আজকের প্রত্যয় হোক একতা, হৃদ্যতা ও সম্প্রীতি। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সর্বস্তরের ওলামায়ে কেরাম, ছাত্র-ত্বলাবা, সাধারণ জনগণ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব¡ ইসলামী দলগুলোর পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। ইসলামী নেতৃত্বকে শক্তিশালী করা। ইসলামী রাজনীতি মানেই খিলাফতের পথে অগ্রযাত্রা। এই যাত্রায় ওলামায়ে কেরামের সমর্থন, পেশাজীবীদের পরামর্শ ও তাওহিদি জনতার সহযোগিতা ইসলামী রাজনীতির প্রাণ, উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা। ইসলামী রাজনীতির নির্মল বাতাসে গড়ে উঠবে দুর্নীতিমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, নিরাপদ ও শান্তিময় নতুন বাংলাদেশ ইনশা আল্লাহ।
লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম


আরো সংবাদ



premium cement