২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তাওবাই সফলতা ও ব্যর্থতার মূল

-

মানুষের তৎপরতা যত বৃদ্ধি পায়, শয়তানের কুমন্ত্রণা তত শক্তিশালী হয়। শয়তান প্রকাশ্যে গোপনে নানাভাবে মানুষকে গুনাহের পথে প্ররোচিত করে। এ প্ররোচনায় মানুষ গুনাহের পথে ধাবিত হয়। রবের অবাধ্য হয়ে যায়, নিষিদ্ধ কাজে পা বাড়ায়। অনেক সময় বড় বড় গুনাহ করে ফেলে। মুমিন শয়তানের প্ররোচনায় গুনাহ করে, অনুধাবন করার সাথে সাথে রবের কাছে ফিরে আসে। রবের কাছে নিজের গুনাহের জন্য ইস্তিগফার, ক্ষমা প্রার্থনা করে, এটিই তাওবা। তাওবা শব্দের অর্থ ফিরে আসা, ক্ষমা প্রার্থনা করা, গুনাহ থেকে ফিরে আসা, নিষিদ্ধ কাজ থেকে ফিরে আসা।

কোনো অন্যায় বা নিষিদ্ধ কাজ হয়ে যাওয়ার পর অনুতাপ-অনুশোচনা করে সেই কাজের জন্য ক্ষমা চাওয়া ও সেই অন্যায় কাজ ছেড়ে ভালো কাজে ফিরে আসাকে তাওবা বলা হয়। হজরত ইবনে মাসউদ রা: বলেন, আন্তরিক তাওবা হলো গুনাহের দিকে আর না ফেরা, যেমন করে দুধ গাভীর ওলানে আর ফিরে যায় না। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘কিন্তু যারা তাওবা করবে, ঈমান আনবে ও ভালো কাজ করবে, আল্লাহ তাদের খারাপ কাজগুলোকে ভালো কাজ দিয়ে পরিবর্তিত করে দেবেন। আর যারা তাওবা করে ও নেককাজ করে আল্লাহর প্রতি তাদের তাওবা সত্যিকারের তাওবা।’ (সূরা আল ফুরকান : ৭০-৭১)

জীবন চলার পথে মানুষ হাজারো রকমের ত্রুটি-বিচ্যুতি, ভুল করে। তাই গুনাহ করার সাথে সাথে ক্ষমা চাওয়া ও আল্লাহর কাছে তাওবা করা ফরজ। তাওবা আল্লাহর রাস্তায় চলা মানুষের অনুসরণীয় পথ, মুমিনের রসদ। উভয় জগতে সাফল্যের বড় মাধ্যম। আন্তরিক তাওবার মাধ্যমেই কেবল আখিরাতে মুক্তি সম্ভব। তাওবা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচার উপায়। এটি পাপ মুছে দেয়, ভুলত্রুটি ঢেকে রাখে, মানুষের হৃদয় ও মনকে সঠিক পথ দেখায়। এ জন্য নবী-রাসূল ও তাদের সাহাবিরা নিয়মিত ভালো আমল করা সত্ত্বেও অল্প ঘুমাতেন, শেষ রজনীতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা, ইস্তিগফার করতেন। পাপের কারণে ঈমানি শক্তি প্রায় অকার্যকর হয়ে থাকে। সে জন্যই তাওবাকারীকে নতুন করে ঈমানের ঘোষণা দিতে হয়। হাদিসে রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘চোর যখন চুরি করে, তখন সে মুমিন থাকে না। যেনাকারী যখন যেনা করে তখন সে মুমিন থাকে না; অর্থাৎ তখন তার মধ্যে ঈমানি চেতনা কার্যকর থাকে না। অতীত-বর্তমানের সব আলেম সর্বসম্মতিক্রমে এ বিষয়ে একমত যে, ছোট-বড় সব গুনাহ থেকে সাথে সাথে তাওবা করা ফরজ। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর সামনে তাওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (সূরা আন নূর-৩১)

আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে, পাপ করে বান্দা নিজের ওপর জুলুম করে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর স্বীয় অত্যাচারের পর তাওবা করো এবং সংশোধিত হয়, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সূরা মায়িদা-৩৯) তাওবা প্রত্যেক বান্দাদের জন্য অপরিহার্য। নবী-রাসূলরা যাবতীয় গুনাহ থেকে মুক্ত থাকার পরও আল্লাহর কাছে তাওবা ইস্তিগফার করতেন। কারণ তাওবাকারীদের আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা বাকারা-২২২) এ জন্য রাসূলুল্লাহ সা: দিনে অসংখ্যবার তাওবা ইস্তিগফার করতেন। হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে- রাসূল সা: বলেছেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমি প্রতিদিন ৭০ বারের বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই ও তাওবা করি।’ (বুখারি) অন্য বর্ণনায় আছে- তিনি বলেছেন, ‘হে মানুষেরা! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা করো ও ক্ষমা চাও। কেননা আমি প্রতিদিন ১০০ বার আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই।’ (সহিহ মুসলিম) রাসূলুল্লাহ সা: ছিলেন মাছুম বা নিষ্পাপ। যে ঘোষণা আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন, যেন আল্লাহ তোমার আগের ও পরের পাপ ক্ষমা করেন, তোমার ওপর তাঁর নিয়ামত পূর্ণ করেন আর তোমাকে সরল পথের হিদায়াত দেন।’ (সূরা ফাতহ-২) এভাবে সাহাবিরা সর্বদা ইস্তিগফার পাঠ করতেন। ফলে তারা আল্লাহর প্রিয় বান্দাতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। বান্দার তাওবা আল্লাহর খুশির কারণ। আনাস রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘বান্দাহ গুনাহ করার পর ক্ষমা ভিক্ষার জন্য যখন আল্লাহর দিকে ফিরে যায় তখন আল্লাহ সে ব্যক্তির তাওবার দরুণ ওই ব্যক্তির চেয়েও অধিক খুশি হন, যে ব্যক্তি নিজের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উট কোনো ময়দানে হারিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ তা পেয়ে যায়।’ (বুখারি ও মুসলিম)

সর্বদা তাওবার ব্যাপারে আবদুল্লাহ ইবনে হাবিব রহ: বলেন, ‘প্রতিবার গুনাহের সময় আল্লাহর যে ক্রোধ, তুমি কখনোই তা সহ্য করতে পারবে না। তাই সকাল-সন্ধ্যা তাওবা করো।’ একজন মানুষের যৌবন ও বার্ধক্য, সমৃদ্ধি ও দারিদ্র্য, সর্বাবস্থায় তাওবা করা জরুরি। ইমাম ইবনুল কাইয়ুম রহ: বলেন, তাওবার স্টেশন হলো একজন মুসাফিরের প্রথম স্টেশন, মাঝের স্টেশন এবং শেষের স্টেশন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাওবা তাকে ছেড়ে যায় না। যদি সে অন্য কোনো স্টেশনে যায় তবে তাওবার স্টেশনও তার সাথে যায়। তাওবা বান্দার শুরু ও শেষ। তাওবা বান্দার সফলতা ও ব্যর্থতার মূল।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ তায়ালার কাছে তাওবা করো, আন্তরিক তাওবা।’ (সূরা তাহরিম-৮) ইমাম ইবনে কাছির রহ: বলেন, আন্তরিক তাওবা হলো এমন সৎ ও দৃঢ় তাওবা যা আগের পাপগুলোকে মুছে দেয় এবং তাওবাকারীর মনে এমন অনুভূতির জন্ম দেয় যা ভবিষ্যতে তাকে গুনাহ থেকে দূরে রাখে। রবের প্রিয় হতে তাওবার বিকল্প নেই। মুফাসসিরগণ তাওবার কিছু শর্ত উল্লেখ করেছেন- এক. নিজেকে তাৎক্ষণিকভাবে গুনাহ থেকে বিরত রাখা; দুই. ভবিষ্যতে আর গুনাহের পুনরাবৃত্তি না করার ওয়াদা করা; তিন. অতীতের কৃত গুনাহের জন্য আন্তরিক অনুশোচনা করা; চার. কারো অধিকার নষ্ট হয়ে থাকলে, তার প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে দেয়া। প্রত্যেক মুমিন মুসলিমের সর্বদা আল্লাহর জিকির ও তাওবা করা অপরিহার্য কর্তব্য। তাওবাকারীদের আল্লাহ ভালোবাসেন। তাই আল্লাহ আমাদের একনিষ্ঠ তাওবাকারী হিসেবে কবুল করুন। আমিন।

লেখক : শিক্ষার্থী, আল কুরআন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

 


আরো সংবাদ



premium cement