২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রোজার মাসায়েল

-

যেসব কারণে রোজা ভঙ্গ হয় :
১. কানে ওষুধ বা তেল ঢাললে, নাকে ওষুধ ঢাললে বা নস্য টানলে অথবা পায়খানার জন্য ডুস নিলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়। পরে কাজা করতে হবে (জাওহারা ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪৫)।
২. রোজা অবস্থায় প্রস্রাবের রাস্তায় ওষুধ বা তেল ইত্যাদি প্রবেশ করালে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং কাজা করতে হবে (প্রাগুক্ত)।
৩. দাঁত দিয়ে রক্ত বের হওয়ার পর থুথুর সাথে সে রক্ত গিলে ফেললে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। পরে কাজা করতে হবে। কিন্তু রক্ত যদি থুথুর চেয়ে কম অর্থাৎ এতে রক্তের স্বাদ পাওয়া না যায়, তবে রোজা ভঙ্গ হবে না (কাজিখান ১ম খণ্ড, পৃ. ২৯৮)।
৪. ভুলক্রমে কোনো কিছু খেলে রোজা ভঙ্গ হয় না কিন্তু এ রূপ করার পর রোজা ভঙ্গ হয়ে গেছে মনে করে যদি কিছু খায়, তবে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং কাজা করতে হবে (কুদুুর, পৃ. ৮০)।
৫. ‘রাত আছে, সুবহে সাদেক হয়নি’ মনে করে যদি সাহরি খায়; পরে জানতে পারে যে, ওই সময় রাত ছিল না, তবে ওই রোজা হবে না। এমনিভাবে ‘সূর্য ডুবে গেছে মনে করে কেউ যদি ইফতার করে; পরে জানতে পারে যে, সূর্য ডুবেনি, তবে ওই রোজা হবে না। উভয় অবস্থাতেই রোজা কাজা করতে হবে (আলমগীরি)।
৬. সুরমা অথবা তেল লাগিয়ে অজ্ঞতাবশত যদি কেউ মনে করে যে তার রোজা ভেঙে গেছে এবং এ কারণে ইচ্ছা করে কিছু খাওয়া-দাওয়া করে, তবে কাজা ও কাফফারা উভয় ওয়াজিব হবে (আলমগীরি)।
৭. লোবান বা আগরবাতি জ্বালিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে এগুলোর ধোঁয়া গ্রহণ করলে রোজা ভেঙে যাবে। বিড়ি সিগারেট বা হুক্কার ধোঁয়াপান করলে রোজা ভেঙে যাবে। আতর ইত্যাদির সুঘ্রাণে রোজা ভঙ্গ হবে না (শামি)।
৮. দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা খাদ্যদ্রব্য খেলাল বা জিহ্বার দ্বারা বের করে মুখ থেকে বাইরে না ফেলে গিলে ফেললে যদি ওই খাদ্যদ্রব্য একটি বুটের পরিমাণ অথবা তার চেয়ে বেশি হয়, তবে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে, তা কাজা করতে হবে। আর যদি একটি বুট অপেক্ষা কম হয় তবে রোজা ভঙ্গ হবে না। আর যদি মুখ থেকে বাইরে এনে তারপর গিলে ফেলে তবে তা একটি বুটের পরিমাণের চেয়ে কম হলেও রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে; কাজা করতে হবে (আলমগীরি ১ম খণ্ড, পৃ. ২০৮)।
৯. কুলি করার সময় গলার ভেতরে পানি চলে গেলে রোজা ভেঙে যাবে রোজার কথা স্মরণ থাকুক বা না থাকুক। এই রোজা কাযা করতে হবে (শামি, দুররেমুখতার, পৃ. ১৫০)।
১০. ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ভরে বমি করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। আর অল্প বমি করলে রোজা ভঙ্গ হবে না (প্রাগুক্ত, শামি)।
১১. যদি কঙ্কর অথবা লোহা বা সিসার টুকরা কিংবা এমন কোনো জিনিস গিলে ফেলে, যা সাধারণত লোকেরা খাদ্যরূপেও খায় না এবং ওষুধরূপেও সেবন করে না, তবে এতে রোজা ভেঙে যাবে এবং একটি রোজা কাজা করতে হবে। আর যদি এমন জিনিস গিলে ফেলে, যা লোকে খাদ্যরূপে সেবন করে, তবে রোজার কাজাও করতে হবে এবং কাফফারাও দিতে হবে (হেদায়া)।
১২. রোজা রেখে দিনের বেলায় স্ত্রী সম্ভোগ করলে এমনকি খৎনা স্থান প্রবেশ করালে বীর্যপাত হোক বা না হোক রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং কাজা ও কাফফারা উভয় ওয়াজিব হবে (শরহুবিদায়াহ)।
১৩. স্ত্রীর শরীরে হাত লাগানো কিংবা চুমু দেয়ার দরুন বীর্যপাত হলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং কাজা করতে হবে (শবহুবিদায়া)।
যেসব কারণে রোজা মাকরূহ হয় :
১. জিহ্বার অগ্রভাগ দিয়ে কোনো জিনিসের স্বাদ দেখে থুথু ফেলে দিলে রোজা ভঙ্গ হয় না; কিন্তু বিনা প্রয়োজনে এ রূপ করা মাকরূহ। অবশ্য কারো স্বামী যদি জালেম ও পাষাণ হৃদয়ের হয় যে, তরকারির লবণ একটু কমবেশি হলে নির্যাতন শুরু করে, সে ক্ষেত্রে স্বাদ দেখে থুথু ফেলে দেয়া মাকরূহ নহে।
২. রোজা অবস্থায় শিশুর খাওয়ার জন্য কিছু চিবিয়ে দেয়া মাকরূহ। অবশ্য শিশুর জীবন ওষ্ঠাগত হলে এবং অন্য কেউ চিবিয়ে দেয়ার মতো না থাকলে চিবিয়ে দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে ফেলা জায়েজ (শামি)।
৩. রোজা রেখে দিনের বেলায় স্বামী-স্ত্রীর একসাথে শোয়া, একে অন্যের শরীরে হাত দেয়ায় ও চুমু দেয়ায় যদি কাম-ভাব প্রবল হয়ে সম্ভোগের আশঙ্কা হয়, তবে এরূপ করা মাকরূহ।
৪. রাতে গোসল ফরজ হলে সুবহে সাদিকের পূর্বেই গোসল করে নেয়া উচিত, কিন্তু গোসল করতে দেরি করলে কিংবা সারা দিন গোসল না করলে যদিও রোজা ভঙ্গ হবে না কিন্তু বিনা প্রয়োজন নাপাক থাকায় গোনাহ হবে।
৫. রোজা অবস্থায় কয়লা, মাজন, ছাই, বালু ও টুথপেস্ট দ্বারা দাঁতমাজা মাকরূহ। এর কিছু অংশ যদি কণ্ঠনালির নিচে চলে যায়, তবে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে।
৬. সিংগা লাগানো ও রুগির জন্য নিজের রক্ত দেয়া মাকরূহ। তবে রক্তদানের কারণে রোজা ভঙ্গ হবে না (জাওয়াহিরুল ফিকহ)।
৭. গিবত অর্থাৎ, পরনিন্দা সর্বাবাস্থায় হারাম। রোজা অবস্থায় আরো ভয়াবহ পাপ (জাওয়াহিরুল ফিকহ)।
৮. রোজা অবস্থায় ঝগড়া-বিবাদ করা, কোনো মানুষকে গালি দেয়া কিংবা কোনো প্রাণী বা নিষ্প্রাণ বস্তুকে কষ্ট দেয়ার দ্বারা রোজা মাকরূহ হয় (জাওয়াহিরুল ফিকহ)।
যেসব কারণে রোজা ভঙ্গ/মাকরূহ হয় না
১. রোজা রেখে দিনে ঘুমালে ও স্বপ্নদোষ হলে রোজা ভঙ্গ হয় না (হেদায়া)।
২. চোখে সুরমা লাগানো বা ওষুধ ব্যবহার করা, মাথা, চুল দাঁড়ি ও শরীরে তেল লাগানো এবং আতরের ঘ্রাণ নেয়া বৈধ। এমনকি চোখে সুরমা লাগানোর পর যদি থুথু কিংবা শ্লেষ্মার সাথে সুরমার রঙ দেখা যায় তবুও রোজা মাকরূহ হয় না (প্রাগুক্ত)।
৩. মুখের থুথু যত বেশিই হোক না কেন, তা গিলে ফেললে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না (তাহতাবি)।
৪. সাহরি খাওয়ার পর পান খাওয়া হলে সুবহে সাদিকের পূর্বেই উত্তমরূপে কুলি করে মুখ পরিষ্কার করে নেয়া উচিত। এরপরও যদি সকালে থুথুর সাথে কিছু লালা দেখা যায় তবে এতে রোজা ভঙ্গ হবে না।
৫. রোজা অবস্থায় ইনজেকশন বা টিকা নিলে রোজা ভঙ্গ হয় না তবে খাওয়া নিবারণ হয় এ রূপ ইজেকশনে ভঙ্গ হয়ে যাবে (জাওয়াহিরুল ফিকহ)।
৬. নাকের শ্লেষ্মা কণ্ঠনালির ভেতরে চলে গেলে রোজা নষ্ট হয় না।
৭. রোজার কথা ভুলে গিয়ে কিছু খেয়ে ফেললে কিংবা সহবাস করলে এতে রোজা ভঙ্গ হয় না। কিন্তু খাওয়া শুরু করার পর স্মরণ হলে তৎক্ষণাৎ বন্ধ করতে হবে। স্মরণ হওয়ার পর সামান্য কিছু খেলে ও রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে।
৮. অনিচ্ছাকৃত বমি বেশি কিংবা কম এতে রোজা নষ্ট হয় না (শামি)।
৯. অনিচ্ছাকৃত বমি কণ্ঠনালির ভেতর চলে গেলেও রোজা নষ্ট হয় না। অবশ্যই যদি ইচ্ছা পূর্বক বমি করে, সে ক্ষেত্রে কম হলেও রোজা নষ্ট হয়ে যাবে।
১০. কান দিয়ে পানি পড়লে রোজা ভঙ্গ হয় না (জাওয়াহিরুল ফিকহ)।
১১. কাঁচা বা শুকনা মিসওয়াক দ্বারা দাঁত মাজা জায়েজ। এমনকি নিমের কাঁচা ডালের দ্বারাও যদি মিসওয়াক করা হয় এতেও রোজার কোনো ক্ষতি হবে না; মাকরূহও হবে না।
১২. রোজা অবস্থায় রক্ত দিলে বা রক্ত বের হলে রোজা ভঙ্গ হয় না। তবে বেশি দুর্বল হয়ে পড়লে মাকরূহ হবে।
যেসব অবস্থায় রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ
১. রোজা অবস্থায় যদি এমন কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে যে, কিছু ওষুধ ও খাবার না খেলে জীবনের আশঙ্কা হতে পারে বা রোগ বেড়ে যেতে পারে, যেমন হঠাৎ পেটে ব্যথা দেখা দিলেও সাপ দংশন করলে এমতাবস্থায় রোজা ছেড়ে দিয়ে ওষুধ সেবন করা জায়েজ (হেদায়াত ১ম খণ্ড, পৃ. ২০১)।
২. গর্ভবতী নারী যদি এমন কোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়, যাতে তার গর্ভস্থিত সন্তানের জীবনের জন্য আশঙ্কা হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ (শরহুল বিদায়াহ ১ম খণ্ড, পৃ. ২০২)।
৩. তৃষ্ণায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার উপক্রম হলে (দুররে মুখতার)।
যেসব কারণে রোজা না রাখা জায়েজ :
১. এমন রোগাক্রান্ত ব্যক্তি যে রোজা রাখলে তার রোগ বেড়ে যাবে কিংবা রোগ দুরারোগ্য হয়ে যাবে কিংবা মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, এ ক্ষেত্রে রোজা না রেখে সুস্থ হওয়ার পর কাজা করবে। কিন্তু নিজের খেয়ালে রোজা ছেড়ে দেয়া জায়েজ হবে না। এ জন্য মুসলমান দ্বীনদার বিজ্ঞ চিকিৎসকের নির্দেশ ও প্রাজ্ঞ মুফতির পরামর্শ প্রয়োজন হবে (দুররেসমুখতার ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫৩)।
২. আরোগ্য হওয়ার পর দুর্বল অবস্থায় রোজা রাখলে যদি পুনরায় রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে, তবে রোজা না রেখে পরে কাজ করা জায়েজ আছে (প্রাগুক্ত)।
৩. যারা শরিয়ত অনুসারে মুসাফির তারা সফরে থাকাকালীন রোজা না রেখে অন্য সময় রাখতে পারে। যে ব্যক্তি ৪৮ মাইল বা তদূর্ধ্ব দূরবর্তী স্থানে যাওয়ার ইচ্ছা করে নিজ বাসস্থানের সীমা অতিক্রম করেছে, সে ‘মুসাফির’ (হেদায়া)।
৪. সফরে কষ্ট না হলে রোজা রাখাই উত্তম। তবুও যদি না রাখে, (পরে কাজা করে) তবে গোনাহগার হবে না (প্রাগুক্ত)।
৫. সফরে বের হওয়ার পর বিদেশে কোনো স্থানে ১৫ দিন বা এর চেয়ে বেশি অবস্থান করার নিয়ত করলে সে মুসাফির থাকে না, মুকিম হয়ে যায়। সুতরাং মুকিম অবস্থায় তাকে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে (শামী ২য় খণ্ড, পৃ ১৬৮)।
৬. গর্ভবতী নারী অথবা সদ্যপ্রসূতি রোজা রাখলে যদি নিজের বা শিশুর জীবননাশের আশঙ্কা হয়, তবে তার জন্য রোজা না রাখা জায়েজ (প্রাগুক্ত)।
৭. রোজার মধ্যে হায়েজ বা নেফাস হলে, এ অবস্থায় রোজা রাখা জায়েজ নয়, পরে কাজা করে নেবে। (জাওহারাহ ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪৮)।
৮. রাতে যদি কোনো মহিলার হায়েজ বন্ধ হয়, তবে সকালে রোজা ছাড়বে না। যদি রাতে গোসল নাও করে থাকে তবুও রোজা রেখে দেবে এবং সকালে গোসল করে নেবে। আর যদি সুবহে সাদিক হওয়ার পর ঋতুস্রাব বন্ধ হয়, তখন রোজার নিয়ত করা জায়েজ হবে না। অবশ্যই দিনভর কিছু পানাহার করা ঠিক নয়; রোজাদারের মতো থাকবে (প্রাগুক্ত)।
৯. কোনো মহিলা যদি ঋতুস্রাবরোধক ট্যাবলেট সেবন করে স্রাব বন্ধ রেখে রমজান মাসের রোজা পূর্ণ করে, তবে স্বাস্থ্যের জন্য কোনোরূপ ক্ষতির কারণ না হলেও এরূপ করা ঠিক নয়। বড় কোনো ওজর বা প্রয়োজন না থাকলে আল্লাহর দেয়া স্বাভাবিক বিধান যথাযথভাবে মেনে নিয়ে তা অনুযায়ী আমল করাই উত্তম। আল্লাহ তায়ালা আমাদের যথাযথভাবে রোজা পালন করার তাওফিক দান করুন, আমিন।
প্রধান ফকীহ্: আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদ্রাসা, ফেনী

 


আরো সংবাদ



premium cement