মহান রাব্বুল আলামিন রমজান মাসের সাওমকে মুমিনদের জন্য যে ফরজ করেছেন তা অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময়। সিয়ামুন শব্দটি ‘সাওমুন’-এর বহুবচন, শরিয়তের পরিভাষায় সিয়াম হলো কিছু বিশেষ শর্তসাপেক্ষে বিশেষ বিষয় হতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিশেষভাবে বিরত থাকা (ফাতহুল বারি চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০৭)। রমজান শব্দটি আরবি, ‘রমজুন’ শব্দ থেকে উৎগত হয়েছে। শাব্দিক অর্থ হচ্ছেÑ জ্বালিয়ে দেয়া, ভস্মীভূত হওয়া। হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে রমজানের এক মাস রোজা ফরজ করা হয়, মুমিনের জন্য জীবনের পাথেয় অর্জন করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এই রমজান মাস। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হলো যেমনভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো’ (সূরা বাকারা-১৮৩)।
প্রকৃতপক্ষে আধ্যাত্মিক-নৈতিক উন্নতি, পারস্পরিক সহানুভূতি-সহমর্মিতা, সামাজিক উন্নয়ন-সম্প্রীতি অর্জনের লক্ষ্যে রোজার কঠোর সংযম সাধনা এক অনন্য ইবাদত। মুসলিম সমাজে রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাপক ও অসাধারণ। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিতÑ রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘রমজান মাস শুরু হলেই রহমতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শিকলে আবদ্ধ করা হয়’ (বুখারি-১৮৯৮)।
আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসকে বিশেষ বিশেষ কিছু সময় দিয়ে বিশেষভাবে সজ্জিত করেছেন, এগুলো হলোÑ
সাহরি : সাহরি উর্দু শব্দ, আরবি শব্দ সুহুর থেকে সাহরি শব্দের উদ্ভব। এর অর্থ-প্রতিবর্ণী নিদ্রাভঙ্গ, ঘুম থেকে জেগে ওঠা। সুহুর, অর্থÑ ‘ঊষার পূর্বের খাবার, সাহরি দোয়া কবুলের জন্য শৈল্পিক এক সময়। ফাতহুল বারিতে উল্লেখ আছেÑ ‘সাহরির ফলে রোজা ও ইবাদতের শক্তি অর্জিত হয়, ক্ষুধা ও পিপাসা থেকে সৃষ্টির খারাপ অভ্যাস দূর হয়, একজন মুমিন বান্দার জন্য সাহরিতে রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা।’ সাহরির সময় ইস্তিগফারকারীদের আল্লাহ প্রশংসা করেছেন, আল্লাহ বলেনÑ ‘আর আহার করো ও পান করো যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কালো রেখা থেকে স্পষ্ট হয়’ (সূরা বাকারা-১৮৭)।
রাব্বুল আলামিন মহাগ্রন্থে সাহরি সম্পর্কে আয়াত নাজিল করেছেন, সাহরির পবিত্রতার দলিল এর চেয়ে অধিক উৎকৃষ্ট আর কী হতে পারে। সাহরি সম্পর্কে রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা সাহরি খাও, কারণ সাহরি খাওয়ার মধ্যে বরকত নিহিত রয়েছে’ (বুখারি ও মুসলিম)।
ইফতার : রোজাদার ব্যক্তির জন্য ইফতার একটি আনন্দ ও সৌভাগ্যের মুহূর্ত। রাসূল সা: বলেন, ‘লোকেরা ততক্ষণ কল্যাণে থাকবে যতক্ষণ তারা ইফতার জলদি করবে’ (বুখারি, মুসলিম প্রথ খণ্ড-৩২১ পৃষ্ঠা, মিশকাত-১৭৫ পৃষ্ঠা)।
ইফতার শব্দটি আরবি ফুতুর শব্দ থেকে এসেছে। ফুতুরÑ অর্থ নাশতা। ইফতারের অর্থ খোলা, ছেড়ে দেয়া। ইসলামী পরিভাষায় সূর্যাস্তের পর খেজুর, পানি বা কোনো খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণের মাধ্যমে রোজা ছেড়ে দেয়াকে ইফতার বলে। ইফতারের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে স্বয়ং রাসূল সা: বলেছেন, ‘রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দের সময় রয়েছেÑ ১. ইফতারের সময় ও ২. মহান আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময়’ (বুখারি ও মুসলিম)।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় সেই বান্দা যে ইফতার সঠিক সময়ে করে’ (তিরমিজি প্রথম খণ্ড-৮৮ পৃষ্ঠা, মিশকাত-১৭৫ পৃষ্ঠা)। এ হাদিসগুলো প্রমাণ করে, ইফতারের নির্দিষ্ট সময় থেকে দেরি করা মোটেই উচিত নয়।
কুরআন নাজিলের মাস : বায়তুল ইজ্জতে পবিত্র কুরআন লাওহে মাহফুজ থেকে একত্রে নাজিল হয়েছে রমজান মাসে। মহিমান্বিত এ মাসের শোকরিয়া আদায়স্বরূপ বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা আবশ্যক। বিভিন্ন সিরাত গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছেÑ হাবিবে রাসূল সা: এ পবিত্র মাসে জিবরাইল আ:কে পুরো কুরআন শোনাতেন। রব্বে কারিম বলেন, ‘রমজান মাস, এতে নাজিল হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের জন্য দিশারি ও স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী’ (সূরা বাকারা-১৮৫)।
লাইলাতুল কদর : লাইলাতুল কদরের রাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে অধিক পরিমাণে কল্যাণ বর্ষিত হয়। রাসূল সা: ছিলেন অন্য সবার চেয়ে ইবাদতে অগ্রগামী, তবে অন্যান্য সময়ের ইবাদতের চেয়ে রমজানের শেষ দশকের রাতসমূহে তাঁর ইবাদত অধিক ছিল। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আমি এটি নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। তোমাকে কিসে জানাবে ‘লাইলাতুল কদর’ কী? ‘লাইলাতুল কদর’ হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতারা ও রূহ (জিবরাইল) তাদের রবের অনুমতিক্রমে সব সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে। শান্তিময় সেই রাত, ফজরের সূচনা পর্যন্ত’ (সূরা কদর : ১-৫)।
লাইলাতুল কদর কল্যাণের রজনী, মুমিন বান্দার উচিত লাইলাতুল কদর তালাশ করা, আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেনÑ ‘লাইলাতুল কদরে যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের নিয়তে কিয়াম করবে, তার আগের সব পাপ মোচন করা হবে’(বুখারি-৩৫, মুসলিম-৭৬০)।
বাবে রাইয়ান ও রোজাদারের পুরস্কার : বাবে রাইয়ান জান্নাতের একটি দরজার নাম, রাইয়ান শব্দটি ‘আরোয়ি’ থেকে উৎপন্ন হয়েছে, অর্থÑ যা পিপাসার বিপরীত। রোজাদার পিপাসার্ত হয়েও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পানি পান থেকে বিরত থাকে তাই তার যথার্থ প্রতিদান হিসেবে আখিরাতে তাকে এমন পানি পান করানো হবে; যে পানি পান করার পর আর কখনো তৃষ্ণার্ত হবে না। রোজাদারের জন্য পুরস্কার স্বয়ং রব্বে কারিম দেবেন, রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহ বলেছেন বনি আদমের সব আমল তার জন্য, অবশ্য রোজার কথা আলাদা। কেননা, রোজা আমার জন্য এবং আমিই এই পুরস্কার দেবো’ (বুখারি-১৮০৫)। রাসূল সা: বলেন, ‘যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ তাঁর শপথ, রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকে আম্বরের চেয়েও সুগন্ধিময়’ (বুখারি-১৮৯৪)।
চারিত্রিক এবং অভ্যন্তরীণ মাহাত্ম্য অর্জন : আমাদের পছন্দের সুস্বাদু ফল ফলাদির একটি নির্দিষ্ট সময় আছে, মৌসুম আছে, যে মৌসুমে সেই ফল পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়। রব্বে কারিম ইবাদত-বন্দিগি এবং চারিত্রিক মাহাত্ম্য অর্জনের জন্য মুসলমানদের একটি মৌসুম দিয়েছেন, যে মৌসুমে মহাগ্রন্থ কুরআনুল কারিম নাজিল হয়েছে। কিন্তু বে-বুঝ দিলো গাফেল মুসলিমরা এই পবিত্র মাসকে গোনাহের মৌসুম বানিয়ে ফেলে, অনেক ক্ষেত্রে গোনাহের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। রাসূল সা: বলেন, ‘রমাদান মাসের সূচনালগ্নেই জাহান্নামের সব দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়,শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয় এবং জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়’ (বুখারি-৩২৭৭)।
রমজানের এই বিশেষ সময়ে তাওবার মাধ্যমে রবের প্রিয় হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে, যে সৌভাগ্যবান কেবল সেই পারে এই সুযোগ কাজে লাগাতে। আল্লাহ আমাদের অন্তরে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার তীব্র ব্যাকুলতা জাগিয়ে দিন! রমজান প্রকৃত মুমিনের অন্তরকে বিভিন্ন উপায়ে পরিশুদ্ধ করেÑ
১. তাকওয়া অর্জন : ছোট ছোট শিলাখণ্ড সুবিশাল পর্বতের রূপ ধারণ করে, সে জন্য বড় গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার পাশাপাশি ছোট ছোট গোনাহ থেকেও বেঁচে থাকতে হবে, তাকওয়ার মূল বিষয় হচ্ছে অন্তরে সর্ব অবস্থায় রবের ভয় জাগরিত রাখা।
২. সবর : সবর ও ধৈর্যের অভ্যাস গড়ে তোলা ও প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে ইচ্ছাশক্তিকে শাণিত করা। আল্লাহ সুবহানার পক্ষ থেকে ধৈর্যশীলদের জন্য বিশেষ পুরস্কার রয়েছে।
৩. মহানুভবতা : ব্যক্তি যখন ক্ষুধার্থ থাকার যাতনা অনুভব করবে, অভাবগ্রস্তদের প্রতি তার অন্তর ও অনুভূতি কোমল হবে; দরিদ্র ও নিঃস্বদের দয়া ও মমতা প্রদর্শনের প্রতি মানুষকে অভ্যস্ত করে তোলা। পানি যেমন আগুনকে নিভিয়ে দেয়, বদান্যতাও তদ্রƒপ আল্লাহ তায়ালার ক্রোধাগ্নিকে নির্বাপিত করে দেয়।
মাহে রমজান রহমত, বরকত, মাগফিরাত এবং মহা বিজয়ের মাস। ইতিহাস সাক্ষীÑ বদর, হিত্তিন, আন্দালুস বিজয়সহ ইসলামী ইতিহাসের আরো উল্লেখযোগ্য কিছু বিজয় সংঘটিত হয়েছিল রমজান মাসে। রব্বে কারিম! রমজান অবধি আমাদের সুস্থ ও নিরাপদ রাখুন, রমজানের জন্যও নিরাপদ রাখুন, আমাদের অন্তরের রোগ নিরাময় করে দিন এবং আমাদের এই মাস কবুল করে নিন, আমীন।
লেখিকা : শিক্ষার্থী, আল কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, আরবি বিশ্ববিদ্যালয়
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা