২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সমাজ পরিবর্তনে জুমার খুতবা

-

সালাতুল জুমা মুসলিম উম্মাহর সাপ্তাহিক এক মহামিলনকেন্দ্র। মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অঙ্গন। যে সংস্কৃতি লালনের মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে ঐক্য, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় হয়। একই সমাজে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী এক ইমামের পেছনে সারিবদ্ধ হয়ে শ্রেণিবৈষম্য ব্যতিরেকে সব ভেদাভেদ ভুলে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য দুই রাকাত নামাজ আদায় করে থাকে। এর মধ্য দিয়ে সামাজিক সম্পর্ক যেমন মজবুত হয় তেমনি আত্মিক উন্নয়নও সাধিত হয়। দ্বিতীয় হিজরিতে সালাতুল জুমা মুসলিমদের ওপর ওয়াজিব করা হয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন সালাতের জন্য আহ্বান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ করো, ইহাই তোমাদের জন্য শ্রেয় যদি তোমরা উপলব্ধি করো।’ (সূরা জুমা-৬২ : ৯) এ আয়াতে আল্লাহর ‘জিকর’ (স্মরণ) বলতে কি বুঝানো হয়েছে সে বিষয়ে কয়েকটি মত রয়েছে।
কেউ বলেছেন, এখানে জিকর বলতে জুমার সালাত বুঝানো হয়েছে, কেউ বলেছেন, জিকর বলতে জুমার খুতবা বুঝানো হয়েছে, কেউ বলেছেন সালাত ও খুতবা উভয়কেই বুঝানো হয়েছে। আল্লামা কুরতুবি বলেন, ‘জিকর’ অর্থ সালাত। সাঈদ ইবন যুবাইর বলেন, ‘জিকর’ অর্থ খুতবা ও ওয়াজ (তাফসিরে কুরতুবি-১৮/১০৭) জুমার নামাজের জন্য ডাকা হলে দুনিয়ার সব প্রকার ঝামেলা, কাজ-কর্ম ও ব্যস্ততা বাদ দিয়ে আগে আগে মসজিদে যাওয়ার বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়েছে। আমরা মুসলমানরা প্রতি সপ্তাহে জুমার নামাজ আদায় করে থাকি, খুতবা শুনে থাকি। কিন্তু আমরা কি কখনো গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছি কেন অন্যান্য ওয়াক্তিয়া নামাজের চাইতে জুমার নামাজ ব্যতিক্রম! কেন এ নামাজের গুরুত্ব অনেক বেশি? এ নামাজের রয়েছে অনন্য এক বৈশিষ্ট্যÑ তা হলো খুতবা। খুতবা আরবি শব্দ। এর বাংলা হলোÑ ভাষণ, বক্তব্য, বর্ণনা, উপদেশ, আলোচনা, কথা ইত্যাদি। পরিভাষায়Ñ ‘আল্লাহর প্রশংসা, তাঁর গুণ বর্ণনা, রাসূলুল্লাহ সা:-এর ওপর সালাত, মুসলিমদের জন্য দোয়া ও তাদের ওয়াজ ও স্মরণ করানোর নামই হলো খুতবা।’ (কাসানি, বাদাইউস সানাইয় ১/২৬২) জুমার দিনে দুটি খুতবা দেয়া হয়। যাকে ‘খুতবাতুল আউয়াল’ ও ‘খুতবাতুস সানি’ বলা হয়।
রাসূলুল্লাহ সা: দুটি খুতবা দিতেন, এতদুভয়ের মাঝে বসতেন, তিনি কুরআন পাঠ করতেন এবং মানুষদের জিকর বা স্মরণ করাতেন অর্থাৎ ওয়াজ করতেন। (মুসলিম, আস-সহিহ ২/৫৮৯) খুতবায় ইমাম সাহেব উপস্থিত মুসল্লিদের উপদেশ দিয়ে থাকেন, নসিহত করে থাকেন, সমাজ সংশোধনের কথা বলে থাকেন। আজকের জুমা থেকে আগামী জুমা পর্যন্ত মধ্যকার সময়ে কী করণীয় আছে এসব বিষয়ে ইমাম সাহেব দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। লক্ষ্যণীয় যে, আমাদের অনেক ইমামরা বাংলায় যা বলে থাকেন তার সাথে আরবি খুতবার তেমন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ এমনটা সমীচীন নয়। বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে বাংলায় বলতে হয়; তাই বলে বাংলা ও আরবির মাঝে ব্যাপক তফাৎ থাকবে এমনটা হওয়া কাম্য নয়। বরং আরবিতে যা আছে তার বাংলা বলাটাই শ্রেয়। খুতবা যাতে দুর্বোধ্য না হয়; খুতবা যেন সামাজিক ও ধর্মীয় কল্যাণে হয়ে থাকে সেদিকে দৃষ্টি রাখা উচিত। ইমামের খুতবা যেন সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী বা জনপদের মানুষের চলার পথকে সুগম ও সুশৃঙ্খল করে তোলে সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। যেমনÑ রাসূল সা:-এর খুতবা দানের ব্যাপারে হাদিসে এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ সা: যখন খুতবা দিতেন তখন তাঁর চক্ষুদ্বয় লাল হয়ে যেত, তাঁর কণ্ঠস্বর উঁচু হতো এবং তাঁর ক্রোধ কঠিন হতো। এমনকি মনে হতো তিনি যেন আসন্ন শত্রুসেনার আক্রমণের সতর্ককারী।’ (মুসলিম, আস-সহিহ ২/৫৯২) ইমামদের খুতবা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সামাজিক পরিস্থিতি, সমসাময়িক ঘটনা, সামাজিক ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্য যেন খুতবায় স্থান পায় সে বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত।
সে জন্য রাসূল সা: কর্তৃক প্রদত্ত খুতবা, সাহাবি, তাবেয়ি, তাবে-তাবেয়িদের খুতবা অনুসরণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ জুমার দিনের খুতবা যেন সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে সেদিকে ইমামদের লক্ষ রাখতে হবে। প্রথম খুতবায় নির্দিষ্ট যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় তা যেন সমসাময়িক কোনো ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসে। আর দ্বিতীয় খুতবায় সচরাচর রাসূল সা:-এর বংশধরদের জন্য দোয়া, মুসলমানদের জন্য দোয়া, আসমানি ও জমিনি গজব থেকে পরিত্রাণের জন্য দোয়া, জীবিত ও মৃতদের জন্য দোয়া। এভাবে বিভিন্ন প্রকার দোয়ায় সম্বলিত থাকে দ্বিতীয় খুতবা। গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে যুগ-জিজ্ঞাসার আলোকে খুতবা উপস্থাপন করা জরুরি। যাতে করে জুমার নামাজের প্রকৃত যে উদ্দেশ্য তা যেন হাসিল করা সম্ভব হয়। খুতবার মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে, ইমাম শুধু মসজিদের ভেতরই নয় বরং মসজিদের বাইরে তথা গোটা সমাজের জন্যই তিনি ইমাম (নেতা)।
বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি দুই লাখ ৫০ হাজার ৩৯৯টি জামে মসজিদ আছে (১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, জাতীয় সংসদে ধর্মপ্রতিমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের দেয়া তথ্য)। প্রত্যেক মসজিদে গড়ে ২০০ করে মুসল্লি হলে মোট মুসল্লির সংখ্যা পাঁচ কোটি ৭৯ হাজার ৮০০ জন। পাঁচ কোটির বেশি মুসলিম সারা বাংলাদেশে একযোগে জুমার নামাজ আদায় করে থাকে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব, উঁচু-নীচু সকল ভেদাভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ রেখে একই ইমামের পেছনে আনুগত্য প্রকাশ করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নামাজ আদায় এ যেন মুসলিম সংস্কৃতির এক মহামিলনকেন্দ্র। তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ সব শ্রেণিপেশার লোকজন সমবেত হয়ে ইসলামিক আমেজে মসজিদকে পরিপূর্ণ করে তোলে। আমজনতার মাঝে ইসলামের কথাগুলো তুলে ধরার জন্য এটি একটি সহজ, সাবলীল ও সামষ্টিক মাধ্যম। ইসলামী দাওয়াহ
সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে জুমার খুতবা হিকমতপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এক সপ্তাহের বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষকে এমনভাবে নার্সিং করা যাতে পরবর্তী জুমা আসা পর্যন্ত মানুষ আগের জুমার আলোচনা বাস্তব জীবনে মেনে চলে। এ ক্ষেত্রে আলোচনা নির্ধারণের বিষয়ে ইমামদেরকে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। আলোচনায় যেন সমসাময়িক ঘটনাবলি, সামাজিক সমস্যা ও সম্ভাবনাসমূহ উঠে আসে। সমাজে বসবাসকারী মানুষ যেন জুমার খুতবা থেকে পরিবর্তন ও আত্মশুদ্ধির পথ খুঁজে পায়। নৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে জুমার খুতবা যেন পরিবর্তন বয়ে আনতে সক্ষম হয়। একটি ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ইতিবাচক ফলাফল ও নৈতিকগুণে সমৃদ্ধ পরিবেশ তৈরি করা ইমামের দায়িত্ব। কেননা, হাদিসে এসেছে রাসূল সা: যখন খুতবা দিতেন তখন তিনি বলতেন, ‘আমি তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে সতর্ক করছি! আমি তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে সতর্ক করছি! আমি তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে সতর্ক করছি!’ (আহমদ, আল-মুসনাদ ৪/২৬৮; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৪২৩) কাজেই ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে জুমার খুতবার যথেষ্ট তাৎপর্য রয়েছে। একই সমাজে বসবাসকারী মানুষের মাঝে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য স্থাপনে জুমার খুতবার অসামান্য গুরুত্ব ও ভূমিকা রয়েছে। সমাজ জীবনে খুতবার ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারের জন্য যুগোপযোগী ও সৃজনশীল খুতবার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : এমফিল গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement
ছেলেদের কারণে বিপাকে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির দুই বিভাগে বৃষ্টি হতে পারে ফ্রান্স, ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ে সফরে যাচ্ছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী থাইল্যান্ড সফরকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে মাইলফলক বললেন প্রধানমন্ত্রী লালমনিরহাটে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী যুবক নিহত এখনো শেষ হয়নি বিতর্কিত আউটের রেশ, ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ মুশফিকের ‘ফ্রি ভিসার গল্প’ আর শূন্য হাতে ফেরা লাখো শ্রমিক নোয়াখালীতে প্রবাসীর স্ত্রীর ব্যক্তিগত ছবি দেখিয়ে চাঁদা আদায় দেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে, অথচ বিরোধী দল দেখে না : কাদের আশুলিয়ায় বাঁশবাগান থেকে নারী পোশাক শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ফেরত গেলেন, কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট কি আরো জটিল হচ্ছে

সকল