২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইসলামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

-

একটি দেশ বা সমাজে বহু জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও ভাষাভাষীর মানুষের বসবাস। বসবাসরত এসব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যকার ঐক্য, সংহতি ও সহযোগিতার মনোভাবই হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। মানবসমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্ব অপরিসীম। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মানুষের মধ্যে ধৈর্য, সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ ঘটায়। সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশ ও জাতি উন্নতির শিখরে আরোহণ করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত না করে কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনুপস্থিতিতে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সঙ্ঘাতের সূত্রপাত ঘটায়, এমনকি গৃহযুদ্ধেও রূপ নেয়।
ইসলাম শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম। এটি এমন এক সর্বজনীন ও শান্তিময় জীবনব্যবস্থা যেখানে মানব সম্প্রদায়ের সবারই অধিকার বিধৃত হয়েছে। দেশ, জাতি ও ভৌগোলিক সীমারেখার ঊর্ধ্বে ইসলামের পরিধি। সব মানুষই এক আল্লাহর সৃষ্টি এবং একই জাতির। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সব মানুষ ছিল একই জাতিভুক্ত। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা পয়গম্বর পাঠালেন সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে।’ (সূরা বাকারা : ২১৩) তাই সৃষ্টিগতভাবে সমগ্র মানবগোষ্ঠী বিশ্বভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। এ ভ্রাতৃত্ব বিশ্বমানবতার মৌলিক ভ্রাতৃত্ব। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পারো।’ (সূরা হুজুরাত : ১৩) রাসূল সা: বলেছেন, ‘সব মানুষই আদম আ:-এর বংশধর, আর আদম মাটি থেকে সৃষ্ট।’ (তিরমিজি)
হজরত আদম আ: থেকে শুরু করে হজরত মুহাম্মদ সা: পর্যন্ত যত পয়গম্বর কালিমার দাওয়াত দিয়েছেন তাদের কেউ কখনোই কারো ওপর দীনের বোঝা চাপিয়ে দেননি। ইসলামের ইতিহাসে এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই, যেখানে মুসলমানরা জোর করে কাউকে ইসলামে দীক্ষিত করেছেন। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘দীনের মধ্যে কোনো জবরদস্তি নেই।’ (সূরা বাকারা : ২৫৬) ইসলাম সব ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। ধর্ম পালনে কেউ বাধাগ্রস্ত হবে না। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের দীন তোমাদের জন্য, আমার দীন আমার জন্য।’ (সূরা কাফিরুন : ০৬) তাই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ, উপাসনালয় ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে কোনোরূপ ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা (মূর্তিপূজক) ডাকে, তাদের তোমরা গালি দিও না। তাহলে তারা সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকেও গালি দেবে।’ (সূরা আনয়াম : ১০৮)
ধর্মীয় স্বাধীনতা দানের পাশাপাশি অন্য সব ক্ষেত্রেই সম্প্রীতি রক্ষা করা ইসলামের অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য। সম্প্রদায় ভিন্ন হলেও মানুষ একে অপরের সহপাঠী, সহকর্মী, খেলার সাথী, শিক্ষক, প্রতিবেশী কিংবা পরিচিতজন। প্রত্যেকের উচিত তাদের সাথে সর্বদা ভালো ব্যবহার করা এবং কোনোরূপ অন্যায় আচরণ না করা। অমুসলিমদের জান-মাল-ইজ্জত সংরক্ষণের ব্যাপারে রাসূল সা: কঠোর সতর্কবাণী দিয়ে বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ চল্লিশ বছরের দূরত্বে থেকেও জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।’ (বুখারি) অন্য হাদিসে রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘সাবধান! যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকের ওপর অত্যাচার করে, অথবা তার অধিকার থেকে কম দেয় কিংবা ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয় বা জোর করে তার কোনো সম্পদ নিয়ে যায় তবে কিয়ামতের দিন আমি সে ব্যক্তির প্রতিবাদকারী হবো।’ (আবু দাউদ)
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো সব জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে হজরত মুহাম্মদ সা: কর্তৃক সৌহার্দ্যপূর্ণ বৃহত্তর জাতি গঠন। সে সময় মদিনায় তিন শ্রেণীর জনগোষ্ঠী বিদ্যমান ছিলÑ মদিনার আদিম পৌত্তলিক সম্প্রদায়, বাইরে থেকে আগত ইহুদি সম্প্রদায় এবং নবদীক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায়। রাসূল সা: মদিনায় বসবাসরত সব সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে, দলমত নির্বিশেষে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে একটি অসাধারণ কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে সামাজিক নিরাপত্তা, পারস্পরিক সম্পর্ক, মদিনার নিরাপত্তার প্রশ্ন এবং মদিনার অর্থনীতি সচল রাখার বিষয়ে সবাই ঐকমত্যে পৌঁছে ছিল। সে সময় কারো কোনো অধিকার বিন্দুমাত্র ভূলুণ্ঠিত হয়নি। সব নাগরিক সমান অধিকার পেয়েছে। রাসূল সা:-এর বলিষ্ঠ পদক্ষেপে গোত্রগুলোর মধ্যে চলা দীর্ঘকালের রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাতের অবসান ঘটেছিল।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করেনি, তাদের সাথে সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। (সূরা মুমতাহিনা : ০৮) সাম্প্রদায়িকতার নামে যারা বিশৃঙ্খলা করে তাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে হজরত মুহাম্মদ সা: বলেন, ‘যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, যারা সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে এবং সাম্প্রদায়িকতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয়।’ (আবু দাউদ)
আর এভাবেই ইসলামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা অপরিহার্য। দেশে বা সমাজে বসবাসরত সব ধর্মের অনুসারীদের উচিত পারস্পরিক আচরণ সুন্দর করা ও সাহায্যের হাত প্রসারিত করা এবং হিংসা-বিদ্বেষের পরিবর্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা।
লেখক : শিক্ষক, ইসলাম শিক্ষা, কে সি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উত্তরা, ঢাকা।


আরো সংবাদ



premium cement