০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


হাদিসের ভাষায় পার্থিব জীবনের উপমা

-

নবী করিম সা:-এর অসংখ্য হাদিস দুনিয়ার প্রতি মোহ ত্যাগ করার শিক্ষা দেয়। একটি বর্ণনায় আছে, একদিন নবী করিম সা: একটি মরা ছাগলের বাচ্চার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। রাস্তার পাশে সেটি মরে পড়েছিল। তখন যারা উপস্থিত ছিল, তাদের উদ্দেশে মহানবী সা: বললেনÑ তোমাদের কেউ কি এই মরা ছাগলের বাচ্চাটি মাত্র এক দেরহামে কিনে নিতে পছন্দ করবে? তারা বললেন, আমরা তো এটিকে কোনোই মূল্য দিয়ে কিনে নিতে পছন্দ করি না। তিনি সা: তখন বললেনÑ আল্লাহর শপথ, তোমাদের কাছে ছাগলের এই মরা বাচ্চাটি যত না তুচ্ছ ও মূল্যহীন, আল্লাহর কাছে দুনিয়া আরো বেশি তুচ্ছ ও মূল্যহীন। (মুসলিম শরিফ)
আরেক রেওয়ায়েতে আছে, মহানবী সা: ইরশাদ করেন, আল্লাহর কাছে দুনিয়ার মূল্য ও গুরুত্ব মাছির পাখনার সমান হলেও তিনি কোনো কাফেরকে এক ঢোক পানি পান করতে দিতেন না। এসব হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর প্রিয়নবী সা:-এর কাছে পার্থিব সম্পদের কোনোই মূল্য ও গুরুত্ব নেই। কোনো ব্যক্তি দুনিয়াবি সম্পদের মোহে আচ্ছন্ন হলে কখনো কখনো তাকে পাপে জড়াতে হয়। তার পক্ষে পাপ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হয় না। অবশ্য দুনিয়াকে যদি দীনের অনুগামী করে অর্জন করা যায়, তাহলে দুনিয়াতেও শান্তি আখেরাতেও শান্তি। কিন্তু যদি দীনকে দুনিয়ার অনুগামী করা হয়, যেমনটি এখন প্রায়ই দেখা যায়, তাহলে দুনিয়াতেও শান্তি নেই, আখেরাতেও নেই। আল্লাহ তায়ালা কুরআন মজিদে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ করেছেন, ‘সে ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলো দুনিয়া ও আখেরাতে।’
যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয়পাত্র হয়, আল্লাহ তাকে দুনিয়ার মোহ থেকে রক্ষা করেন। হজরত কাতাদা ইবনে নুমান রা: বর্ণনা করেন, মহানবী সা: ইরশাদ করেনÑ আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো বান্দাহকে ভালোবাসেন, তখন তাকে দুনিয়া থেকে এমনভাবে বিমুখ রাখেন, যেমনিভাবে তোমাদের কেউ তার অসুস্থ ব্যক্তিকে পানি থেকে বিমুখ রাখে (যখন পানি তার জন্য ক্ষতিকর হয়)।
হজরত আমর ইবনে আস রা: বর্ণনা করেন, একদিন নবী করিম সা: ভাষণ দিলেন এবং সেই ভাষণে তিনি বলেনÑ শুনে নাও ও মনে রেখো। পৃথিবী একটি অস্থায়ী ও সাময়িক কারবার, যা নগদ ও তাৎক্ষণিক। (আর এটির কোনো মূল্য ও গুরুত্ব নেই এজন্য) এতে সুজন ও কুজন সবার প্রাপ্য রয়েছে। সবাই তা ভোগ করে। বিশ^াস রাখো, আখেরাত নির্ধারিত সময়ে আসবেই, যা একটি অমোঘ সত্য। তখন সর্বশক্তিমান মহারাজ মানুষের ক্রিয়াকলাপ অনুযায়ী প্রতিদান বা শাস্তির ফয়সালা দেবেন। মনে রেখো, যাবতীয় সুখ শান্তির সব ধরনের সামগ্রী রয়েছে জান্নাতে। যাবতীয় অশান্তি ও দুঃখের সব ধরনের সামগ্রী রয়েছে জাহান্নামে। অতএব, সাবধান! (যা কিছুই করবে) আল্লাহকে ভয় করতে থাকবে। বিশ^াস রেখো, তোমাদের নিজ নিজ ক্রিয়াকলাপ নিয়ে আল্লাহর সামনে উপস্থিত করা হবে। যে ব্যক্তি বিন্দু পরিমাণে সৎ কাজ করেছে, সে তা-ও দেখবে। (মুসনাদে ইমাম শাফেয়ী)
এ ভাষণ গোটা মুসলিম উম্মাহকে শিক্ষা দেয়। এ দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী ও সাময়িক কারবার। এটি আমাদের দুনিয়ার অলীক চক্ষুতে দৃষ্টিগোচর হয় না। যখন এই চোখ বন্ধ হয়ে যাবে এবং প্রকৃত চোখ খুলবে তখন উদাসীন মানুষের জ্ঞান ফিরবে। হজরত ইবরাহিম ইবনে আদহাম পরিচিতির অপেক্ষা রাখেন না। একদিন তিনি কোনো কাজে প্রাসাদ থেকে বাইরে গিয়েছিলেন। তার সেবিকা রুম ঝাড়মোছের জন্য সেখানে প্রবেশ করে। ঝাড়মোছ করার সময় তার নজর পড়ল বাদশাহের শাহী বিছানায়। ভাবল ওখানে একটু বসে দেখি তো কেমন আরাম। তাতে বসে সে এতই প্রশান্তি পেল যে, তার চোখ বুজে এলো। সে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ইবরাহিম ইবনে আদহাম ফিরে এসে দেখেন তার বিছানায় শুয়ে রয়েছে কাজের মেয়ে। রাগে তিনি হাতের ছড়ি দিয়ে কয়েক ঘা বসিয়ে দিলেন মেয়েটির শরীরে। মেয়েটি লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং কাঁদতে শুরু করল। কিছুক্ষণ কান্নার পর সে হাসতে শুরু করল। ইবরাহিম ইবনে আদহাম অবাক হলেন। প্রশ্ন করলেনÑ কান্নার পরে আবার হাসলি কেনরে? কাঁদলি তো আমার মারে ব্যথা পেয়ে। কিন্তু তারপর আবার হাসির কারণ কী? মেয়েটি খুবই অদ্ভুত জবাব দিলো। সে বললÑ জনাব, আমি কয়েক মিনিটের জন্য এই আরামের বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। তাই আমি এমন কঠিন বেতের বাড়ি খেলাম। তাহলে যে ব্যক্তি এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় পুরো জীবন এই বিছানায় শুয়েছে, কেয়ামতের দিন তাকে যে কী পরিমাণে বেত্রাঘাত করা হবে, তার ইয়ত্তা নেই। এ কথা শুনেই দারুণ প্রতিক্রিয়া হলো ইবরাহিম ইবনে আদহামের মধ্যে। তিনি সাথে সাথে রাজমুকুট খুলে ফেললেন এবং জঙ্গলের পথ ধরলেন। কিছু দিন পর ওই পথে যাচ্ছিলেন তার এক মন্ত্রী। তিনি বাদশাহকে প্রশ্ন করলেনÑ কেমন কাটছে বর্তমানের জীবন? ইবরাহিম ইবনে আদহাম বললেনÑ আমি যখন রাজত্ব চালাতাম, তখন আমার কথা আমার প্রজারাও শুনত না। কিন্তু এখন আমি এই সমুদ্রের তীরে বসে যখন আল্লাহর জিকির করি, তখন সেই শব্দে সমুদ্রের মাছগুলো লাফাতে থাকে। আবার আমার জিকির শুনতে শুনতেই তারা পানিতে তলিয়ে যায়। মানুষের মন থেকে যখন দুনিয়ার মোহ দূর হয়ে যায় এবং অন্তরে আল্লাহর প্রেম স্থান নেয়, তখন প্রাণীকুলও তার কথা শুনতে থাকে, বাঘও পথ দেখিয়ে চলে।
মাওলানা জালালুদ্দীন রুমি রহ:কে কেউ দুনিয়ার জীবনের স্বরূপ জিজ্ঞেস করেছিল। তিনি একটি উদাহরণ দিয়ে পার্থিব জীবনের বাস্তব অবস্থা বুঝিয়ে দিলেন। তিনি বলেনÑ মনে করা যাক এক ব্যক্তি মাঠের মধ্য দিয়ে পথ চলছিল। হঠাৎ সে দেখতে পেল একটি বাঘ তাকে তাড়া করছে। সে তখন জীবন বাঁচাতে দৌড়াতে শুরু করল। দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। হঠাৎ দেখল সামনে একটি বড় গর্ত। সে তখন তাতে লাফিয়ে পড়ে বাঘ থেকে বাঁচতে চাইল। কিন্তু দেখল, গর্তে রয়েছে এক বিরাট সাপ। ইতোমধ্যে সে দেখতে পেল গর্তের কাছেই রয়েছে একটি গাছ। সে তখন গাছের ডাল ধরে তাতে উঠে বসল। কিন্তু গাছে ওঠার পর দেখলÑ একটি সাদা ও একটি কালো দু’টি ইঁদুর সেই গাছের গোড়া কাটছে। সে দুশ্চিন্তায় পড়ল। কেননা একটু পরেই গাছটি পড়ে যাবে এবং সে মাটিতে পড়ে গেলে বাঘ ও সাপ তাকে আক্রমণ করবে। এরই মধ্যে সে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল গাছে ঝুলছে একটি মধুর চাক, তাতে মধু টলমল করছে। সে তখন সেই মধু খাওয়ায় লিপ্ত হলো। বাঘ, সাপ, ইঁদুর কোনো কিছুর চিন্তা তার রইল না। অল্পক্ষণের মধ্যে গাছের গোড়া কেটে ফেলল ইঁদুরেরা। গাছটি পড়ে গেল, সেও পড়ে গেল। আর বাঘ তাকে ধরে বুক চিরে কলিজাটা খেয়ে লাশটা গর্তে ফেলে দিলো। অজগর সাপ তখন সেটি গিলে ফেলল। মাওলানা জালালুদ্দীন রুমি ব্যাখ্যা দিলেন। বললেনÑ মাঠ বলতে এই দুনিয়ার জীবনকে বোঝানো হয়েছে। বাঘ বলতে মৃত্যু, যা মানুষের পেছনে লেগে আছে। গর্ত হলো কবর, যা রয়েছে মানুষের সামনে। অজগর সাপ হলো মানুষের মন্দ কার্যকলাপ, যেগুলোর কারণে কবরে আজাব হবে। ইঁদুর হলো রাত-দিন। সাদাটি দিন আর কালোটি রাতের প্রতীক। গাছ হলো আয়ু বা হায়াত, যা প্রতিদিন কমে আসছে। মধুর চাক বলতে বোঝানো হয়েছে আখেরাত থেকে বিমুখকারী পার্থিব ভোগ বিলাসের সামগ্রী। কেননা এসবে মত্ত হয়ে মানুষ নিজের কার্যকলাপের জবাব দিহিতা, কবর, আখেরাত সব ভুলে যায়। ইতোমধ্যে তার কাছে এসে উপস্থিত হয় মৃত্যু। অতএব, মানুষ যদি পার্থিব সামগ্রী সংগ্রহ করে, তাহলে তাকে হালাল-হারামের কথাও মনে রাখতে হবে। কোনটি হালাল আর কোনটি হারাম তা তাকে ভুলে গেলে চলবে না। নইলে দুনিয়া দুনিয়াতেই থাকবে এবং আখেরাতের প্রথম ঘাঁটি কবরেই সে আটকা পড়বে। সেখান থেকে খালাস পাওয়া মোটেই সহজ হবে না। রাজা বাদশা ও ক্ষমতাধরদের কবর থেকে এই শিক্ষা নিতে হবে যে, কিছু দিন আগে যাদের দাপটে দেশ ও জনগণ কাঁপত, আজ তাদের একবিন্দু সাড়াও নেই। দুনিয়া থেকে মাত্র কয়েক গজ কাপড় সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন। তা-ও অল্প দিনের মধ্যে তাদের দেহের সাথে সাথে পচে গলে মাটির সাথে মিশে গেছে।


আরো সংবাদ



premium cement
টাঙ্গাইলে তৃষ্ণার্ত মানুষের পাশে সোনালি সূর্য শুরুতেই উইকেটের দেখা পেল বাংলাদেশ নারী কর্মীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ : যা বললেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল মিয়ানমারের পুরুষদের বিদেশে কাজের আবেদন নিষিদ্ধ করল জান্তা সরকার তানজিদ-সাইফুদ্দীনকে নিয়ে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে ৭ জন আটক ইসরাইলবিরোধী পোস্টের দায়ে নাগরিকদের আটক করছে সৌদি পোরশায় পুলিশ সুপারের বাড়িতে চুরি প্রকৃতিকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছে সরকারি দলের লুটেরা-ভূমিদস্যুরা : রিজভী টিএইচই এশিয়া ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিংয়ে দেশে ২য় বাকৃবি সৌদি-ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দ্বারপ্রান্তে : যুক্তরাষ্ট্র

সকল