২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কবি মোহন রায়হানের স্ট্যাটাস ‘হাসপাতালে বঞ্চিত মা, কবরে চিরশান্তির আইসিইউতে’

কবি মোহন রায়হানের স্ট্যাটাস ‘হাসপাতালে বঞ্চিত মা, কবরে চিরশান্তির আইসিইউতে’ - ছবি : সংগৃহীত

হাসপাতালে আইসিইউর জন্য ইনচার্জ থেকে পরিচালকের রুমে দৌড়েও আইসিইউ পাওয়া যায়নি। আইসিইউর অভাবে মারা গেলেন সাওল হার্ট সেন্টারের চেয়ারম্যান ও জাতীয় কবিতা পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কবি মোহন রায়হানের মা মাহমুদা খাতুন।

মাকে হারিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, হাসপাতালে বঞ্চিত মা, কবরে চিরশান্তির আইসিইউতে। আমার মা যে ক’দিন হাসপাতালে ছিলেন, বেডে শুয়ে বারবার নাক থেকে অক্সিজেনের নল খুলে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার আকুতি জানাতেন। শেষ মুহূর্তেও আমার হাত ধরে ওই একটি আকাঙ্ক্ষাই ব্যক্ত করেছিলেন তিনি, ‘আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও’।

আইসিইউতে একটি বেডের জন্য আমি যখন একবার ইনচার্জের রুম, আরেকবার পরিচালকের রুমে দৌড়ে ছুটে বেরিয়েছি। মায়ের সেই করুণ আকুতির বিস্ফারিত চোখ ছাড়া আমার সামনে আর কোনো দৃশ্য ছিল না।

স্ট্যাটাসে মোহন রায়হান লিখেছেন, অবশেষে জনম দুখিনী সেই মাকে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছি, কিন্তু হৃদস্পন্দনহীন নীরব নিথর চির ঘুমের নিস্তব্ধতায়। তাকে কবরে শুইয়ে দিয়ে এসেছি, কিন্তু আমার চোখের সামনে স্থির হয়ে আছে সেই দৃশ্য, যেখান থেকে আমার আর বেরোনোর উপায় নেই। রাত সাড়ে ১০টায় মাকে নিয়ে আমরা যখন গ্রামের বাড়ি পৌঁছালাম। রোজা, করোনা উপেক্ষা করে শতশত নারী, পুরুষ, শিশু, যুব, বৃদ্ধ অপেক্ষা করছিল বাড়ির সামনে। অ্যাম্বুলেন্স থেকে মাকে খাটিয়ায় রাখা মাত্র চারদিক থেকে মানুষের শোকের মাতমে রাত্রি ভেঙে পড়ে খান খান হয়ে। আমার মা আশপাশের সব এলাকার সব মানুষের সুখ-দুঃখের অকৃত্রিম সাথী ও ভরসা ছিলেন। মানবদরদী, পরোপকারী বিশেষত গরিব ও দুঃখি মানুষের একান্ত আশ্রয় ছিলেন তিনি। সেই মাকে শেষ এক নজর দেখার জন্য আমরা কাউকে নিবৃত্ত করতে পারিনি। লকডাউন উপেক্ষা করে গভীর রাতে মার জানাজায় প্রায় দুই হাজার মানুষে ভরে গেল হাটবয়ড়া স্কুল মাঠ।

আমাদের ইচ্ছা ছিল রাতেই মাকে বাড়ির সামনে দাদির কবরে দাফন করার। কিন্ত করোনা পরিস্থিতির কারণে এত রাতে যানচলাচল না থাকায়, অনেকে আসতে পারেননি। সবার অনুরোধে তাই সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো। সকাল ১০টায় তাকে সমাহিত করা হবে রহমতগঞ্জ কবরস্থানে। যেখানে ঘুমিয়ে আছে আমার মরহুম বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদ আলম মধু, ট্রাকচাপায় নিহত আমার ৩৯ বছরের বোন ফৌজিয়া, গাড়ি চাপায় নিহত ৬ বছরের ভাতিজা বর্ণসহ সব নিকট আত্মীয়।

৭০ বছর বসবাসের বাড়ি ছেড়ে মাকে যেতে হলো শহরের একটি হাসপাতালের হিমঘরে। এত প্রিয় এই বাড়িতে তার আশ্রয় হলো না! হায়রে মানব জীবন! এরই জন্য এত বাহাদুরি? ধনসম্পদ-অর্থের জন্য এত চাতুরি, আহাজারি!

আমার সোনার মা, জীবনে যাকে কোনো অন্যায় করতে দেখিনি, লোভ, লালসা, মোহ ও স্বার্থপরতা যাকে কখনো স্পর্শ করেনি। জাগতিক সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যিনি কেবল ইহলৌকিক সেবা ও পারলৌকিক অর্জনের সাধনায় নিজেকে ব্যপ্ত রেখেছেন। সারাক্ষণ স্রষ্টার ইবাদতে নিবেদিত এক অসীম অসাম্প্রদায়িক মানুষ আমার মা। পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা, ঘৃণা নয়, জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের ফারাক না করে কেবলই ভালোবেসেছেন মানুষকে।

আমার সেই অতিমানবী, হৃদয়বতী, যৌবনে অসম্ভব সুন্দরী, বার্ধক্যে জ্যোতির্ময়ী মাকে অনন্তকালের জন্য মাটিচাপা দিয়ে তারই বাড়িতে তাকে ছাড়া ফিরে এলাম এই প্রথম!

হাসপাতালের আইসিইউ বঞ্চিত মা আমার, কবরের চিরশান্তির আইসিইউতে ঘুমিয়ে এখন।


আরো সংবাদ



premium cement