১৯ মে ২০২৪, ০৫ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলকদ ১৪৪৫
`


বার্লিন ওয়ালের পতন ও জার্মানি\

-


৯ নভেম্বর, ১৯৮৯। বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়া এক ঐতিহাসিক দিন। এদিন দুই জার্মানিকে বিভক্তকারী বার্লিন দেয়ালের পতন হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার সাবেক মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ইউরোপ বিভক্ত হয়ে যায়। পশ্চিম থেকে পূর্বের দেশগুলোর মধ্যে ধীরে ধীরে অভেদ্য একটি পর্দা তৈরি করে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
আর পরাজিত জার্মানি ভাগ হয়ে যায় দখলদার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। দেশটির পূর্ব অংশ নিয়ন্ত্রণ করে সোভিয়েতরা। তবে বার্লিনকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। পশ্চিম অংশে ছিল ব্রিটিশ, ফরাসি এবং আমেরিকান অঞ্চল। আর পূর্ব অংশে ছিল সোভিয়েত এলাকা। পশ্চিম বার্লিন পরিণত হয় চার দিকে কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানি ঘেরা একটি দ্বীপে। ১৯৬১ সালে দুই বার্লিনের মাঝে দেয়াল নির্মিত হয়েছিল। কারণ পূর্ব বার্লিন থেকে অনেক মানুষ পশ্চিম বার্লিনে চলে যাচ্ছিল।
সেই দেয়াল পতনের কয়েক দিন আগে থেকে বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশের অংশ হিসেবে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ দেয়ালের পূর্ব দিকে জড়ো হয়েছিল। শাসকগোষ্ঠী সীমান্তের কড়াকড়ি তুলে দিয়ে এবং পূর্ব জার্মানির বাসিন্দাদের ভ্রমণ সহজ করে দিয়ে বিক্ষোভকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। তবে সীমান্ত পুরোপুরি খুলে দেয়ার মতো কোনো উদ্দেশ্য তাদের ছিল না।
যখন ঘোষণা দেয়া হলো, দেশের বাইরে ব্যক্তিগত ভ্রমণের জন্য এখন থেকে আর কোনো পূর্বশর্ত প্রযোজ্য হবে না। এরপর সবাই দলে দলে দেয়ালের পাশে ভিড় জমাতে শুরু করে। আর দেয়ালরক্ষীরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে কী করবে তা জানতে চান। কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়ার আগেই দেয়ালের একটি অংশের পতন হয়। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। এই দেয়াল পতনের এক বছরের মধ্যেই দুই জার্মানি পুনরায় একত্র হয়।
তিন দশকে জার্মানির পুনরেকত্রীকরণ কি শেষ হয়েছে? বেশির ভাগের মতে, তা একেবারেই হয়নি। এখনো দুই অংশে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান। দুই অংশের মানুষের আচার-ব্যবহার, চিন্তা-ভাবনায় তা সুস্পষ্ট।
এ বছর সেই বার্লিন দেয়াল পতনের ৩০তম বার্ষিকী। দুই জার্মানি একত্র হলেও এখনো দুই অংশ এক হয়নি বলেই ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষত পূর্ববর্তী কমিউনিস্ট শাসিত পূর্ব জার্মানিতে ক্রমবর্ধমান বিদেশীদের সম্বন্ধে অহেতুক ভয় এবং ইসলামভীতি দেশটির জাতীয় নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে ফেলেছে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক বিতর্কের ক্ষেত্রে জার্মানির পশ্চিম ও
পূর্বাঞ্চলের মধ্যে আবছা পার্থক্য আবার প্রকট করে তুলেছে। লাখ লাখ শরণার্থীর আগমনের ফলে পূর্বাঞ্চলের মানুষের মনে আবার স্থিতিশীলতা হারানোর ভয় এবং পুরনো ক্ষত জেগে উঠেছিল।
ঠিক সেই ভীতিরই ফায়দা তুলছে চরম ডানপন্থী পপুলিস্ট শিবির। পূর্ব জার্মানির ডানপন্থী অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) দলের উত্থান, যেটি ২০১৭ সালে পার্লামেন্টে উল্লেখযোগ্য আসন লাভ করেছিল। এই দলটি পূর্ব জার্মানি অঞ্চলে এখন সর্বাধিক। জার্মানির দুই অংশের মধ্যে পার্থক্য আবার তুলে ধরছে। এমনকি ‘পুনরেকত্রীকরণের চ্যান্সেলর’ হিসেবে পরিচিত হেলমুট কোহল ও জার্মানির পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দা চ্যান্সেলর আঞ্জেলা ম্যার্কেলের খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী সিডিইউ দল ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও সেখানে পিছিয়ে পড়েছে।
বার্লিন প্রাচীর ভেঙে ফেলার তিন দশক পরও জার্মান সরকার দেশটির পূর্ব অংশে ডানপন্থী আদর্শের উত্থানের সাথে লড়াই করছে। জার্মানের ঐক্যসংক্রান্ত বার্ষিক রাষ্ট্রীয় রিপোর্টে জার্মান সরকার সতর্ক করেছে যে পূর্ব জার্মানিতে বিদেশী লোক বা বিদেশী কোনো কিছু সম্বন্ধে ভয় সামাজিক সম্প্রীতির জন্য একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতিকেই উপস্থাপন করে।
পূর্ব জার্মানিতে শরণার্থী কেন্দ্র এবং ইসলামিক কেন্দ্রগুলোর ওপর বারবার আক্রমণ ও হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, এই বিদেশাতঙ্ক সহিংসতার ঘটনাগুলো জার্মানির জাতীয় সুরক্ষার জন্য মারাত্মক বিপদ। পূর্ব জার্মানি-ভিত্তিক নিও-নাজি সন্ত্রাসী সেল ন্যাশনাল সোস্যালিস্ট আন্ডারগ্রাউন্ড (এনএসইউ) ২০০০-২০০৭ সালে বিদেশী নাগরিকদের হত্যায় জড়িত ছিল।
গণতন্ত্র ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা সম্পর্কে সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুসারে জার্মানের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই ইসলাম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যদিও জার্মানদের সাধারণত সহনশীল জাতি হিসেবে দেখা হয়; তবুও মুসলমানদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা।
এক গবেষণা অনুসারে, বেশির ভাগ জার্মান নাগরিক তথা ৮৭ শতাংশই অন্যান্য দেশের নাগরিকদের মতামত প্রকাশের ব্যাপারে সাধারণত উদার। তবে এদের ৫২ শতাংশই ইসলাম ধর্মকে হুমকিস্বরূপ বলে মনে করে। জার্মানে পশ্চিমাঞ্চলের তুলনায় পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বসবাসকারী নাগরিকদের এ ধরনের মনোভাব বেশি দেখা যায়।
ধর্মকেই হুমকি হিসেবে দেখছে এমন লোকের সংখ্যা পশ্চিম জার্মানিতে শতকরা ৫০ ভাগ আর পূর্ব জার্মানিতে শতকরা ৫৭ ভাগ; অর্থাৎ দেশের পশ্চিমাঞ্চলের তুলনায় পূর্বাঞ্চলে ধর্মবিদ্বেষ বেশি।
জার্মান ঐক্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী পূর্বের অনেক মানুষ এখনো নিজেদের ‘দ্বিতীয় শ্র্রেণীর নাগরিক’ মনে করেন। তাদের মতে, পূর্বের মানুষের কথায় যথেষ্ট কান দেয়া হয় না। উগ্র ডানপন্থী দলের প্রতি পূর্ব জার্মানির মানুষের সমর্থনের পর জার্মানকে আর এ বিষয়ে উদাসীন থাকলে চলবে না। বিভেদের দেয়াল আবারো ভেঙে ফেলার এখনই উপযুক্ত সময়।

 


আরো সংবাদ



premium cement