৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


আফগানিস্তানে শান্তি কি আসন্ন?

-

আফগানিস্তানে যুদ্ধ শেষ করা এখন দেশটিতে শান্তি ফিরিয়ে আনা প্রধান ইস্যু। এই লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের মধ্যে আলোচনা একটি মাইলফলক অর্জন করেছে। কাতারের দোহায় ছয় দিনের আলোচনার পর ২৬ জানুয়ারির রিপোর্টে বলা হয়েছে, দুই পক্ষ একটি ল্যান্ডমার্ক খসড়া চুক্তি চূড়ান্ত করেছে। এতে ১৮ মাসের মধ্যে মার্কিন সেনাদের পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা এবং যুদ্ধবিরতির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে, আফগানিস্তানে ১৭ বছরের যুদ্ধ শেষ করার দীর্ঘ চলমান প্রচেষ্টায় এ চুক্তিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হবে। তালেবানরাও একমত হয় যে, তারা আফগানিস্তানকে আলকায়েদা ও ইসলামী স্টেটের সন্ত্রাসী হামলার ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি দেবে না। দোহায় তাদের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আলোচনার জন্য তালেবানদের নেতা আবদুল গনি বারদারকে প্রধান আলোচক নিয়োগের পর এই অগ্রগতি হয়। তালেবানদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বারদারের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার শান্তি আলোচনার গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এরপর মার্কিন দূত জামাল খালিলজাদ আফগানিস্তানের সাথে খসড়া চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে কাবুল সফর করবেন, যার অংশগ্রহণ দীর্ঘ এবং জটিল প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো শান্তি উদ্যোগে রাষ্ট্রপতি আশরাফ গনির সংশ্লিষ্টতা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তালেবানদের প্রত্যক্ষ আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল আসার ব্যাপারে যে খবর পাওয়া যাচ্ছে, দুই পক্ষের কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে তা প্রকাশ করেনি। তবে অন্য সূত্রের প্রকাশ করা সমঝোতার খসড়া অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র ১৮ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে তার সৈন্য প্রত্যাহার করবে বলে জানা যাচ্ছে, যার বিপরীতে তালেবান দেশটিকে আলকায়েদা অথবা আইএসের তৎপরতার ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে দেবে না। এই অগ্রগতিকে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। যদিও এ কথা নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে, সত্যি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবে কি না।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে আফগানিস্তান থেকে যে প্রাপ্তি তা কোনো মূল্যায়নেই সুখকর নয়। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ায় কৌশলগত সন্ধিস্থল আফগানিস্তানের ওপর আমেরিকান নিয়ন্ত্রণ পুরো অঞ্চলকে আমেরিকান প্রভাবের কাছে নত করবে বলে যে হিসাব-নিকাশ এক সময় পেন্টাগনের কর্মকর্তারা করেছিলেন, তা এখন এক ধরনের দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। আফগানিস্তান এমন একটি দেশ যার এক পাশে ইরান, অন্য দিকে পাকিস্তান, আরেক দিকে চীন এবং বাকি দিকে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো। ধারণা করা হয়েছিল, এই দেশটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার অর্থ হলো এর চারপাশের ওপর প্রভাব ও নজরদারি বজায় রাখা যাবে। এই ভূখণ্ডের কৌশলগত অমূল্য অবস্থানকে আরো গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে দেশটির অনুদঘাটিত বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের আধার।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণ করত তালেবান সরকার। ৯/১১-এর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিরোধী উত্তর জোট মিলিতভাবে তালেবানদের উৎখাত করে। তবে এরপরও গ্রুপটি তার প্রতিরোধ লড়াইয়ে অসাধারণ স্থিতি দেখিয়েছে। ২০১৮ সালের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত তালেবান বেশ শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে। গত বছর তালেবানরা সরকারপক্ষের বিরুদ্ধে হামলার সাথে সাথে প্রচলিত সামরিক অভিযানের সমন্বয় করে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর গুরুত্বপূর্ণ হামলা চালায়। কান্দাহার গভর্নরেটে (যেখানে একজন মার্কিন জেনারেল উপস্থিত ছিলেন) হামলা চালানোর পাশাপাশি তারা কাবুলের ব্রিটিশ অবস্থানের বিরুদ্ধে জটিল আক্রমণ পরিচালনা করতে সক্ষম হয়।
তালেবানদের ব্যাপারে ২০১৯ সালের স্ট্যাটফোরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে বিভক্তি থাকলেও এই আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি, শক্তি অর্জন এবং আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের পরিকল্পনা তালেবানদের কাছে নতি স্বীকার মনে হতে পারে। এ গ্রুপটি আমেরিকান বাহিনীকে প্রত্যাহারে চাপ সৃষ্টির জন্য যেকোনো নিরাপত্তা ফাঁক বা দুর্বলতা কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। যত দিন দেশটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি থাকবে, তত দিন তালেবান কাবুলকে পরাস্ত করতে পারবে না, যদিও তাদের কাছে দেশটির অনেক অংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তারা প্রচলিত সামরিক অভিযান, বিদ্রোহী ও সন্ত্রাসী হামলা এবং বেসামরিক জীবনযাত্রা অচল করে দেয়ার মতো আগের বছরগুলোতে চালানো তৎপরতা সামনেও চালিয়ে যেতে সক্ষম হতে পারে।
২০০১ সালে আফগানিস্তানে ন্যাটোর নেতৃত্বে যখন সামরিক অভিযান চালানো হয়, তখন তালেবানরা দেশটির বেশির ভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করত। সর্বব্যাপী সামরিক অভিযানে তালেবানদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং পশতুন এলাকার দুর্গম পাহাড়গুলোতে তারা আশ্রয় নেয়। যুক্তরাষ্ট্র ১৮ বছর ধরে চেষ্টা করে এই তালেবানি শক্তিকে নির্মূল করতে পারেনি, বরং এ জন্য আমেরিকান বাহিনীর কৌশল আফগান জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশের কাছে তালেবানদের গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
এর মধ্যে বিশ্বব্যবস্থায় বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আসে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে রাশিয়া-চীন সমন্বয়ে নতুন একটি বলয় সামনে এগিয়ে আসে। এ শক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় ইরান-পাকিস্তানের সাথে। ফলে যাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এক সময় পেন্টাগনের কৌশলবিদেরা আফগানিস্তানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন, তারা আফগানিস্তানে আমেরিকানদের পরাজয় কামনা করতে থাকেন। এতে মাঠের বাস্তবতা দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে। ভারতীয়দের দিয়ে দেশটিতে বিভিন্ন কৌশলগত অবকাঠামো উন্নয়ন আর নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাকে বিন্যাস-পুনর্বিন্যাসকে ইসলামাবাদ তার অখণ্ডতার জন্য হুমকি বিবেচনা করতে থাকে। অন্য দিকে তালেবান হটানোর জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বহুজাতিক বাহিনীকে সহায়তাকারী ইরান তেহরানে শাসক পরিবর্তনে পুনঃপুনঃ আমেরিকান উদ্যোগে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারাও তালেবানদের সাথে পরোক্ষ সম্পর্ক তৈরি করে। আর চীন-রাশিয়া তার নিকটবর্তী অবস্থানে আমেরিকান পরাজয় নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবে, সেটাই স্বাভাবিক।
এসব হিসাব-নিকাশ আফগানিস্তানের মাটিতে আমেরিকান বাহিনীর বিজয় লাভকে একেবারেই অনিশ্চিত করে তুলেছে। এ উপলব্ধির পরও ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সমরশক্তিকে বাড়িয়ে অধিকতর চাপ তৈরি করে তালেবানদের নিজেদের কাছে গ্রহণীয় শর্তে সমঝোতায় আনার কৌশল নিয়েছিল। কিন্তু এখন সে কৌশল যে বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে তা নিশ্চিত করেই বলা চলে। রাজধানী কাবুলে কূটনৈতিক জোন থেকে শুরু করে আফগানিস্তানে এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে আঘাত হানার সক্ষমতা তালেবানরা প্রদর্শন করেনি। এ অবস্থায় তালেবানদের সাথে আলোচনার কোনো বিকল্পই আসলে ওয়াশিংটনের সামনে খোলা ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্র এই আলোচনা আফগান সরকারকে দিয়ে প্রাথমিকভাবে এগিয়ে নিতে চেয়েছিল; কিন্তু তালেবানরা তাতে রাজি হয়নি। এর মধ্যে তালেবানরা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে চীন, রাশিয়া, ইরান ও পাকিস্তানের। এই চার প্রতিবেশী দেশের সাথে ভারত ও আফগান সরকারকে সংশ্লিষ্ট করে একটি শান্তিপ্রক্রিয়াও শুরু করা হয়েছে, যার মূল উদ্যোক্তা হলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন।
এ অবস্থায় তালেবানদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে একটি শান্তিপ্রক্রিয়ার কোনো বিকল্প ছিল না ওয়াশিংটনের জন্য। সমঝোতার এই প্রক্রিয়া ইতিবাচকভাবে এগোলে তালেবানরা একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। আমেরিকান প্রত্যাহার শুরুর পর স্বাভাবিকভাবে একটি নিরাপত্তাশূন্যতা তৈরি হতে পারে। এই শূন্যতা পূরণের জন্য একটি বিকল্প বহুজাতিক বাহিনীর সহায়তা নেয়া যেতে পারে, যাতে মুসলিম দেশগুলোর সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারিত্ব থাকতে পারে। অথবা সরকার ও তালেবানের মধ্যে সমঝোতা অনুসারে যার যার নিয়ন্ত্রিত এলাকার নিরাপত্তা রক্ষা করা যেতে পারে।
আর আফগানিস্তানের শাসন কাঠামো নিরূপিত হতে হবে গণতান্ত্রিক সংবিধানের কাঠামোতে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অংশীদারিত্ব রাষ্ট্র চালানোর ব্যাপারে নিশ্চিত করার জন্য ফেডারেল ব্যবস্থা কার্যকর করা যেতে পারে, যাতে প্রদেশগুলোকে অধিক স্বায়ত্তশাসন দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে। অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলোর স্বার্থ বিন্যাসের সাথে সাথে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর স্বার্থও নিশ্চিত করতে হবে সমঝোতা প্রক্রিয়ায়। এ ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক দিক হলো আফগানিস্তানে সব প্রতিবেশী দেশই দীর্ঘ যুদ্ধবিধ্বস্ত এ দেশটিতে শান্তি চাইছে। ভারত তার বিনিয়োগের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা পেতে পারে রুশ গ্যারান্টির মাধ্যমে। চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের অর্থনৈতিক করিডোর নেটওয়ার্ক বাস্তবায়ন করতে পারবে আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে। আন্তঃরাষ্ট্র তুর্কমেনিস্তান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ইন্ডিয়া (টাপি) গ্যাস পাইপ লাইন আফগানিস্তান পাকিস্তান ভারতকে একই স্বার্থবন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে। এর সাথে চীন-রাশিয়ার স্বার্থও জড়িত রয়েছে।
এখানে কর্তৃত্ব হারানোর হিসাব রয়েছে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের। দেশটির সামনে এখন সম্ভব কম মূল্যে এখান থেকে প্রস্থানের কৌশল গ্রহণ করা ছাড়া দৃশ্যত অন্য কোনো বিকল্প নেই। সব মিলিয়ে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার সুবাতাস বইছে বলেই মনে হচ্ছে এখন।

 


আরো সংবাদ



premium cement