লায়লা শাওকানি। সিরিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান মানবাধিকারকর্মী। ২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর তাকে সিরিয়ার কুখ্যাত সায়দানা কারাগারে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তার মৃত্যুর দুই বছর পর তার মারা যাওয়ার বিষয়টি প্রকাশ পায়। মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ১০ মাস আগে সিরিয়ার গোয়েন্দারা তাকে গ্রেফতার করেছিল।
২০১৫ সালে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ সরকারের দেয়া অবরোধের ফলে সমস্যায় পড়া বেসামরিক নাগরিকদের সহায়তা করার জন্য ২৬ বছর বয়সী লায়লা দামেস্কের পূর্ব ঘৌতায় গিয়েছিলেন। একজন আমেরিকান নাগরিক হিসেবে সিরিয়ায় ভ্রমণ করার সময় সাথে তার বাবা ও বাগদত্তা থাকায় তিনি মনে করেছিলেন সিরিয়ার শাসকগোষ্ঠীর নজরে পড়বেন না। কিন্তু সিরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা তাকে আটক করে।
তাকে আটকের পর মুক্তির জন্য ওয়াশিংটন কর্তৃপক্ষ কয়েকবার চেষ্টা করে। তবে তার আটকের বিষয়টি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট নমনীয়ভাবে দেখেছিল। লায়লা তখন আদ্রা কারাগারে বন্দী। আদ্রা কারাগারটি নারী নির্যাতনের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত থাকার পরও তাকে মুক্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি।
লায়লার বিরুদ্ধে সিরিয়ার সরকারি কর্মকর্তাদের হত্যা পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়। হত্যা পরিকল্পনার কথা স্বীকার না করলে তার পরিবারের ওপর প্রতিশোধ নেয়া হবে বলেও তাকে হুমকি দেয়া হয়েছিল। ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর মাত্র ৩০ সেকেন্ডের বিচারে তার ওপর সন্ত্রাসবাদ সমর্থনের অভিযোগ আরোপ করা হয়। এর দুই দিন পর মানবাধিকার গ্রুপগুলোর মতে, তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
দুই বছর ধরে লায়লার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সিরিয়ার আসাদ সরকারের হাতে বন্দী ৯০ হাজার অজ্ঞাতনামাদের মতোই একজন ছিল লায়লা। গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের কোনো হদিস মেলেনি। এ বছরের মে মাসে রাশিয়ার আগ্রহে সিরিয়ার সরকার সেসব অজ্ঞাতনামাদের তালিকা প্রকাশ শুরু করে, যাদের মৃত্যু সরকারের হেফাজতে থাকাকালীন হয়েছে। এসব অজ্ঞাতনামাদের মৃত্যু সনদে মৃত্যুর কারণ হিসেবে হার্ট ফেইল বা স্ট্রোক বলে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া একই দিনে কয়েক ডজন মানুষের মৃত্যুর তারিখ রয়েছে। যাদের গণ মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। মৃতদের দেহাবশেষ কোথায় আছে তার কোনো উল্লেখ নেই, সে তালিকায়। এ ঘটনার কোনো স্বাধীন তদন্তও করা হয়নি।
লায়লা শাওকানির ভয়ঙ্কর রকমের বন্দিদশা থাকা আর ফাঁসি হওয়া সত্ত্বেও একজন মার্কিন নাগরিক হিসেবে হোয়াইট হাউজ বা ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট এ বিষয়ে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি। কোনো ধরনের বিবৃতি প্রদান করেনি।
সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউমেন রাইটস গত সপ্তাহে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে দেখা যায়, বাশার আল-আসাদ সরকার ২০১১ সাল থেকে ২১ হাজার ১৪৩ জন নারী হত্যার জন্য দায়ী। যা দায়েশ কর্তৃক নিহতের ২৫ গুণ।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর হিসাবে ১৮ হাজারের মতো বন্দী সিরিয়ার কারাগারে নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। ২০১৬ সালের এক রিপোর্টে জাতিসঙ্ঘ কমিশন জানায়, কারাগারে মৃত্যুদণ্ডের মাত্রা নির্দেশ করে সিরিয়ার সরকার ‘মানবতার বিরোধী অপরাধ’ করার জন্য দায়ী। এখনো সিরিয়ার কারগারগুলোতে ৯ হাজারের অধিক নারী বন্দী রয়েছে। আরো হাজার হাজার নারী সরকার কর্তৃক গুম করা হয়েছে। যাদের অবস্থা সম্পর্কে কোনো কিছু জানা যায়নি।
সিরিয়ার যুদ্ধের সময় আটক হওয়া নারীদের বেশির ভাগেরই অবস্থা অপ্রকাশিত। নাদিয়া মুরাদের মতো অ্যাক্টিভিস্টরা দায়েশের যৌন দাসত্ব, বন্দী এবং নারীদের অবমাননার কথা বলে মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন। নাদিয়া মুরাদ নিজে যৌন দাসী হিসেবে বিক্রি হওয়ার পরে পালিয়ে আসতে পেরেছিলেন। আর বিশ্ববাসীকে এ বিষয়ে সচেতন করায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। অনেকেই বিষয়টি সম্পর্কে গুরুত্ব দেয়নি। সিরিয়ায় নারীদের এ ভয়াবহ অবস্থা সম্পর্কে বিশ্ববাসী ওয়াকিবহাল হতে বেশ সময় লেগেছে। কিন্তু ততদিনে হাজার হাজার নারী তাদের ইজ্জত, সম্মান আর জীবন হারিয়েছেন।
তুলনামূলকভাবে, সিরিয়ার শাসকগোষ্ঠী দ্বারা আটকদের ভাগ্য সম্পর্কে বিশ্ব সামান্যই জানতে পেরেছে। সেসব বন্দীরা নিদারুণ নির্যাতন ভোগ করে মৃত্যুবরণ করে। বন্দী নারীদের জন্য ধর্ষণকে জেলখানায় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে যারা বেরিয়ে এসেছেন তাদের মাধ্যমে এসব জানা যায়। বারবার কারাগারে করারক্ষী বাহিনী দ্বারা গণ-ধর্ষণের হওয়ার হুমকি ও নির্যাতনের কথা তার বলেছেন।
সিরিয়া সঙ্ঘাতের অষ্টম বর্ষে সেখানে যুদ্ধের আঁচ অনেকটাই কমেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলো সিরিয়াকে পুনর্নির্মাণের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা বলছে। তারা সিরিয়ার শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে সিরিয়ার জনগণ মানবতার বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের সবচেয়ে বেশি প্রত্যক্ষদর্শী। বিশেষ করে নারীরা। দেশটিতে লায়লাদের হত্যার ঘটনার মতো বিভিন্ন ঘটনা প্রতি বছরই প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু সিরিয়ানদের অবস্থান এখনো একই, ন্যায়বিচার ছাড়া শান্তি অর্জন সম্ভব নয়। হ