আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অস্ত্র বিক্রি ও সরবরাহ করার ক্ষেত্রে চীন ও আমেরিকার মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। একই সাথে দুই দেশই তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশগুলোর সাথে সামরিক সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক অস্ত্র বিক্রি ও সরবরাহ করার ওপর নজর রাখা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৮ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় ধরনের অস্ত্র বিক্রি ও সরবরাহের পরিমাণ পরীক্ষা করার পর জানিয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট অস্ত্র রফতানির মধ্যে চীনের অংশ ৫.৭ শতাংশ। ২০০৮ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যা ছিল ৪.৬ শতাংশ। চীন তার সামরিক ব্যয় তিন বছর মেয়াদে ৮.১ শতাংশ বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা প্রকাশ করার এক সপ্তাহ পর সিপ্রি তাদের এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। তবে চীনের সরকারি মিডিয়া বেইজিংয়ের সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে বলেছে, এই বৃদ্ধি আনুপাতিক হারে ঠিকই আছে এবং প্রয়োজনের তুলনায় কমই। একই সাথে তারা বলেছে, চীন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কেবল অস্ত্র প্রতিযোগিতায় যেতে চায় না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনে চীনকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে এবং চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব কমাতে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র বিক্রিকে তাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে বলে সিপ্রির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এখানে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, ২০০৮ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে ৫৫৭ শতাংশ। এই সময়টায়ই হিমালয়ের দোকলাম অঞ্চলে ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ তীব্র হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতে উন্নত সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে এবং দেশ দুটির মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্ব বেড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের সাথেও তার নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানো শুরু করেছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামকে একটি টহল জান সরবরাহ করেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে সীমানা নিয়ে চীনের সাথে বিরোধ শুরুর পর থেকে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম কিনতে শুরু করেছে।
পূর্ব চীন সাগরে জাপান ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির পর জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে শুরু করে। ২০১৩ থেকে ১০১৭ সালের মধ্যে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বেশ কিছু অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে প্রথম চালানে ৪২টি জঙ্গি বিমান সরবরাহ করা হয়। একই সময়ে জাপান বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করারও ক্রয়াদেশ দেয় ওয়াশিংটনকে। অবশ্য কোনো কোনো দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতিও ঘটেছে। যেমনÑ ভেনিজুয়েলার অস্ত্রের প্রধান উৎস ছিল আগে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ১৯৯৯ সালে হুগো শ্যাভেজ ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এই সম্পর্কে ভাটা পড়ে এবং শ্যাভেজ রাশিয়া ও চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নত করেন। তিনি দেশ দুটির কাছ থেকে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কিনে ভেনিজুয়েলার সশস্ত্র বাহিনীকে নতুনভাবে অস্ত্রসজ্জিত করেন।
চীন নিজেই অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন শুরু করার পর থেকে ২০১৩ সালের পরে দেশটির অস্ত্র রফতানি ৩৮ শতাংশ বেড়ে যায়। সিপ্রির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে চীন ৫৫টি দেশে ভারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করেছে। চীন থেকে অস্ত্র আমদানিকারী দেশের তালিকার শীর্ষে রয়েছে পাকিস্তান। এর পরই রয়েছে বাংলাদেশ ও আলজেরিয়া। সিপ্রির প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৮ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে আফ্রিকায় চীনের অস্ত্র রফতানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ শতাংশে।
সিঙ্গাপুরের নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির এস রাজারতœম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ এবং সামরিক বিশেষজ্ঞ কলিন কোহের মতে, উচ্চমূল্যের সামরিক সরঞ্জাম বিশেষ করে যুদ্ধজাহাজ ও জঙ্গি বিমান বিক্রির কারণেই মূলত চীনের অস্ত্র রফতানি বেড়েছে। নৌবাহিনীর সামরিক সরঞ্জাম বিশেষ করে সাবমেরিন বিক্রি বেড়েছে। একই সাথে বেড়েছে দূরপাল্লার কামান বিক্রি। আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের অস্ত্র রফতানি এখন জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকেও ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে চীন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রফতানিকারক দেশ। চীনের নৌ-সামরিক বিশেষজ্ঞ লিজি গ্লোবাল টাইমসকে বলেছেন, চীন অস্ত্রের ওপর গবেষণা ও এর উন্নয়নের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। একই সাথে জোর দিয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্র উৎপাদনের ওপর। বিশেষ করে সাবমেরিন ও জঙ্গি বিমান উৎপাদনে। চীন তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে স্টিলথ জঙ্গি বিমান জি-২০ তৈরি করে তা তাদের সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
আন্তর্জাতিক সামরিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনের অস্ত্র রফতানি বেড়ে যাওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। চীন যেসব দেশে অস্ত্র বিক্রি করছে তাদের নানা ধরনের সুবিধা দিচ্ছে। অস্ত্রের মূল্য পরিশোধে দীর্ঘমেয়াদি কিস্তির পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে এসব দেশকে ঋণও দিচ্ছে চীন। এ ছাড়া বিক্রি পরবর্তী সার্ভিসিংয়ের নিশ্চয়তাও পাচ্ছে ক্রেতা দেশগুলো। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার অস্ত্রের চেয়ে চীনা অস্ত্র দিয়ে অনেকাংশেই প্রত্যাশার চেয়েও ভালো সার্ভিস পাচ্ছে ক্রেতা দেশগুলো। ফলে চীনের অস্ত্রের প্রতি তাদের নির্ভরতা ও আস্থা বাড়ছে। ফলে চীনের অস্ত্র রফতানিও ক্রমেই বাড়ছে।
চীনের উত্থান যেভাবে
স্নায়ুযুদ্ধের অবসান এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ার সামরিক বাজেট একেবারেই কমে যায়। ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত সামরিক বাজেট ছিল ৩৫০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ১৯৯২ সালে রাশিয়ার বাজেট এ ক্ষেত্রে ৬০ বিলিয়নে নেমে আসে এবং ১৯৯৮ সালে তা কমে ১৯ বিলিয়নে দাঁড়ায়। একই রাশিয়ার অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা দেশগুলো বলতে গেলে নাই হয়ে যায়। রাশিয়ার অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা ছিল সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ওয়ানা-এর সদস্য দেশগুলো এবং ইরাক। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া রাশিয়ার অস্ত্র কারখানাগুলো মারাত্মক আর্থিক সঙ্কটে পড়ে। এদিকে চীন তার সামরিক বাহিনী ও অস্ত্রের আধুনিকায়নে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে। দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে চীন তার সশস্ত্রবাহিনী ও অস্ত্র কারখানার আধুনিকায়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৯৮৯ সাল থেকে চীনের সামরিক বাজেট প্রতি বছরই বাড়তে থাকে। ১৯৮৮ সালে চীনের সামরিক বাজেট ছিল ২১ বিলিয়ন ডলার, ২০১০ সালে এসে তা দাঁড়ায় ২১৫ বিলিয়ন ডলারে। ১৯৯৮ সালেই চীনের সামরিক বাজেট রাশিয়ার বাজেটকে ছাড়িয়ে যায় এবং এর পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে সামরিক খাতে ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশে পরিণত হয়।
১৯৬০-এর দশক থেকেই চীনের সরঞ্জামের সবই ছিল সেকেলে সোভিয়েত ডিজাইন ও প্রযুক্তির। এই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্য চীন পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানির কাছ থেকে উন্নত অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে শুরু করে। কিন্তু ১৯৮৯ সালে ভিয়েনানমেন মোকাবেলা স্কোয়ারে গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীদের নির্বিচার হত্যার পর পশ্চিমা দেশ ও কোম্পানিগুলোর সাথে চীনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। বন্ধ হয়ে যায় তাদের সামরিক সহায়তাও। তখন বিকল্প উৎসের সন্ধান করতে থাকে চীন। কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে রাশিয়াও তার আধুনিক অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির জন্য বাজারের সন্ধান করছিল। ফলে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে এ ক্ষেত্রে একটি যোগসূত্র গড়ে ওঠে। রাশিয়ার অস্ত্রের নতুন গন্তব্য হয় চীন। দেশটি রাশিয়া থেকে আধুনিক জঙ্গি বিমান, সাজোয়া যান ও যুদ্ধজাহাজ কিনতে থাকে। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে চীন এ ধরনের অনেক অস্ত্র কেনার ফলে রাশিয়ার অস্ত্রশিল্পও একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু ২০০৬ সালে এসে দুই দেশের মধ্যে অস্ত্র কেনা-বেচার এই সম্পর্কে কিছুটা ভাটা পড়ে। কারণ রাশিয়া থেকে চীনের অস্ত্র ক্রয় কমতে থাকে। ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে রাশিয়া থেকে কেনা অস্ত্রের পরিমাণ ২৫ শতাংশ কমে যায়। ২০১০ সালে তা আরো ১০ শতাংশ কমে যায়। এর কারণ হচ্ছেÑ রাশিয়া থেকে কেনা আধুনিক অস্ত্রগুলো অবিকল নকল করে চীনা সামরিক প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞরা একই ধরনের অস্ত্র উৎপাদনে দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছে। এসব অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম অনেক ক্ষেত্রে রাশিয়ার চেয়েও উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে তারা। নিজেরা এগুলো ব্যবহার করে পরীক্ষার পর এর কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তারা এসব অস্ত্র ব্যাপকভাবে উৎপাদন শুরু করে। এরপর শুরু করে রফতানি। এভাবেই চীন অস্ত্র আমদানিকারক দেশ থেকে রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়। এখন দেশটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়ে প্রথম স্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে।