১৬ মে ২০২৪, ০২ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৭ জিলকদ ১৪৪৫
`


এই সময়ে সকালে কুয়াশা কেন?

এই সময়ে সকালে কুয়াশা কেন? - ছবি : বিবিসি

আজ থেকে মাত্র কয়েক বছর আগে মার্চের মাঝামাঝি থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিট ওয়েভ বা তাপপ্রবাহ শুরু হয়ে যেত। কিন্তু, এখনকার চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। চলতি বছরের মার্চ মাস প্রায় শেষ হতে চলল। অথচ, এখনো প্রায় প্রতিদিনই ঢাকাসহ সারাদেশের সকাল কুয়াশাচ্ছন্ন থাকছে।

শুক্রবার (২৯ মার্চ) সকালেও ঢাকায় একই অবস্থা দেখা গেছে। এদিন সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে, তবুও শহরের বিভিন্ন এলাকায় শীতকালের মতো কুয়াশা দেখা গেছে।

আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন যে কেবল চলতি বছর না বরং গত ১০ থেকে ১২ বছর ধরেই পুরো মার্চ মাস জুড়েই বাংলাদেশে এমন কুয়াশা থাকছে এবং অসময়ে তাপপ্রবাহ শুরু হচ্ছে।

এটিকে তারা ‘সিজনাল প্যাটার্ন চেঞ্জ’ (ঋতু পরিবর্তনের ধারায় পরিবর্তন) বলছেন এবং এই পুরো পরিবর্তনটাকে তারা ‘অস্বাভাবিক আচরণ’ বলেও মনে করছনে।

কেন কুয়াশা থাকছে?
বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গত কয়েকবছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে এবং আবহাওয়াবিদরা গরমকালে কুয়াশা থাকার জন্য সেই ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ কেই দুষছেন।

তবে কুয়াশা দেখা যাওয়ার ব্যাখ্যা আবহাওয়াবিদ মো: বজলুর রশীদ এভাবে দিয়েছেন,‘এখনো আকাশে পর্যাপ্ত মেঘ নাই। মেঘ না থাকলে সকালে তাপমাত্রা দ্রুত ঠান্ডা হয়। সেজন্য শেষ রাতে ঠান্ডা লাগে। আর আকাশে যেটুকু মেঘ আছে, তা তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারছে না। কারণ দিনের বেলা সূর্য থেকে যে আলো আসে, তা সকাল হতে হতে দ্রুত কমে যায়।’

তিনি আরো বলেন, ‘কুয়াশা শুরু হয় সকাল আটটা-নয়টার দিকে। এই সময়টাতে মরু অঞ্চলের সকাল যেমন ধোঁয়াশার মতো মনে হয়, ঠিক সেরকম মনে হয়। কারণ, এখনকার বাতাসে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা নেই। এ সময় মানুষের শরীর টেনে ধরছে। এর মানে, ওয়েদার শীতকালের প্যাটার্ন ফলো করছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘যেটুকু ময়েশ্চার (আর্দ্রতা) আছে, বেলা বাড়ার সাথে সাথে তা নিচের দিকে এসে কুয়াশা হয়ে যাচ্ছে। আবার সূর্য উঠলে এক দুই ঘণ্টার মাঝে আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়।’

আর্দ্রতা কম থাকার কারণ ‘উইন্ড প্যাটার্ন’
গত কয়েক বছর ধরে ‘এরকম দেখা যাচ্ছে’ উল্লেখ করে আবহাওয়াবিদ মো: বজলুর রশীদ বিবিসিকে বলেন, ‘বিশেষ করে, মার্চ মাসে। এসময় বাতাসের আর্দ্রতা অনেক কম থাকছে।’

আর্দ্রতা কম থাকার কারণ সম্বন্ধে তিনি বলেন, ‘প্রধান কারণ, উইন্ড প্যাটার্ন এখনো চেঞ্জ হয়নি। বাতাসের গতিই মূলত ঋতুকে পরিবর্তন করে। এই সময়ে ‘বাতাস ঘুরে’ দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে হওয়ার কথা ছিল। কারণ দক্ষিণ দিক থেকে বাতাস এলে বাতাসের সাথে ময়েশ্চার আসবে।’

তিনি জানান, বর্তমানে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বাতাস আসে এবং সেই বাতাস ‘আর্দ্রতা ক্যারি করতে পারে না’। কিন্তু বাতাস যদি দক্ষিণ থেকে হয়, তাহলে সেই বাতাসের সাথে বঙ্গোপসাগর থেকে ‘পর্যাপ্ত ময়েশ্চার আসবে’।

তিনি বলেন, ‘বে অব বেঙ্গল থেকে আর্দ্রতা এলে শরীর ঘামবে। এই শীতের অনুভুতি থাকবে না।’

দক্ষিণের বাতাস না আসায় যা যা হচ্ছে
মার্চে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকা, রাতে ও সকালে শীত শীত অনুভূতি হওয়া, দিনের বেলা গরম লাগলেও ঘাম না হওয়া, ক্যালেন্ডার অনুযায়ী গরমকাল হওয়ার কথা থাকলেও সকালে আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন থাকা; এই সবকিছুকে অস্বাভাবিক বলছেন আবহাওয়াবিদরা।

আবহাওয়া যদি স্বাভাবিক হতো, তাহলে বছরের এই সময়ে দিনেরবেলা মানুষ গরম অনুভব করত ও ঘামত। কিন্তু এখন মানুষ দিনে ‘গরম অনুভব করলেও ঘাম হয় না’ বলেন রশীদ।

তিনি বলেন, ‘বাতাস এখনো ঘুরে নাই। এদিকে দিন বড় হয়ে গেছে। বাতাস আবার উত্তর দিক থেকে আসছে। সব মিলিয়ে দিনে হালকা গরম লাগছে। কিন্তু ওই গরমের ক্ষেত্রে মানুষ ঘামছে না। বাতাস দক্ষিণ দিক থেকে এলে ময়েশ্চার আসবে, ঘাম হবে, গরম লাগবে।’

তবে শুধু বাতাসের গতিতেই পরিবর্তন আসেনি, এর ফলে তাপপ্রবাহের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে।

আগে মার্চের মাঝামাঝিতে তাপপ্রবাহ শুরু হলেও এখন মার্চের শেষের দিকে বা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের একদম শেষের দিকে তাপপ্রবাহ শুরু হচ্ছে।

রশীদ বলেন, ‘আগে তাপপ্রবাহ বর্ষাকাল, মানে জুনের শুরুতে শেষ হয়ে যেত। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না। তাপপ্রবাহের সময়সীমা আরো দীর্ঘ হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, এপ্রিলে শুরু হয়ে এটি অক্টোবর পর্যন্ত চলছে। অর্থাৎ, একদিকে দেরিতে শুরু হচ্ছে, অপরদিকে শুরুর পর সেটি আর সহজে শেষ হচ্ছে না।’

এ বছর কেমন থাকবে আবহাওয়া?
এই আবহাওয়াবিদ জানিয়েছেন, বাংলাদেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়াতে বছরের এই সময়টাতে সাধারণত দিনের তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে।

কিন্তু এ বছর ওখানে দিনের তাপমাত্রা গড়ে ২৫ থেকে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকছে। সেইসাথে, রাতের তাপমাত্রা সর্বনিম্ন ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে আসছে।

দিন ও রাতের তাপমাত্রার এই লক্ষণীয় শুধুমাত্র ওই অঞ্চলে না, সারা দেশেই কম বেশি হচ্ছে।

তিনি আরো জানান, এ বছর গ্রীষ্মে ‘তাপমাত্রা বেশি থাকবে। এপ্রিলের শেষের দিক থেকে হিট ওয়েভ চলে আসবে এবং সেটার দৈর্ঘ্য বেশ দীর্ঘ হবে। তাপপ্রবাহ চলাকালীন মাঝে মাঝে বৃষ্টি হবে। তবে সাধারণ বৃষ্টি না, কালবৈশাখী ঝড় হবে আর কি তখন।’

তবে আগামী কয়েকদিন আবহাওয়া কেমন থাকতে পারে, সে প্রসঙ্গে তার ধারণা, ‘শর্ট টাইম প্রেডিকশন অনুযায়ী, আপাতত দুই তিন দিন বৃষ্টি হবে সামান্য। এরপর তাপমাত্রা আস্তে আস্তে বাড়বে।’

গবেষণা যা বলছে
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গত ৪৩ বছর, অর্থাৎ চার দশকেরও বেশি সময়কালের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ‘বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল জলবায়ু : আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের প্রবণতা এবং পরিবর্তন’ শীর্ষক জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল।

আবহাওয়াবিদ মো: বজলুর রশীদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও নরওয়ের আরো পাঁচজন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ এই গবেষণাটি করেছেন।

তাতে উঠে এসেছিলো যে বছরের প্রতি ঋতুতেই তাপমাত্রা আগের তুলনায় বাড়ছে। এছাড়া, মৌসুমি বায়ু দেরিতে প্রবেশ করায় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বর্ষাকাল পিছিয়ে যাচ্ছে।

আর বর্ষাকাল দেরিতে শুরু হওয়া মানে বাংলাদেশের কৃষিখাতের জন্য তা জোরালো এক ধাক্কা।

এই সবকিছুর পাশাপাশি শীতের তীব্রতা বাড়ার বিষয়টিও উঠে এসেছে। তারই ধারাবাহিকতায় মার্চের শেষ সপ্তাহেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কুয়াশা দেখা যাচ্ছে, শীত অনুভূত হচ্ছে।

তবে এগুলো মূল কারণ হিসেবে দূষণকে চিহ্নিত করেন আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ।

গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি একই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘তাপমাত্রা পরিবর্তনের অনেকগুলো প্যারামিটার আমরা বিশ্লেষণ করেছি। যেমন, সূর্যের কিরণকাল কমে যাচ্ছে, ফগি কন্ডিশন বেড়ে যাচ্ছে…কিন্তু এর মূল কারণ হলো দূষণ।’

শুক্রবারও তিনি ঢাকায় দেখতে পাওয়া কুয়াশার পেছনে পরিবেশ দূষণকে দায়ী করছেন।

উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকের ‘দ্য বাংলাদেশ কান্ট্রি এনভায়রনমেন্ট অ্যানালাইসিস ২০২৩’ শীর্ষক নামক এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বায়ুদূষণসহ চার ধরনের পরিবেশদূষণে বাংলাদেশে ২০২৩ সালে দুই লাখ ৭২ হাজারের বেশি মানুষের অকালমৃত্যু হয়েছে।

ওই বছর বায়ুদূষণে বাংলাদেশ শীর্ষে ছিল। আর নগর হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ নগর ছিল ঢাকা।

বায়ুদূষণ ছাড়াও বাকি তিন কারণ হল অনিরাপদ পানি, নিম্নমানের পয়োনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যবিধি।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement