১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জীবন-সংসার এখন ‘গলার কাঁটা’

ওএমএস ডিলারের দোকানে অভাবী মানুষের দীর্ঘ লাইন : নয়া দিগন্ত -

শীর্ণ শরীরে চামড়ায় ভাঁজ। পরনে হালকা সবুজ রঙের ফিনফিনে শাড়ি। শীতের সকালে তেজি দুপুরে কপাল ভিজে করছে চিকচিক। লাল সুতি ওড়না দিয়ে মুখের ঘাম মুছছিলেন বারবার। পাঁচ কেজি মোটা চালের আশায় সাত সকালেই ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) দোকানের সামনে হাজির। পাক্কা চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ক্লান্ত ৭০ বছরের মুক্তা বেগম। মঙ্গলবার কলেজ রোড মুক্তা বেগম প্রশ্ন করা হয়েছিল- চাল নিতে লাইনে দাঁড়ানোর মতো বাড়িতে আর কেউ কি নেই? তার উত্তর, ‘সংসার এখন আমার গলার কাঁটা। পোলা একটি গাড়ির স্টানে সিরিয়ালগিরি করে। পোলার বউ অসুস্থ। দুই নাতিও ছোট। লাইনে দাঁড়ানোর জন্য আর কে আইবে? এখন যে অবস্থা, সংসার আর চলে না। সকালে পানি ভাত লবণ দিয়া কছলাইয়্যা খাইছি। অনেক দিন ধরেই হাক-পাতা খেয়ে আছি। পাঁচ কেজি চাল বাজারে কিনতে ২৫০ টাকার মতো লাগে। এই রেশনের (ওএমএস) দোকান থেকে কিনলে ১৫০ টাকার মতো লাগে। বাইচ্যা যায় ১০০ টাকা।
কষ্টের কথা বলতে বলতে গড়িয়ে পড়ে মুক্তা বেগম কপালের ঘাম। ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মুক্তা বেগমের মতো আরো কয়েকজনের কাছের জীবন যুদ্ধের গল্প শুনি। তারা এসেছেন মোটা চাল কিনতে। বাজারে সব নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় ওএমএসের দোকানের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ মানুষের।
মহিপুর বাজার সড়কের পাশে ছোট্ট চায়ের দোকান চালান নান্নু মিয়া। দিনে তার আয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। মহিপুরে ভাড়া বাসায় থাকেন। বড় মেয়ে নবম শ্রেণী ও ছোট মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। ছোট্ট এই চা দোকানের আয় দিয়েই চলে তার সংসার। এই কয়েক মাসে চাল, তেল, পেঁয়াজ, তরকারির দাম যেহারে বেড়েছে, তাতে সংসার তার গলার কাঁটা হয়ে গেছে। ডাল-আলু দিয়েই চলছে তার সংসার।
ওপেন মার্কেটে (ওএমএস) লাইনে দাঁড়ানো গোলভানু খাতুনের (৭০) বৃদ্ধ স্বামী রিকশাচালক। মদিনাবাগ এলাকা তারা থাকেন। বড় কষ্টে আছেন তারা। বেশির ভাগ দিন ভাতের সাথে আলুভাজি ও আলুভর্তা খেয়েই দিন কাটছে তাদের। গোশত কেনার কথা কল্পনাও বাইরে। গোলভানু বললেন, ‘আমাদের কষ্টের কথা কে শুনবে ভাই। একটা লাউ কিনতে লাগে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এখন আর ওসব খাওয়া হয় না। পাতলা ডালের সাথে কখনো আলুভর্তা, কখনো বা ডিমভাজি- এসবই বেশি খাই এখন। গরুর গোশত সেই কোরবানির সময় খেয়েছি।’
নতুন বাজার এম এম প্লাজার সামনে কথা হয় অটোরিকশার চালক নুর নবীর সাথে। জীবন-সংসার সম্পর্কে তিনি জানালেন, সকাল ৬টায় অটোরিকশা নিয়ে বের হন আর রাত ১১টায় বাসায় ঢোকেন। আয় রোজগার আগের মতোই আছে। প্রায় সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। নুর নবী বলেন, এত সময় অপেক্ষার পর মাত্র পাঁচ কেজি চাল কিনতে পারব, এটি দুঃখজনক। বড় সংসার, একসাথে ১০ কেজি চাল পেলেও হতো। আবার দুই দিন পর এসে লাইনে দাঁড়াতে হবে।
ইলিয়াস মোল্লা কলাপাড়া শহরে এক ব্যক্তির মালিকানাধীন বেকারি দোকানে চাকরি করেন। বেতন ১০ হাজার টাকা। স্ত্রী-সন্তান থাকে গ্রামে। তিনি অফিস মহল্লার একটি টিনের ঘরে সিট ভাগাভাগি করে থাকেন। এই ১০ হাজার টাকা দিয়েই নিজের ও বাড়িতে সংসার চালাতে হয় তাকে। তিনি বললেন, নিজের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। আর পারছি না। এখন মেয়ে দুটোর লেখাপড়া বন্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না।
কলাপাড়া কাঁচাবাজারে এসেছেন শাহ আলম নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী। তিনি বলেন, ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। নিত্যপণ্যের দাম শুধু বেড়েই চলছে, কিন্তু আয় তো আমার বাড়েনি। কম কিনে, কম খেয়ে কোনোভাবে দিন গুজার করছি আর কী। বাজার ঘুরে দেখা যায়, ক্রেতারা কোনো পণ্যের দাম শুনে পণ্য না কিনেই ফিরে যাচ্ছেন। যেটা না কিনলেই নয়, সেটিই শুধু কিনছে। এক কেজির জায়গায় আধা কেজি নিচ্ছেন। দ্রব্যমূল্যের এ অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতিতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন দেশের বেশির ভাগ মানুষ। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন তারা। আধপেটা মানুষ ক্ষুধার চোখে শুধু সরষে ফুলই দেখতে পায়, উন্নয়ন নয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ইতিহাসের সব রেকর্ড ভেঙেছে। মানুষের ন্যূনতম বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকু ক্রয়ক্ষমতাও বুঝি এখন নাগালের বাইরে চলে গেছে। জনগণ আর উন্নয়ন চায় না, তারা চায় ভাত ও ভোটের অধিকার।
কলাপাড়া নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাসির উদ্দিন তালুকদার বলেন, দ্রব্যমূল্য এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। জীবন সংসারে মানুষের হাহাকার নেমে আসছে। কালোবাজিদের দখলে চলে গেছে বাজার নিয়ন্ত্রণ।


আরো সংবাদ



premium cement