১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সেইপের প্রশিক্ষণ ও একজন সাইফুল

-

দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বেকারত্বের সর্বোচ্চ হারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তান ও মালদ্বীপ। আমাদের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা ও ভুটান বেকারত্বের হার কমাতে সফল হলেও বেড়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নেপালে। আর ভারতে বেকারত্বের হার স্থিতিশীল রয়েছে। সম্প্রতি আইএলও প্রকাশিত ‘ট্যাকলিং দ্য কোভিড-১৯ ইয়ুথ এমপ্লয়মেন্ট ক্রাইসিস ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ করোনার কারণে ‘লকডাউন প্রজন্ম’ তৈরি হয়েছে; যার প্রভাব দীর্ঘ দিন থাকবে। করোনার প্রভাবে বাংলাদেশে যুব বেকারত্বের হার বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হতে পারে।
দেশের বেকার সমস্যা নিয়ে সবার মতো সরকারও উদ্বিগ্ন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বেকার সমস্যা রাতারাতি দূর করা সম্ভব নয়; তবে সরকার যুব বেকারত্ব নিরসনে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এমনই একটি পদক্ষেপ হচ্ছে ‘স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেইপ)’। দারিদ্র্যবিমোচন ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ‘স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেইপ)’ বাস্তবায়ন করছে। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে দেশে পাঁচ লাখ দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা হবে। সরকারি খরচে আগ্রহী বেকারদের বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে এবং প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে ৭০ শতাংশের চাকরির সুযোগ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হচ্ছে। দেশে-বিদেশে শিল্প প্রতিষ্ঠানের চাহিদার আলোকে বেসরকারি পর্যায়ে ১২টি ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন, সরকারি পর্যায়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এবং পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই বিভাগ তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
‘সেইপ’-এর জনকল্যাণমুখী প্রকল্প বাস্তবায়ন সরকারের একটি মহৎ উদ্যোগ, এতে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারের দেয়া সুযোগের সদ্ব্যবহার করে দেশের বেকার যুবসমাজ পছন্দের কোর্সে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন উপকৃত ও স্বাবলম্বী হচ্ছে। এমনই একজন উপকারভোগী হচ্ছেন রাজশাহীর সাইফুল। পরিবারে তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার বিজয়নগর গ্রামে তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে খুবই কষ্টে। প্রান্তিক কৃষক বাবা বাকিউল্লাহ উদয়াস্ত পরিশ্রম করে যা আয় করতেন, তা দিয়ে ঠিকমতো সংসারই চলত না; পড়াশোনার খরচের সংস্থান হবে কিভাবে? তার পরও হাল ছাড়েননি সাইফুল। অদম্য মনোবল আর অফুরন্ত ইচ্ছাশক্তির জোরে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন এবং সফলতার সাথে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। পড়ালেখার খরচ জোগাতে স্থানীয় বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নেয়ার কথা উল্লেখ করে সাইফুল বলেন, কষ্টের কথা মনে হলে এখনো কান্না পায়। জীবনে যেসব বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে, তা ছিল অনেক কষ্টের; অপমানের।
ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রবল ইচ্ছা থাকলেও দারিদ্র্যের বৃত্তবলয়ে বন্দী সাইফুল কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সে সময় তার গ্রামের এক আত্মীয় পাবনা শহরে চাকরি করতেন। সাইফুল স্বপ্ন পূরণের অভিপ্রায়ে সেই আত্মীয়ের কাছে চলে যান। পাবনা যাওয়ার কয়েক দিন পর তিনি শুনতে পেলেন, মাইকে প্রচার করা হচ্ছেÑ পাবনা সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ইলেকট্রিক্যাল ইন্সটলেশন অ্যান্ড মেইন্টেন্যান্সসহ বিভিন্ন কোর্সে সম্পূর্ণ বিনা খরচে প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগ পাওয়া যাবে। সাইফুল মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই প্রচারকর্মী তার হাতে একটি লিফলেট দেন। লিফলেট পড়ে সাইফুল জানতে পারলেন, দারিদ্র্যবিমোচন ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ‘স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেইপ)’ বাস্তবায়নের বিষয়ে স্পষ্ট একটি ধারণা পেলেন।
পরদিনই তিনি পাবনা সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগাযোগ করেন। এসবই ২০১৮ সালের কথা। মৌখিক পরীক্ষাসহ প্রয়োজনীয় সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ওই বছরের জানুয়ারি-এপ্রিল সেশনে ইলেকট্রিক্যাল ইনস্টলেশন অ্যান্ড মেইন্টেন্যান্স কোর্সে ভর্তি হন এবং প্রশিক্ষণ শেষ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে আর পেছনে তাকাতে হয়নি সাইফুলকে। প্রায় সাথে সাথেই ওখানকার জব প্লেসমেন্ট অফিসারের (জেপিও) মাধ্যমে পাবনা ইনটাফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড কোম্পানিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পদে চাকরি হয়ে যায় তার।
সাইফুলের এখন স্বপ্ন দেখেন আরো বড় কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করার। এ স্বপ্নের কথা জানানোর পাশাপাশি তিনি আরো জানান, জীবনে চলার পথে ‘সেইপ’-এর প্রশিক্ষণ আমার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। এর ফলে জীবন থেকে অভাব-অনটন বিদায় নিয়েছে। নিজে ভালোভাবে চলার পাশাপাশি মা-বাবা তথা পারিবারিক খরচের জোগানও দিতে পারছি। সাইফুলের মতে, দেশের বেকার তরুণরা যদি ‘সেইপ’-এর প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পান, তা হলে তারা নিজেরা যেমন উপকৃত হবেন; তেমনি দক্ষ জনশক্তির বদৌলতে দেশের উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে। হ
লেখক : সংবাদকর্মী


আরো সংবাদ



premium cement