২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার

-

আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের সুবাদে যখন প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক ‘পেনিসিলিন’ আবিষ্কার হয়, তখন সারা বিশ্বে স্বাস্থ্য খাতে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন আসে। আগে বিপুল মানুষ ব্যাকটেরিয়াজনিত জ্বর, সর্দির মতো সাধারণ রোগে মারা যেত; যা এখন হাতে গোনা। কিন্তু বর্তমানে ‘অ্যান্টিবায়োটিক আত্মসুরক্ষার নয়, আত্মঘাতী হাতিয়ার’; বিবেচ্য উদ্ধৃতির মূল কারণÑ এর অবাধ ব্যবহার। এটি শুধু মানুষের ক্ষেত্রে নয়! পশু-পাখি ও কৃষিতেও ব্যবহার হচ্ছে যথেচ্ছার। পাশাপাশি ভেজাল ওষুধ ও নৈরাজ্যমূলক দামের রেশ টানা সঙ্ঘবদ্ধ চক্র তো রয়েছেই।
প্রেসক্রিপশনহীন অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে দেশে। অথচ যত্রতত্র অবাধে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হচ্ছে। প্রশাসনের সে দিকে কোনো খেয়াল নেই। অনেকে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই ফার্মেসিতে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক ক্রয় করছেন। কেউ ডাক্তারের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক খেলেও নির্দিষ্ট কোর্স শেষ না করে বাদ দিচ্ছেন। ফলে ব্যবহারকারীর শারীরিক দুর্বলতা এবং নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সর্দি, কাশিজনিত সমস্যায় যেখানে ঘরোয়া পানীয় যেমনÑ হালকা গরম পানিতে মধু, লেবুর রস ও আদার মিশ্রণ গলাব্যথা ও কফ নিরাময়ে বেশ কার্যকর; কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয় না, সেখানে ওষুধ বিক্রেতারা নিঃসঙ্কোচে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই সাধারণ মানুষের কাছে বেশি পাওয়ারের অ্যান্টিবায়োটিক ধরিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামে ফার্মেসি ও হাতুড়ে ডাক্তারদের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়েছে। বিবিসির তথ্য মতে, ‘গ্রামাঞ্চলে ৮ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসকের উপদেশে বিক্রি হয়।’ কেউ সামান্য জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথার মতো উপসর্গের কথা জানালেই এজিথ্রোমাইসিন, স্ট্রেপটোমাইসিন, ডক্সিসাইক্লিন ও নিস্টাটিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। যেখানে একজন এমবিবিএস ডাক্তারের উচিত প্রাথমিক জ্বরে প্যারাসিটামল প্রেসক্রাইব করা এবং তিন দিনে জ্বর না কমলে কফ ও রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে পরামর্শ দেয়া। সেখানে মানুষজন সহজেই হাতের কাছে ওষুধগুলো পেয়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ইদানীং ইউনিয়ন কিংবা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অনেক এমবিবিএস ডাক্তারও পরীক্ষা ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন; যা হতাশাজনক। তা ছাড়াও কোভিড-১৯ সময়ে মানুষের অনুভূতি যখন নাজুক, তখন গ্রামাঞ্চলে হাতুড়ে ডাক্তার ও ওষুধ বিক্রেতারা উপসর্গ শোনামাত্রই করোনার ভয় দেখিয়ে নিরীহ মানুষজনের কাছে চড়ামূল্যে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করছেন। অথচ অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকজনিত রোগের বিরুদ্ধে সচল।
ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের জীবাণু সম্পূর্ণরূপে মেরে ফেলা অ্যান্টিবায়োটিকের মূল লক্ষ্য। চিকিৎসকের পরামর্শে কোর্স শেষ না করার ফলে ইদানীং অনেকের দেহে ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্সি’ দেখা দিচ্ছে। ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্সি’ হলো ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলা। একপর্যায়ে ব্যাকটেরিয়া সেই ওষুধগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গঠন করে। ফলে রোগীর দেহে একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগেও অনেক সময় রোগের গতি থামানো কঠিন হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ব্যক্তির টেস্ট রিপোর্টে দেখা যায়, তার দেহে ১৭টি অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া গবাদি পশু-পাখি পালনেও ছোটখাটো রোগে গ্রামীণ পশু চিকিৎসকরা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। ফলে অল্প সময়ে গবাদিপশু দ্রুত বেড়ে ওঠায় লাভবান হচ্ছেন খামারিরা। আর মানুষ প্রোটিনের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সেসব পশু-পাখির গোশত খেতে বাধ্য হওয়ায় বিপদে পড়ছেন। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ দেশের চিকিৎসালয়ে তিন-চার মাস বয়সী শিশুসহ নবজাতক শিশুর মধ্যেও ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্সি’ দেখা দিচ্ছে।
দেশের মানুষের সুচিকিৎসা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। পোলট্রি খাত, গবাদিপশুর খামার ও কৃষিতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার কমাতে হবে। পোলট্রি ও গবাদিপশুতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা; যা শিশুদের ভবিষ্যতে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দিচ্ছে এবং শিশুমৃত্যুর হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণ করে এর বিক্রেতা ও পরামর্শদাতাদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা।
অ্যান্টিবায়োটিক রোধে সরকারের উপস্থিতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জনসচেতনতা বাড়াতে সরকারি প্রচার, সেমিনার, বিজ্ঞাপন বিশেষভাবে ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়াও তৃণমূল পর্যায়ে যথার্থ জ্ঞান ও ব্যবহারবিধি সম্পর্কে ধারণা জন্মাতে হবে। একজন সাধারণ মানুষও যেন চিনতে পারেন কোন ওষুধটি অ্যান্টিবায়োটিক, এ কারণে নির্দিষ্ট রঙের মোড়ক নির্ধারণ করা যেতে পারে। নিবন্ধন করা চিকিৎসকের পরামর্শে নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক সঠিক সময় ধরে গ্রহণ করা আবশ্যিক। ডোজ পরিপূর্ণ করে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে সজাগ হতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিকের অতি সহজলভ্যতা দূর করা এবং ডাক্তারের পরামর্শ কিংবা প্রেসক্রিপশন ছাড়া এর বিক্রি বন্ধ করতে হবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ডাক্তারদের অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইবে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে লোভী ব্যবসায়ীদের লাগাম টানতে শাস্তির ব্যবস্থাসহ জনমত গঠন আবশ্যক। পরিণামে রাষ্ট্র পেতে পারে সুস্বাস্থ্য ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তিশালী এক জাতি। হ
লেখক : শিক্ষার্থী,হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর
munna0001996@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement