২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মাইক্রোবায়োলজি, হেলথ সেক্টর ও বিসিএস সমাচার

-

কেউ যখন বলেন, তিনি মাইক্রোবায়োলজি গ্র্যাজুয়েট। তখন অনেকেই বলেন, ‘এটি আবার কী’? ‘মোইক্রোবায়োলজিস্ট’ মানে কী? এর উত্তর জানার আগে চলুন জেনে নেই মাইক্রোবায়োলজিস্টরা এখন কী করছেন দেশে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে করোনা টেস্টিং ল্যাবগুলোতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট মাইক্রোবায়োলজিস্টরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে টেকনিশিয়ানদের ট্রেনিং দেয়ার পাশাপাশি ঝুঁকি নিয়ে স্বাস্থ্যবীমা ছাড়াই করোনা টেস্টিংয়ের কাজ করছেন। শহরাঞ্চলের পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে সরকারি চাকরিজীবীরা যাতে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, সে জন্য মাইক্রোবায়োলজিস্টরা তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে করোনার প্রথম জিনোম সিকুয়েন্সিং সম্পন্ন হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ড. সমীর সাহার নেতৃত্বে; তার নিজের প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনে। সরকারি অর্থায়ন ছাড়াই নিজের উদ্যোগে বিদেশী আর্থিক সহায়তায় কাজটি সম্পন্ন করেন। করোনা শুরুর দিনগুলোতে দেশে স্যানিটাইজারের ঘাটতি পড়লে মাইক্রোবায়োলজির শিক্ষার্থীরা নিজেদের অর্থায়নে শিক্ষকদের সহায়তায় স্যানিটাইজার বানিয়ে হাসপাতালে এবং নিম্নবিত্ত মানুষের মাঝে বিতরণ করেছেন। উপরের সব ক’টি কাজেই মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নিরলসভাবে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে যাওয়া বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিক্যুলার বায়োলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি প্রভৃতি বিভাগের শিক্ষার্থীদের অবদানও অনস্বীকার্য।
এবার আসা যাক ‘মাইক্রোবায়োলজিস্ট কী’? উন্নত দেশে মাইক্রোবায়োলজিস্ট মানে দেশের স্বাস্থ্যসেবায় ডাক্তারদের পাশাপাশি পরিপূরক হিসেবে নিয়োজিত একটি পেশা। মাইক্রোবায়োলজিস্ট মানে গবেষণার মাধ্যমে দেশের নীতিনির্ধারণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে এরকম একটি পেশার মানুষ। বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মাইক্রোবায়োলজিস্ট মানে দেশে পর্যাপ্ত চাকরি ও গবেষণার সুযোগের অভাবে বিদেশে পাড়ি জমানো, কিংবা নিজের ক্ষেত্র পরিবর্তনে বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হওয়া। যে দেশে ৫,২৩,১৯০ কোটি টাকা বাজেটের বিপরীতে গবেষণায় বরাদ্দের পরিমাণ সর্বসাকুল্যে ০.০০৯৫ শতাংশ, সে দেশের গবেষণাভিত্তিক বিষয়ের শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী এরকম পরিণতিই হয়তো স্বাভাবিক!
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজি প্রতিষ্ঠার পর, ১৯৭৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের প্রথম মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিগত ৪১ বছরে দেশের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এত বছরেও বিসিএসের টেকনিক্যাল ক্যাডারে মাইক্রোবায়োলজিস্টদের কোনো ঠাঁই মেলেনি। তবে ফিসারিজ (মৎস্য) ক্যাডার হিসেবে রয়েছে ‘মাইক্রোবায়োলজিস্ট’ পদ, যাতে আবেদন করার অনুমতি নেই মাইক্রোবায়োলজির শিক্ষার্থীদের। অথচ দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে বিসিএসে মাইক্রোবায়োলজিস্টদের আলাদা করে ক্যাডার থাকা যে কত জরুরি ছিল, কোভিড-১৯ এর চলমান সঙ্কটময় মুহূর্তে তা টের পাওয়া গেছে।
বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজগুলোতে লেকচারার পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নীতিমালা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়। প্রতিটি মেডিক্যালে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ থাকলেও, সেখানে আবেদনের সুযোগ দেয়া হয় শুধুই এমবিবিএস পাস করা ডাক্তারদের। তবে কী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে চার বছর গ্র্যাজুয়েশন, এক বছর মাস্টার্স করে আসা শিক্ষার্থীদের মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ক জ্ঞান কম কিংবা এমবিবিএসের মাইক্রোবায়োলজির সিলেবাস আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজির সিলেবাসে অনেক তফাৎÑ এরকম কিছু? বিএমডিসি কর্তৃক প্রণীত এমবিবিএসের মাইক্রোবায়োলজি সিলেবাসের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি সিলেবাসের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা যাক। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টের সিলেবাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরূপ। এমবিবিএসের তৃতীয়বর্ষের একটি সাবজেক্ট হিসেবে মাইক্রোবায়োলজি পড়ানো হয়। এ সাবজেক্টের সিলেবাসে আটটি টপিক রয়েছে। এগুলো হলো জেনারেল ব্যাকটেরিওলজি, সিস্টেমিক ব্যাকটেরিওলজি, ইমিউনলজি, প্যারাসাইটোলজি, ভাইরোলজি, মাইকোলজি, ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি ও ব্যবহারিক। এগুলোর সব কিছুই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই মেডিক্যাল কলেজগুলোতে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের লেকচারার নিয়োগ পরীক্ষায় এমবিবিএস ডাক্তারদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজিস্টদেরও সুযোগ দেয়া যৌক্তিক বলে মনে করি।
মহামারীর এই কালে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনা প্রতিরোধে জাতীয় সমন্বয়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ধরনের কমিটিতে ডাক্তার, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, মলিক্যুলার বায়োলজিস্ট, পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্ট, ইকোনমিস্ট প্রভৃতি বিভিন্ন ঘরানার এক্সপার্টদের যুক্ত করার কথা। কিন্তু জাতীয় কমিটিতে শুধু ডাক্তারদের রাখা হয়েছে। এ কমিটিতে ডাক্তারদের পাশাপাশি মহামারী সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ের অভিজ্ঞদের নিয়ে সত্যিকার অর্থে ভারসাম্যপূর্ণ একটি সমন্বয় করা হতো, তবে হয়তো আমরা আরো ভালোভাবে করোনা মোকাবেলা করতে পারতাম।
কাজেই শিগগিরই বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে মাইক্রোবায়োলজিস্ট ক্যাডার সৃষ্টি, মেডিক্যাল সেক্টরে মাইক্রোবায়োলজিস্টদের অন্তর্ভুক্তিসহ গবেষণাবান্ধব বাজেট প্রণয়ন করে গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত সব ডিসিপ্লিনের মেধাবী শিক্ষার্থীদের দেশের উন্নয়নে গবেষণার সুযোগ করে দেয়া এখন সময়ের দাবি। হ
লেখক : বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সুপারিশকৃত), নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ
asirajeee@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement