২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চীন-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্ক

-

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি চীন। দেশটির অর্থনীতির যেকোনো প্রভাব পড়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে। আর দক্ষিণ এশিয়ার জনবহুল ছোট দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ-চীন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশ ভালো। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার বাংলাদেশ। আমাদের দেশের অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে চীনের প্রভাব দৃশ্যমান। চীনের অর্থনীতির উন্নতি-অবনতি দুইয়ের প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় ২৬ শতাংশই আসে চীন থেকে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে ১৩ হাজার ৬৫১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়। এর বিপরীতে রফতানি হয়েছে ৮৩১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। দিন দিন উভয় দেশে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ও ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল, ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশের বেশির ভাগ আসে চীন থেকে। অন্য দিকে চামড়া, চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য, কাঁকড়ার বৃহৎ বাজার চীনে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণস্বরূপ পোশাক শিল্পের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ কাঁচামাল আসে চীন থেকে। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের কাঁচামালের প্রধান উৎস চীন। দেশের ওষুধ শিল্পের ২৬ শতাংশ কাঁচামাল আসে চীন থেকে। অন্য দিকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বিশাল বাজার চীন। বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের ৬৫ শতাংশ বাজার চীনে। কাঁকড়া ও কুঁচিয়া রফতানি করে প্রতি বছর ১০০ কোটি টাকা আয় করে বাংলাদেশ; যার ৯০ শতাংশই আসে চীন থেকে। শুধু আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক। বাংলাদেশে রয়েছে চীনের বৃহৎ বিনিয়োগ। পদ্মা সেতু, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগ, ঢাকা বাইপাস, মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্পের কাজগুলো করছে চীনা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রকল্পে প্রায় দেড় হাজার চীনা নাগরিক কাজ করছে। এর বাইরে অন্য প্রকল্পে কাজ করছে আরো ৫০০ চীনা নাগরিক। বাংলাদেশে আমদানি পণ্যের বেশির ভাগ আসে চীন থেকে।
এফবিসিসিএইর তথ্য মতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের সাথে চীনের মোট বাণিজ্য ১৪ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। আমদানি বাণিজ্যের পরিমাণ ১৩ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার এবং রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ ৮৩১ মিলিয়ন ডলার। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের প্রভাব ও অবদান কম নয়। বাংলাদেশ ও চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ।
গত ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু হওয়া, বৈশ্বিক করোনার ফলে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল অবস্থা। পুঁজিবাজারের নিম্নমুখী সূচক, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম কমানো, কর্মী ছাঁটাই, সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি দিশেহারা প্রায়। বৈশ্বিক করোনা বিরূপ প্রভাব পড়েছে চীনা অর্থনীতিতেও।
গবেষকদের মতে, করোনার কারণে অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনের জিডিপি ১ শতাংশ কমে গিয়ে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে। কর্মসংস্থানেও সৃষ্টি হতে পারে জটিলতা। চীনের অর্থনীতির প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের ওপর। দেশের সুধীজনরা করোনার প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি, চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ হিসাব নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত। করোনার ফলে তিন হাজার কোটি টাকার ক্ষতির হিসাব দিয়েছিলেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। ট্যারিফ কমিশনের হিসাব বলছে, আমদানি-রফতানি সঙ্কুুচিত হওয়ায় কয়েকটি খাতে অন্তত ছয় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হতে পারে। জানুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক মাসে চীন থেকে আমদানি কমেছে ২৬ শতাংশ। জানুয়ারি মাসে মোট আমদানি হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার ২৯ টন পণ্য। ফেব্রুয়ারিতে আমদানি হয়েছে চার লাখ ১৭ হাজার ১১৯ টন পণ্য। আমদানি কমেছে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার ১৯০ টন বা ২৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ। রাজস্ব কম আদায় হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ শ’ কোটি টাকা (সূত্র : চট্টগ্রাম কাস্টম)। করোনার প্রভাবে কাঁকড়া ও কুঁচিয়া রফতানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এ খাতে ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই হচ্ছে করোনার ফলে বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্যের লাভ-ক্ষতির হিসাবের নকশা। যখন বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রা ধরে রাখার কথা, করোনার প্রভাবে দেশের অর্থব্যবস্থা কেমন হবে? করোনা-উত্তর অর্থব্যবস্থা কেমন হবে? ইত্যাদি হিসাব-নিকাশ নিয়ে চিন্তিত দেশের অর্থনীতিবিদরা। ঠিক সেই প্রান্তিককালে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের সুবর্ণ সুযোগ দিলো চীন। ১ জুলাই থেকে ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, ‘চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলার। চীন থেকে বাংলাদেশ আমদানি করে ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, বিপরীতে এক বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে।’ চীন ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ২০০০ সালে ৯০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ২০১৫ সালে ১৪৭০ কোটি ডলারে পৌঁছায়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ১২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারে। ২০২১ সাল নাগাদ চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ১৮ বিলিয়ন ডলার হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি চীনের দেয়া ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের সুযোগের ফলে বাংলাদেশ-চীন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ঘাটতি কিছুটা কমবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদরা। ২০২১ সালের লক্ষ্যকে সামনে রেখে শুল্কমুক্তের সুযোগকে কাজে লাগাত হবে। পণ্যের গুণগতমান ও বৈচিত্র্য আনতে হবে। আরো অর্থনৈতিক এলাকা গড়ে তুলতে হবে। বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো বাড়াতে হবে। দক্ষ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পার মাধ্যমে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুযোগ কাজে লাগিয়ে দুই দেশের বাণিজ্যে ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে। হ
লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইবি, কুষ্টিয়া
studentid098 @gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement