আসামে খোদ হিন্দুরাও নিরাপদ নয়!
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৯:৩১
৩১ অগাস্ট আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তথা এনআরসি তালিকা প্রকাশ হবার কয়েক মিনিট পরেই নিজের মিষ্টির দোকান থেকে ছুটে রাস্তার ওপারে কম্পিউটারের দোকানে গেলেন রমাকান্ত বিশ্বাস। আসামের কাছাড় জেলার শিলচরের বাইরে ছোটদুধপাতিল, সে কম্পিউটারের দোকানের সামনে তখন বহু লোক। সবচেয়ে কাছের যে এনআরসি সেবাকেন্দ্র তা বেশ কিছুটা দূরে, নৌকে পেরিয়ে যেতে হয় সেখানে।
রমাকান্তের হাতে অত সময় নেই। ২০১৮ সালের তিন বছর ধরে মামলা চালানোর পর রামকান্ত, তার ভাই ক্ষিতীশ ও মা বাসন্তী তিনজনেই বিদেশি ট্রাইবুনালে নিজেদের নামের পাশ থেকে ডি ভোটার চিহ্ন সরাতে সক্ষম হন। এনআরসি, ভারতীয় নাগরিকত্বের নথিতে সে পরিবারের এবার ঠাঁই পাওয়ার কথা, সে সার্টিফিকেটের দৌলতে তারা এ ভারতের আইনি বাসিন্দা হবেন।
কিন্তু তা হলো না। রমাকান্তের নিজের নাম নেই সে তালিকায়, নেই ক্ষিতীশের নাম, এমনকি তার ছোট ভাই লক্ষ্মীকান্তের নামও নেই। শুধু তাঁর মা বাসন্তী আর আরেক ভাই কলিকান্তের নাম উঠেছে এনআরসি তালিকায়।
“আমরা ভেবেছিলাম ভারত নিরাপদ। এ কিসের নিরাপত্তা?” ক্রুদ্ধ শোনায় রামনাথের গলা। ১৯ লক্ষের নাম বাদ পড়ার কথা এনআরসি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করার পরদিন কথা হচ্ছিল রামনাথের সঙ্গে।
ছোটদুধপাতিলে তখন সন্ধ্যা নামছে। রামকান্তর মিষ্টির দোকানের সামনে ভিড় জমাচ্ছেন এলাকার বাসিন্দারা, যেমনটা তারা প্রতি সাঁঝেই জমান। ৫০ বছরের বিধান শংকর, তার স্ত্রী ও মা, কারোর নাম নেই। “আমরা জানি আসামে অভিবাসন সমস্যা রয়েছে, তাই বলে আমরা কেন এ ঝামেলায় পড়ব? আমরা হিন্দু।”
রমাকান্ত ও তার ভাইয়েরা সবাই ছোটদুধপাতিলেই জন্মেছেন। তাদের বাবা ১৯৫৬ সালে বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) থেকে ভারতে এসেছিলেন। রমাকান্তদের মা বাসন্তী এ পারে এসেছিলেন তারও আগে। বেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্বাস পরিবারের বহু সদস্য পিসি, কাকা, খুড়তুতো ভাইয়েরা এ পারে আসতে থাকেন, বাংলাদেশের ভংয়কর সব ঘটনার হাত থেকে বাঁচতে। কেউ পেরেছিলেন, কেউ পারেননি। রমাকান্ত বলছেন তাদের পরিবার বাংলাদেশের সিলেট জেলার জগন্নাথপুরে ছড়িয়ে রয়েছে, সে পরিবারের কাউকে কখনো চোখেও দেখেননি তিনি।
এ ইতিহাস বিশ্বাস পরিবারের একার নয়। কাছাড় জেলার ছোটদুধপাতিল সংলগ্ন এলাকায় দেশভাগের সময় জুড়ে বহু মানুষ এপারে এসে বসতি জমিয়েছেন দক্ষিণ আসামের বরাক উপত্যকায়। বরাকের মধ্যে পড়ে কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি।
উপল পাল। এক দোকানদার। বলছিলেন, “বহু ঘটনা আছে যেখানে ছেলেমেয়েরা বাবা মা-কে ফেলে এসেছে, ভাইয়েরা বোনেদের ছেড়ে এসেছে। আমরা সবাই ১৯৭১-এর আগে ভারতে এসেছি সুরক্ষার আশায়। তা সত্ত্বেও এখানকার প্রায় অর্ধেক পরিবার এনআরসি-র বাইরে। এ কী করে হল! বিজেপির কি আমাদের বাঁচানো উচিত ছিল না?”
বিজেপি অবশ্য নাগরিক পঞ্জিকে অস্বীকার করতে সময় নষ্ট করেনি।
শিলচরের বিজেপি এমপি রাজদীপ রায় বলছেন, “আমার সামনে এখন একটি পরিবার বয়ে রয়েছে যাদের জমির কাগজপত্র রয়েছে ১৯৫৯ সাল থেকে। পরিবারের সাতজনের নাম বাদ, শুধু মেয়ের নাম রয়েছে। আমরা পুনর্যাচাই চাই, এবং তা না হওয়া অবধি আমরা এই এনআরসি মানব না। তিনি বললেন, তার দল নাগরিকত্ব বিল আনবে, যে বিলে অমুসলিম অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। একবার ক্যাব এলে এই সমস্ত পরিবার নিরাপদ হয়ে যাবে।”
তবে কাছাড় জেলাতেই এ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। অল আসাম বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসসিয়েশনের শান্তনু সূত্রধর বললেন, “বিল তো এসে চলে গেছে। আবার আসবে তার নিশ্চয়তা কোথায়?”
শিলচরের শান্তনু সূত্রধরের নাম ৩০ জুলাইয়ের খসড়া এনআরসি-তে ছিল না। “কিন্তু এবার নাম উঠেছে। আমার বাবা ছিলেন জেলা জজ, এমনকি বিদেশি ট্রাইবুনালেরও জজ ছিলেন তিনি। তার ছেলের নাম না থাকাটা খুবই হাসির হয়েছিল।”
এ সংগঠনের সদস্যরা মনে করেন কোনো হিন্দু বিদেশি হতে পারে না। ওরা সবাই এখানে আশ্রয়ের জন্য এসেছিলেন।
৭৬ বছর বয়সী ছোটদুধপাতিলের নারায়ণ দাস ১৯৬৩ সালে এখানে এসেছিলেন। “আমি সিলেট থেকে এসেছিলাম পরিবারের লোকের সঙ্গে দেখা করতে। এসে শুনলাম সিলেটে আমি যেখানে থাকি সেখানে খুব ঝামেলা হচ্ছে। আমি আর ফিরিনি।” শিলচরের কৃষি দফতরে নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ করতেন নারায়ণ। তা সত্ত্বেও তার নাম এনআরসি তালিকায় নেই।
নারায়ণের মত লোকজনের পরের যাত্রাপথ বিদেশি ট্রাইবুনালের দিকে। রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছে গরিব মানুষের জন্য বিদেশি ট্রাইবুনালে যাওয়ার আর্থিক খরচ জোগাবে। তবে অনেকের মনেই সে নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। “যাতায়াত খরচের কী হবে?” প্রশ্ন করছেন রমাকান্ত। “আমার আগের বারের শুনানির সময়ে যাওয়া আসায় ৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।”
২০ বছর আগে তিনি খুলেছিলেন মান মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এ অঞ্চলে বড় মিষ্টির দোকান বলতে ওটাই। ছোটদুধপাতিলের উন্নয়ন বলতে কিছু হয়নি, রাস্তা নেই বললেই চলে, প্রতি বছর বন্যায় বিধ্বস্ত হয় এ এলাকা, কদাচিৎ হাসপাতালে ডাক্তারের দেখা মেলে। এক গ্রামবাসী বললেন, বাড়ি বানিয়েছে, ডাক্তার পাঠায়নি। তাকে ঘিরে হাসির হল্লা ওঠে।
এ ধরনের সমস্যা নিয়েই বাঁচতে শিখে গিয়েছেন গ্রামবাসীরা। কিন্তু অনেকের কাছেই নতুন করে দেখা দিল এনআরসি সমস্যা।
সন্ধ্যাবেলা ছোটদুধপাতিলের রাস্তায় এক থলে ভর্তি কাগজ নিয়ে ঘুরছিলেন শীর্ণ চেহারার নমিতা দাস। জনে জনে জিজ্ঞাসা করছিলেন, এর পর কী করতে হবে! ৫০ বছরের নমিতার দিন কাটে ভিক্ষা করে। সঙ্গে তার প্রতিবন্ধী ছেলে। হাত তুলে নমিতা জিজ্ঞাসা করছিলেন, “আমার আঙুলের ছাপ নেবে? তাতে হবে?”
সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা