১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


ক্ষমতা, বিত্ত ও দুর্নীতির শেকড়-বাকড়

-

এখন আর এ কথা এড়িয়ে যাওয়া বা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, দেশে অবক্ষয় দুর্নীতি ও অনৈতিকতার শেকর-বাকড় ক্ষমতাকে আশ্রয় করে এতটা বিস্তৃত হয়ে দানবে পরিণত হয়েছে; যা কি না খোদ প্রশাসনের জন্য হুমকির সৃষ্টি করেছে। ক্ষমতাসীন দল ও তার নানা অঙ্গসংগঠনের নেতৃস্থানীয় সদস্যদের জুয়া মাদকসহ নানা অনৈতিক কার্যক্রম সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতাসীনরা রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছে। এ সময় সব দিক ‘ম্যানেজ’ করে সংগঠনের একশ্রেণীর নেতা ধনকুবের বনে গেছে। এরা এই অকল্পনীয় সম্পদের মালিক হয়েছে ক্ষমতা প্রভাব প্রতিপত্তি ব্যবহার করে।

দেশের প্রধান নির্বাহী কিছুকাল আগে এ কথা ঘোষণা করেছিলেন যে, বর্তমান প্রশাসন অনিয়ম বিশেষ করে অর্থনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স প্রদর্শন করবেন। এই প্রতিশ্রুতি মানুষর মধ্যে একটা স্বস্তি এনেছিল যে, তারা সমাজের এখন যে অবস্থা দেখছেন তার একটা প্রতিকার হতে পারে। সেইসাথে এমন আশঙ্কাও ছিল যে, সরকার রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারে প্রতিপক্ষ দমনে। অর্থাৎ যারা ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষ তাদের না আবার দুর্নীতির অবসানের নামে হয়রানিতে ফেলেন। তবে এটা প্রশংসনীয় যে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ক্ষমতাসীনেরা নিজদের ঘর থেকেই শুরু করেছে। তবে এ কথাও সত্য যে, ক্ষমতাসীনদের ঘরের মধ্যে এখন যে দুর্নীতি তা এড়িয়ে অন্যত্র দৃষ্টি দেয়া একটা হাস্যকর ব্যাপার হতো। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের এবং অঙ্গ সংগঠনের নেতারা ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জুয়ার যে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, তার যে চেহারা দেখা গেছে তাতে আর বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।

কেননা বিষয়টি সবারই জানা ছিল কিন্তু ভয়-ডরে কেউ মুখ খুলত না। তবে অনেকেই মনে করেন এখন দুর্নীতির যে চিত্রটি প্রকাশ পেয়েছে, তা কেবল মাত্র হিমশৈলের চূড়াটি মাত্র। গভীর পানিতে নিমগ্ন রয়েছে হিমশৈলের বিশাল অবয়বটি। তাই যে অভিযান এখন শুরু হয়েছে তা যেন মূল উৎপাটন ছাড়া মাঝপথে থেমে না যায়। কারণ এটা কোনো সাধারণ দুর্নীতি নয়। এর সাথে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা অনেকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। সেই ক্ষমতাধররা নিশ্চয় এটা চাইবেন না যে থলের কালো বিড়াল বেরিয়ে যাক। তাই থলের মুখ আরো আঁটসাঁটভাবে বেঁধে দেয়ার চেষ্টায় তারা তৎপর হবেন। তবে এটা সত্য, যে অভিযান শুরু হয়েছে তার প্রতি দেশের সব সাধারণ মানুষের জোরালো সমর্থন রয়েছে। আর সে জন্য অভিযান অব্যাহত রাখা অবশ্যই এটা একটা বড় শক্তি। দেশ থেকে নিয়মিত যে বিপুল অর্থ পাচার হতো, এখন এই অভিযান চলার কারণে যাতে আর কোনো অর্থ পাচার না হয় সে বিষয়ে লক্ষ রাখা উচিত। এরই মধ্যে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে, জুয়ার সাথে জড়িত বড় বড় অপরাধীরা গাঢাকা দিয়েছে। এরাও যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

জুয়ার তথা ক্যাসিনোর কালো টাকার সাথে সম্পৃক্তরা সবাই রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাই কালো টাকা রাজনীতিতে প্রবেশ করেনি এ কথা বলার উপায় নেই বরং এটা স্বাভাবিক যে, এ টাকা রাজনীতিতে প্রবেশ করে তাকে কলুষিত করার ক্ষেত্রে ব্যয় হয়েছে। সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে নেতিবাচক ধারা লক্ষ করা যায়, তাতে এই নীতিহীন রাজনীতির সাথে এদের ভূমিকার বিষয়টি কোনোভাবে অবজ্ঞা করা যাবে না। তাই শুধুু অর্থনৈতিক অনিয়ম দুর্নীতির মন্দ পথেই তারা চলেনি, সেই সাথে দেশের রাজনীতিতে এখন যে সঙ্কট তার কুশীলবদের পেছনে এদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। আসলে দুর্নীতি আজ যে গভীর অতলে পৌঁছেছে তাকে টেনে তোলার উদ্যোগ সফল করা কঠিন কাজ। এসব অক্টোপাস তাদের শত হাতে এই উদ্যোগকে সেই অতলে টেনে নেয়ার হেন চেষ্টা নেই যা করবে না। যেহেতু এদের হাতে রয়েছে প্রচুর অর্থবিত্ত এবং ক্ষমতা। তাই ঘুরে দাঁড়ানো সব চেষ্টা তারা করবে।

ক্যাসিনো তথা জুয়া আমাদের দেশের সংবিধানের নির্দেশনার পরিপন্থী। একে বিলোপ করার সব উদ্যোগ নিতে হবে এটাই সংবিধানের চেতনা। অথচ এই বেআইনি তৎপরতা সমাজে বিস্তৃত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনে এবং তাদের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল বলে পত্রপত্রিকায় অভিযোগ করা হয়েছে। যারা আইনকে রক্ষা ও তার প্রতিষ্ঠা করে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বিধান করবে, তাদের দিয়েই এখন আইনের সংহার ঘটছে। তাই এর যদি সরল অর্থ করা হয় তবে এ কথাই বলতে হবে, এসব বাহিনী আইনানুযায়ী পথ না চলে কুচক্রীদের বিকশিত হওয়ায় এবং আইনকানুনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে সাহসী করেছেন।

আসলে এসব সংস্কার ছাড়া এসব বাহিনীর কাছে জনগণ কোনো সেবা সুরক্ষা পেতে পারে না। কেননা জনগণ যে দেশের মালিক এই চেতনায় তারা বিশ্বাসী নয়। বরং এ অনিয়ম দুর্নীতির পথে চলে তারা ক্ষমতা অর্থবিত্ত যে পথে, তাকেই তারা কুর্নিশ করে চলেছে এবং পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। যেখানে এদের প্রজাতন্ত্রের অনুগত কর্মচারী হওয়ার কথা, সেখানে এর পরিবর্তে এরা সমাজবিরোধীদের পাশে থেকে তাদের মদদ দিয়েছে। আজ রাষ্ট্রযন্ত্রের যে দৈন্যদশা তার মূল কারণ প্রজাতন্ত্রের এসব বেতনভুক কর্মচারীর দুরাচার। এসব কর্মচারী রাষ্ট্রীয় আইন অনুসরণ ও সুনাগরিকদের সেবা দেয়ার পরিবর্তে ক্ষমতা অর্থবিত্তের পিছু হেঁটেছে।

বিভিন্ন গবেষণা নিরীক্ষায় এটা উঠে এসেছে যে, দেশের সম্পদ মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে। পক্ষান্তরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দিন দিন হতদরিদ্র হয়ে পড়েছে। সমাজের এই বৈষম্য দূর করা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অন্যতম দায়িত্ব ছিল। কিন্তু ঘটেছে তার উল্টো ব্যাপার। ফলে প্রশাসনের সহায়তায় এই বৈষম্য দিন দিন স্ফীত হয়েছে। এমন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা দারুণভাবে ক্ষতি হয়েছে। তা শুধু দেশেই ঘটেনি, আন্তর্জাতিক বলয়ে বাংলাদেশের সুনাম ও মর্যাদা ক্ষুণœ হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত যেসব দেশ রয়েছে, সে তালিকায় বাংলাদেশের নাম শীর্ষপর্যায়েই রয়েছে। এই চিত্র দেশের সাধারণ মানুষের জন্য দুঃখ ও অপমানের, কেননা তারা দুর্নীতির সাত পাঁচে নেই অথচ মুষ্টিমেয় মানুষের কারণে তাদের শিরে দুর্নীতির ‘তকমা’ লেগেছে। ফলে গোটা জাতির সম্মান মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। এই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযান যেন অনুরাগ বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সঠিক পথে পরিচালিত হয়। মরুপথে তা যেন হারিয়ে না যায়।

চলমান অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানকে দেশের সব মানুষ অকুণ্ঠভাবে স্বাগত জানিয়েছে। তারা এই অভিযান অব্যাহত থাকুক এটাই শুধু চায় না বরং তারা কামনা করে অভিযান বহুমাত্রিক হোক। কেননা এখন সমাজের সর্বস্তরে সমস্যা ঘনীভূত হয়ে আছে। যা কিনা দেশ অকার্যকর করে তুলতে পারে। আর তাতে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যারা আত্মত্যাগ করেছে তাদের অবদানকে ম্লান করে দেয়া হবে।

রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে সহায়তা দিয়ে থাকে আমলা শ্রেণী। রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে ন্যায়নিষ্ঠ সিদ্ধান্ত ও সঠিক কর্মপদ্ধতি অনুসরণের জন্য আমলাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় দেখা যায়, আমলারা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা অদক্ষতার কারণে হয়ে ওঠে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। আজকে আমলাদের অবস্থা তাই।

এখন সমাজে যে অনিয়ম অব্যবস্থা তাতে মনে হয় রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ ও আমলাদের মধ্যে এখন সমন্বয়ের তীব্র অভাব রয়েছে। হয় আমলারা সৎ পরামর্শ দিচ্ছেন না অথবা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ আমলাদের কথা অগ্রাহ্য করছেন। রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ চলবে জনগণকে দেয়া তাদের প্রতিশ্রুতি অনুসারে আর আমলারা চলবে রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান ও ন্যায়নীতি অনুসরণ করে। এই দুইয়ের সীমানা এভাবেই নির্ধারিত রয়েছে। সে যাই হোক, আজ দেশের যে সামগ্রিক অবস্থা তাতে বুঝতে হবে এটা এক দিনে হয়নি এবং পেছনে পলিটিক্যাল অথরিটি এবং প্রশাসনের মদদ ছিল। অভিযানের যে লক্ষ্য এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান তাতে এসবের জন্য কাজ করা হচ্ছে বটে, তবে কোনো অবস্থায়ই তা যেন মাঝপথে থেমে না যায়। আর এই যে দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে তার পথপ্রক্রিয়া বজায় থাকলে ভবিষ্যতে এমন বা তার চেয়ে বড় ঘটনা ঘটতে পারে। আমাদের প্রশাসনের কর্মকর্তারা আইনগতভাবে রাষ্ট্রের কর্মচারী। রাষ্ট্রীয় নীতি-আদর্শ এবং বিধিবিধানকে অনুসরণ করে তারা প্রশাসন পরিচালনা করবে। আমলাদের সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার শর্ত হবে তারা সরকারের আনুগত্য ততটুকুই করবে যতটুকু করলে রাষ্ট্রীয় নীতির অধীন হবে।

এই নীতি শুধু এখনকার জন্য নয়, সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য। যে সরকার যখনই আসুক তাদের এই নীতি অনুসরণ করে চলতে হবে। কিন্তু আজ সেখানে প্রশাসন সেই নীতি অনুসরণের পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের প্রতি এতটা আনুগত্য প্রদর্শন করছে, যেন সরকারের রাজনৈতিক অভিলাষকে পূরণ করাই তাদের লক্ষ্য। এর ফলে এই প্রশাসন রাষ্ট্রের না হয়ে সরকারের হয়ে উঠেছে। তাই স্বাভাবিকভাবে এদের কার্যক্রম দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য নয় বরং তা গোষ্ঠীর স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান প্রশাসনের এমন লক্ষ্য উদ্দেশ্য থাকার কারণে দেশের বেশির ভাগ মানুষ প্রশাসনের সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এসব অনিয়ম খুঁজে বের করে তাদের শুদ্ধাচারের নীতি অনুসরণ করার জন্য বাধ্য করা উচিত। শুদ্ধাচারের অভিযান পরিচালনার ফলে যে অনিয়ম দুর্নীতির খোঁজ পাওয়া গেছে, এখন সে পরিপ্রেক্ষিতে সবারই ধারণা আমলাদের বিরুদ্ধে অভিযান হলে আরো অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে। রাষ্ট্রযন্ত্রের সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে সৎ দক্ষ ও নীতিনিষ্ঠ আমলা শ্রেণী থাকা। যার অভাব এখন প্রকট। বর্তমানে আমলাদের দক্ষতার অভাব তত না হলে সততা নীতিনিষ্ঠতার অভাব রয়েছে।

তাদের নীতি আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা এতই কম যে রাজনীতিকদের লোভলালসা চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে সব সময়ই হাতিয়ার এবং সহযোগী ছিলেন। রাজনীতিকরা আইন-কানুনের ফাঁকফোকর কম বোঝেন, তাই তাদের অন্ধকারে পথ চলতে আমলারা আলো জ্বালিয়ে সাহায্য করে। তা না করে দেশকে রসাতলে নিয়ে যান রাজনীতিক ও আমলারা। আমলারা দুর্নীতি অনিয়ম করার ব্যাপারে রাজনীতিবিদদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেও যখন এসব নিয়ে রাজনীতিকরা বিপদগ্রস্ত হন, তখন কিন্তু আমলারা নেপথ্যেই থেকে যান। তবে এ কথা সত্য, গড়ে সব আমলাকে এক পাল্লায় তোলা যায় না। এমন বহু আমলা রয়েছেন যারা নিবেদিত এবং রাজনীতি ও এর মন্দ প্রভাব থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখেন।

দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মসৃণ করার জন্য যেসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে গঠন করা হয়েছে তার মধ্যে নির্বাচন কমিশন অন্যতম। অথচ বর্তমান কমিশনের যারা দায়িত্বশীল তাদের মধ্যে অনেকেই গণতন্ত্রের প্রাণ নির্বাচনব্যবস্থাকে কলুষিত করে ফেলেছেন। বিশেষ করে গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কমিশনের ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক। ভোট প্রক্রিয়ায় নির্লজ্জভাবে তাদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা প্রদর্শন করেছেন। ক্ষমতাসীনদের প্রতি অনুরাগ হেতু তাদের বিজয়ী করার জন্য এ সম্পর্কীয় সব নীতি নিয়ম বিসর্জন দিয়েছেন। গণতন্ত্রের মূল চেতনা হচ্ছে মানুষের মতপ্রকাশের অবাধ সুযোগ নিশ্চিত করা। নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে সে মতে রাষ্ট্রীয় আইনসভা গঠনের অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু গত সাধারণ নির্বাচনে জনগণ তাদের ভোট দেয়ার অধিকার হারিয়েছে। রাতের অন্ধকারে কৌশল অবলম্বন করে ভোটের বাক্স পূর্ণ করা হয়। অথচ নির্বাচন কমিশন সব রাষ্ট্রীয় নীতিনির্দেশনা বিসর্জন দিয়ে এই ফর্জারিকে নীরব সমর্থন দেয়া হয়েছে।

এর ফলে দেশের মানুষ ভোট দেয়ার ব্যাপারে এতটা হতাশ ও মনোক্ষুণœ হয়েছে যে তারা পরবর্তী উপজেলা নির্বাচনে আর ভোটকেন্দ্রেই উপস্থিত হয়নি। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এমন বিপর্যয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সমাজ। এমন ভোট করিয়ে কমিশন শুধু নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিনষ্ট করেনি, সেই সাথে এমন ভোটে যে আইনসভা গঠিত হয়েছে, তা এখন একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দেশের মানুষের সত্যিকার প্রতিনিধিত্ব সে সভায় ঘটেনি বলেই এখন দেশের সমস্যা সঙ্কটের বিষয়ে সংসদে আলোচনা হয় না। বাংলাদেশের মানুষ বহু সমস্যায় ভুগছে অথচ আইনসভায় আলোচনায় তার কোনো প্রতিফলন নেই।

এসবের সংস্কার হওয়ার পাশাপাশি একটা বিষয় স্মরণ রাখা উচিত, এর আগে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের হস্তক্ষেপ বন্ধের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান করা হয়েছিল। ভোটব্যবস্থায় এই পরিবর্তন আনার পর যতবার জাতীয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার প্রতিটি সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়াই হয়েছে এবং সেসব নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন হয়নি। সরকারের হস্তক্ষেপ না থাকায় নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নির্বাচন কমিশনে কমিশনার নিয়োগ করা যে পদ্ধতি এখন অনুসৃত হচ্ছে তাও আসলে ত্রুটিপূর্ণ এবং এই প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের কমিশনের দায়িত্বশীল করা সম্ভব নয়। কেননা এখন যে পদ্ধতিতে কমিশনার নিয়োগ হয় তাতে সরকারের অনুগতদেরই নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। যেমন এখন যারা নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করছেন তাদের প্রায় সবাই সরকারের পছন্দের ব্যক্তি। এদের দিয়েই ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ সংসদের নির্বাচন প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। সে নির্বাচন কেমন হয়েছে সে সম্পর্কে দেশের মানুষ সম্যক অবহিত।

চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান থেকে এটা বেরিয়ে এসেছে যে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর ভেতরে কত হলাহল রয়েছে। অবশ্য এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, অভিযান এখন পর্যন্ত একটা ক্ষুদ্রমাত্রার মধ্যেই সীমিত রয়েছে। আর তা যদি বড় গণ্ডিতে প্রবেশ করে তবে কী এলাহিকাণ্ড ঘটবে তা অনুমানের বাইরে। যে যাক, এই অভিযান আরো অনেক বিষয়ে এটা প্রমাণ করেছে ক্ষমতাসীনদের একটি অংশ এখন রাজনীতি করে প্রকৃতিপক্ষে আত্মপ্রতিষ্ঠা এবং অর্থ বৈভব ক্ষমতা প্রভাব প্রতিপত্তি লাভের জন্য। মানুষের সেবার নিয়তে রাজনীতি করার যে মহান আদর্শ তার ধারেকাছে তারা নেই।

চলমান অভিযানকে কেন্দ্র করে পত্রিকায় যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে জানা যায়, যারা এই অভিযানে অভিযুক্ত হয়েছেন, তারা সংগঠনের পদপদবি লাভের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করেছেন। যেমন কি না অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যবসায় বিনিয়োগ করা। তারপর কেবল লাভ আর লাভ। আসলে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি করে সোচ্চার বটে কিন্তু নিজেদের দলে কোনো গণতন্ত্র নেই। চলমান অভিযান থেকে এটাই বোঝা গেল পদপদবির জন্য দলের কর্মী সমর্থকদের সমর্থন জরুরি নয়, উপরের নেতাদের সন্তুষ্ট করে পদপদবি পাওয়া যায় এবং ক্ষমতা ও বিত্তে পরিপুষ্ট হওয়া যায়।

ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল