২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাসূলুল্লাহ সা:-এর সামাজিক যোগাযোগ

যেখানে শায়িত আছেন রাসুল (সা) - ছবি : সংগৃহীত

সাধারণত যারা রাজনৈতিক নেতা, সরকারের মন্ত্রী বা বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি হন, তারা সব শ্রেণীর জনমানব থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকেন। তারা এত বেশি ব্যস্ত থাকেন, তাদের অন্যদের দিকে মনোযোগ দেয়ার সময়-সুযোগ ও মানসিক চিন্তা-চেতনা কোনো কিছু থাকে না। 

কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা: সমাজের সর্বস্তরের জনমানুষের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। কখনো একাকী, কখনো দলবদ্ধ অর্থাৎ স্থান, কাল ও পরিবেশ অনুযায়ী তিনি সর্বস্তরের জনগণের কাছে ছুটে যেতেন। এই যোগাযোগ ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ থেকে শুরু করে ছোট কোনো বিষয়ও বাদ যেত না। সমাজের নি¤œস্তর যেখানে সাধারণত কারো নজর পড়ে না, রাসূল সা: সেখানেও নির্দ্বিধায় পৌঁছে যেতেন। ইতিহাসের পাতায় অসংখ্য এ ধরনের যোগাযোগের উদাহরণ রয়েছে। 

‘একবার খেলার মাঠে রাসূলুল্লাহ সা: এক শিশুকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ওই লাল পাখিটা কোথায়? ছেলেটি আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল, আপনি এতদিন আগের কথা মনে রাখলেন কী করে?’ হাজারো কাজ, হাজারো ব্যস্ততায় এবং হাজারো শিশুর মধ্যে একটি শিশুর পাখির কথা মনে রাখাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? 

তাঁর যোগাযোগের রীতি ছিল নিম্নরূপ : 
রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে যার দেখা হতো, তিনি তাকে প্রথমে সালাম দিতেন। কাউকে খবর দিলে সালাম পাঠাতে ভুলতেন না। কেউ সালাম পৌঁছালে সালামের প্রেরক ও বাহক উভয়কে পৃথকভাবে সালাম দিতেন। শিশু, মহিলা, বন্ধুবান্ধব ও পরিবার-পরিজন সবাইকে সালাম দিতেন। সবার সাথে হাত মেলাতেন, আলিঙ্গন করতেন। 

তিনি বৈঠকাদিতে হাজির হতেন। বৈঠকের একপাশে বসে পড়তেন। কারো ডিঙিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেন না। হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলতেন, ‘আল্লাহর একজন সাধারণ বান্দা যেভাবে ওঠাবসা করে, আমিও সেভাবে ওঠাবসা করি।’ নিজের হাঁটু সঙ্গীদের চেয়ে আগে বাড়িয়ে বসতেন না। কেউ তাঁর কাছে এলে তাকে নিজের চাঁদর বিছিয়ে দিতেন। আগন্তুক নিজে না ওঠা পর্যন্ত তিনি বৈঠক ছেড়ে উঠতেন না। ফজরের জামাতের পর বৈঠকে বসতেন এবং সাহাবায়ে কেরামের সাথে অনেক কথাবার্তা বলতেন। যে বিষয়ে উপস্থিত লোকদের মুখমণ্ডলে বিরক্তির ভাব ফুটে উঠত, তিনি সে বিষয় পরিবর্তন করতেন। 

কোনো অবাঞ্ছিত লোক তাঁর কাছে এলে হাসিমুখে তাকে স্বাগত জানাতেন। একবার এমন এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এলো, যাকে তিনি সংশ্লিষ্ট গোত্রের নিকৃষ্টতম ব্যক্তি বলে জানতেন। কিন্তু তিনি তার সাথে মনোযোগের সাথে অমায়িকভাবে কথাবার্তা বললেন। এটা দেখে হজরত আয়েশা রা: বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, ‘আল্লাহর কসম যে ব্যক্তির দুর্ব্যবহারের ভয়ে লোকেরা তার সাথে মেলামেশাই বন্ধ করে দেয়, কেয়ামতের দিন সে আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি বলে গণ্য হবে।’

কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে দরজার ডান বা বাম দিকে একটু সরে গিয়ে নিজের উপস্থিতির জানান দিতেন। ভেতরে প্রবেশের অনুমতির জন্য তিনবার সালাম দিতেন। সালামের উত্তর না পেলে কোনো প্রকার বিরক্তি ছাড়াই ফিরে যেতেন। রাতে সাক্ষাতে গেলে এমন আওয়াজে সালাম দিতেন, যাতে সজাগ থাকলে শুনতে পায় আর ঘুমিয়ে থাকলে যাতে তার ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়। কেউ ডাক দিলে ‘লাব্বাইক’ বলে ডাক শুনতেন। খারাপ ব্যবহারের উত্তর তিনি খারাপ ব্যবহারের মাধ্যমে দিতেন না। বরং তিনি ক্ষমা করতেন। অন্যদের অপরাধ ক্ষমার প্রতীক হিসেবে তিনি তাদের জন্য উপহার পাঠাতেন। 

তিনি রোগী দেখতে যেতেন। শিয়রে বসে জিজ্ঞেস করতেন, তুমি কেমন আছো? কপালে ও ধমনিতে হাত রাখতেন। কখনো বা বুকে-পেটে ও মুখমণ্ডলে ¯েœহের হাত বুলাতেন। সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলতেন, ‘চিন্তার কোনো কারণ নেই, ইনশাআল্লাহ অচিরেই তুমি রোগমুক্ত হবে। রোগ মুক্তির জন্য দোয়া করতেন। হজরত সাদের জন্য তিনবার দোয়া করেছিলেন। মোশরেক চাচাদেরও রোগব্যাধি হলে দেখতে যেতেন। একজন ইহুদি শিশুকে তিনি দেখতে গিয়েছিলেন। (শিশুটি পরবর্তীতে ঈমান এনেছিল)। এ ধরনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোনো সময় বা দিন নির্ধারিত ছিল না। বরং যখনই খবর পেতেন এবং সময় পেতেন দেখতে যেতেন।

কেউ মারা গেলে সেখানে চলে যেতেন। মুমূর্ষু অবস্থার খবর পেলে বা ডাকা হলে গিয়ে তাওহিদ ও আল্লাহর ব্যাপারে মনোযোগ আকর্ষণ করতেন। মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনকে সমবেদনা জানাতেন, ধৈর্যের উপদেশ দিতেন এবং চিৎকার করে কাঁদতে নিষেধ করতেন। সাদা কাপড়ে দাফন দিতে তাগিদ দিতেন এবং দ্রুত কাফন দাফন সম্পন্ন করতে বলতেন। নিজে জানাজা পড়াতেন এবং গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করতেন। তিনি মৃতের পরিবারের জন্য খাবার পাঠাতেন। আনুষ্ঠানিক শোকসভা কয়েক দিন পর্যন্ত চলাকে খুবই অপছন্দ করতেন। 

প্রবাস থেকে ফিরে কেউ সাক্ষাতে এলে আলিঙ্গন করতেন, কখনো কখনো কপালে চুমু দিতেন। প্রবাসে যাওয়ার সময় তাকে অনুরোধ করতেন : দোয়া করার সময় আমাদের কথা মনে রেখো। ¯েœহের ও ভালোবাসার আতিশয্যে কারো কারো সাথে এতটাই অমায়িক হয়ে যেতেন যে, তাদের সংক্ষেপ নামে ডাকতেন। 

শিশুদের প্রতি ছিল তাঁর অত্যধিক দুর্বলতা। তাদের কাছে পেলে কোলে তুলে নিতেন, তার মাতায় হাত বুলাতেন, আদর করতেন, দোয়া করতেন। শিশুদের মন ভুলানোর জন্য চমক লাগানো কথা বলতেন। যেমন বলতেন, ‘টিকটিকিরা ভাই রাতে মশার চোখে ঘা মারে দাঁতে।’একবার এক শিশুকে চুমু খেতে খেতে বলেছিলেন : শিশুরা আল্লাহর বাগানের ফুল। শিশুদের নাম রাখতেন। কখনো কখনো শিশুদের লাইনে দাঁড় করিয়ে পুরস্কারের ভিত্তিতে দৌড়ের প্রতিযোগিতা করাতেন যে, দেখব কে আগে আমাকে ছুঁতে পারে। শিশুরা দৌড়ে আসত, কেউ তার পেটের ওপর, কেউ বুকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ত। তাদের সাথে হাসি-তামাশা করতেন। যেমন হজরত আনাসকে কখনো কখনো বলতেন, ‘ও দুই কানওয়ালা!’

হজরত আনাসের ভাই আবু উমাইয়ের পালিত পাখির ছানাটি মরে গেলে সে উদাসভাবে বসেছিল। রাসূল সা: তাদের বাড়ি এসে ডাক দিলেন, ‘ও আবু উমাইয়ের, কোথায় তোমার নুগায়ের (পাখির শাবক)? আরেক শিশু আবদুল্লাহ বিন বশিরের মাধ্যমে তার মা রাসূল সা:কে আঙ্গুর পাঠালেন। সে পথিমধ্যে সব আঙ্গুর খেয়ে ফেলল। পরে জানাজানি হয়ে গেল, রাসূল সা: আদরের সাথে তার কান ধরে বললেন, ‘ওরে ধোঁকাবাজ, ওরে ধোঁকাবাজ’।

প্রবাস থেকে আসার পথে যে শিশুকে পথে দেখতেন, সওয়ারির পিঠে চড়িয়ে আনতেন। ছোট শিশু হলে সামনে ও বড় শিশু হলে পেছনে বসাতেন। মওসুমের প্রথম ফলমূল আনা হলে তা বরকতের দোয়াসহ কোনো শিশুকে আগে খেতে দিতেন। বুড়োদের তিনি খুবই শ্রদ্ধা করতেন। মক্কা বিজয়ের সময় হজরত আবুবকর সিদ্দিক রা: নিজের অন্ধ প্রবীণ বাবাকে ইসলাম গ্রহণের জন্য যখন রাসূল সা:-এর কাছে নিয়ে এলেন, তখন তিনি বললেন : ওঁকে কষ্ট দিয়েছ কেন? আমি নিজেই তার কাছে চলে যেতাম। 

তিনি বিভিন্ন আলাপ-আলোচনায়ও অংশগ্রহণ করতেন। চাই তা দুনিয়াবি হোক বা আখিরাত কেন্দ্রিক। এমনকি খানাপিনার আলোচনায়ও অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু এসব সত্ত্বেও রাসূল সা: কসম খেয়ে বলেছেন যে, ‘আমার মুখ দিয়ে সত্য কথা ও ন্যায্য কথা ছাড়া আর কিছুই বের হয়নি।’ কুরআন সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, ‘তিনি মনগড়া কিছু বলেন না।’ উম্মে মাবাদ তাঁর প্রশংসায় বলেছেন, ‘তাঁর কথা যেন মুক্তার মতো। প্রয়োজনের চেয়ে কথা বেশিও বলতেন না, কমও বলতেন না। অশোভন, অশ্লীল ও নির্লজ্জ ধরনের কথাবার্তাকে ঘৃণা করতেন। কথাবার্তার সাথে সাধারণত একটি মুচকি হাসি উপহার দিতেন।’

তিনি নিখিল বিশ্বের নবী-রাসূল ও নেতা ছিলেন। প্রচার, শিক্ষাদান, সংস্কার ও সংশোধন এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত তৎপরতা চালানোর জন্য তাঁকে জনগণের সাথে যোগাযোগ করাটা ছিল অত্যাবশ্যক। তাই বলে এর বাইরে মানবজীবনের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত অন্যান্য যোগাযোগ তৎপরতা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তা নয়। গুরুভার দায়িত্বের বোঝা তাঁর অন্যান্য যোগাযোগে বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারেনি। দায়িত্বের কঠিন বোঝা নিয়েও তিনি মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছেন। মানুষের সমস্যাবলির সুষ্ঠু সমাধানের আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। বিপদগ্রস্তদের উদ্ধারে তিনি বড় বড় উদ্যোগ নিয়েছেন। একবার তিনি আবু জেহেলের কাছ থেকে ভিনদেশী পাওনাদারের পাওনা আদায় করে দিয়েছিলেন। 

আমাদের যারা নেতা, তাদের সম্পর্কে একটি অভিযোগ শুনতে হয় যে, তারা নিজেদের বাইরে অন্যান্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগে খুবই দুর্বল। ঠিক একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে আমাদের কিছু ইসলামী স্কলার, কবি, সাহিত্যিক বা কোনো কোনো ইসলামী প্রতিষ্ঠানের কর্তা বা মালিকদের ব্যাপারে। তারা তাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্যান্য যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন। যা রাসূল সা:-এর জীবন চরিতের অনেকটা অসদাচরণ। 
লেখক : প্রাবন্ধিক


আরো সংবাদ



premium cement
‘ফ্রি ভিসার গল্প’ আর শূন্য হাতে ফেরা লাখো শ্রমিক নোয়াখালীতে প্রবাসীর স্ত্রীর ব্যক্তিগত ছবি দেখিয়ে চাঁদা আদায় দেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে, অথচ বিরোধী দল দেখে না : কাদের আশুলিয়ায় বাঁশবাগান থেকে নারী পোশাক শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ফেরত গেলেন, কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট কি আরো জটিল হচ্ছে দিনাজপুরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষ, চালক-হেলপার নিহত মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ সখীপুরে বৃষ্টির জন্য অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা দক্ষিণ ভারতে কেন কাজ করেনি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নতুন আংশিক কমিটি বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা অন্বেষণে থাইল্যান্ডের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

সকল