২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঘটনা দু’টির মিল-অমিল

-

দেশের উচ্চশিক্ষার পাদপীঠ বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের দুই ডজন নেতাকর্মীর একটানা ৩৬০ মিনিট ধরে পৈশাচিক নির্যাতনে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণকারী একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭তম ব্যাচের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তার মাগফিরাত কামনা করে অভিভাবকদের অব্যক্ত মনের দু’টি কথা লিখছি। সম্প্রতি ভারত সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যকে ফেনী নদীর পানি দান, এলএনজি গ্যাস রফতানি এবং বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে রাডার স্থাপনের ব্যাপারে সম্পাদিত চুক্তি সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়াকে বেয়াদবি এবং অসম্মান প্রদর্শনের দুঃসাহস মনে করে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের টর্চারসেল খ্যাত একটি কক্ষে গত ৬ অক্টোবর রাত ৮টায় আবরারকে ডেকে নিয়ে ছাত্রলীগের দুই ডজন ‘ক্যাডার’ ছয় ঘণ্টা ধরে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে জানা যায়। অতীব দুঃখ ও লজ্জাজনক বিষয় হচ্ছেÑ দীর্ঘ ৩৬০ মিনিটব্যাপী নির্যাতনকালে তাকে নির্যাতনকারী সিনিয়র ও সহপাঠী দ্ইু ডজন মেধাবী হত্যাকারীর কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে আর্তচিৎকার করলেও ওদের মনে দয়ার উদ্রেক হয়নি। তেমনি হলের প্রভোস্ট, হল সুপার ও হলের কর্মচারীদের কর্ণকুহরে তার আর্তচিৎকারের ধ্বনি প্রবেশ না করায় তারা কেউ আবরারের প্রাণ রক্ষার্থে এগিয়ে আসেননি। কারণ এরূপ কান্নাকাটি ও আর্তচিৎকার ১১ বছর ধরে তারা শুনে এলেও আবরারের মতো মৃত্যুভাগ্য কারো কপালে না জোটায় হল প্রশাসন ও কর্মচারীরা হয়তো মনে করেছেনÑ হলের আসল প্রশাসক বা পরিচালক ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিবিরকর্মী বা ভিন্নমতাবলম্বীদের শায়েস্তা করছে কিংবা ‘আদব লেহাজ’ শিক্ষা দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষক আগে একই সংগঠন করতেন বলেই চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতি পেয়ে অনেকেই ভিসি, প্রোভিসি, প্রক্টর, প্রভোস্ট ও হল সুপার পদে পোস্টিং পেয়েছেন। কর্মচারীরা সবাই শ্রমিক লীগভুক্ত বিধায়, সবাই চুপ থেকেছেন। সাধারণ ছাত্ররা আর্তচিৎকার শুনতে পেয়ে এগিয়ে এলে তাদের ‘শিবিরকর্মী’ আখ্যায়িত করে উত্তম-মধ্যম দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হতো, যা অতীতে বহুবার ঘটেছে। পুলিশ সাধারণ শিক্ষার্থীদের চার-পাঁচটি পেন্ডিং মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করায় তাদের শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটত। তাই তারা ভয়ে দরজায় সিটকিনি দিয়ে ‘ইয়া নফসি ইয়া নফসি’ করে ‘আল্লাহ আমাকে বাঁচাও’ বলে জান বাঁচাতে ব্যস্ত ছিল। ছাত্রলীগের সাথে ১১ বছর ধরে পুলিশের সখ্য চলায় তারা ফোন করে পুলিশ এনেছিল আবরারকে ‘শিবিরকর্মী’ হিসেবে তাদের হাতে তুলে দিতে। কিন্তু আবরারের ‘ভাগ্য ভালো’, সে মরে ‘বেঁচে গেছে’। তা না হলে পুলিশ তাকে হয়তো চার-পাঁচটি পেন্ডিং মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে চালান করে দিত এবং পরের দিন পত্রিকায় খবর বের হতে পারত, ‘বুয়েট থেকে শিবিরকর্মী গ্রেফতার’, যা আবরারের বাবা-মায়ের কাছে আরো মর্মজ্বালার কারণ হতো। এত শোকমিছিল ও প্রতিবাদ মিছিল কিছুই তখন হতো না। কিন্তু আবরার মৃত্যুবরণ করায় পুলিশের এসআই মৃতদেহ গ্রহণ করে দায় কাঁধে নিতে রাজি না হওয়ায়, তাকে এক ঘণ্টা বসিয়ে রেখে হলের ডাক্তার ডেকে আবরারকে জীবিত প্রমাণ করার অপচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় এসআইকে সেদিন রিক্তহস্তে ফিরতে হয়েছিল।
আবরারের হত্যাকারীদের সাথে এ সরকারের পরম বন্ধুদেশ, ভারতের উত্তর প্রদেশে ফ্রিজে গরুর গোশত রাখার কথিত অভিযোগে শাসক দল বিজেপির উগ্র সাম্প্রদায়িক কর্মীদের পিটুনিতে আখলাকের মৃত্যুবরণ করার ঘটনার অদ্ভুত মিল পরিলক্ষিত হয়। ফ্রিজে রাখা খাসির গোশতকে গরুর গোশত বলে অপপ্রচার চালিয়ে ক্ষমতাসীন বিজেপির হিন্দুত্ববাদী কর্মীরা আখলাককে বাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে এনে পুলিশ ও হাজার হাজার মানুষের সামনে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করলেও পুলিশ বা জনতা কেউ এগিয়ে আসেনি, বরং নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলাদেশেও পুলিশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও কর্মচারী এবং শত শত সাধারণ ছাত্রের কেউ ছাত্রলীগের ভয়ে আবরারের প্রাণ বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। ভারতে গরু পরিবহনের ‘দায়ে’ শাসক দলের উগ্র সমর্থকদের পিটুনিতে অনেক নিরপরাধ মুসলমান আহত ও নিহত হয়েছে, বাংলাদেশেও তেমনি সরকার এবং তার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করায় অনেককেই পিটুনি খেতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক ‘স্বামী-স্ত্রীর মতো’ হওয়ায় দুই দেশের ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের অপরাধপ্রবণতা ও ধরনের মধ্যেও অদ্ভুত মিল পরিলক্ষিত হয়। ভারতে আখলাকের হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করে সে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও বিদেশী দূতাবাস প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করায় ভারত সরকার যেমন নাখোশ, তেমনি বাংলাদেশেও আবরার হত্যাকাণ্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসঙ্ঘের আবাসিক প্রতিনিধি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মান দূতাবাস প্রতিক্রিয়া জানানোর কারণে সরকার তাদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। দুই দেশের প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকাও একই রকম। পার্থক্য হলো, আখলাকের হত্যাকারীদের কেউ আবরার হত্যাকারীদের মতো শিক্ষিত হিসেবে পরিচিত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল না। আখলাকের মতো কেউ আক্রমণের শিকার হলে ভারতের পুলিশ এগিয়ে এলেও আক্রান্ত ব্যক্তি জীবিত থাকলে তাকেই গ্রেফতার করে। তেমনি বাংলাদেশেও পুলিশ আক্রমণকারীদের টেলিফোন পেয়ে এগিয়ে এসে পিটুনির শিকার ছাত্রকেই গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
আমজনতার জন্য অতীব লজ্জা ও দুঃখের বিষয় হচ্ছেÑ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি, প্রোভিসি, প্রক্টর, প্রভোস্ট ও হল সুপারসহ শিক্ষকমণ্ডলী পাশ্চাত্যের পিএইচডিধারী হলেও তারা যে গত ১১ বছরে সবাই বিবেকহীন হয়ে পড়েছেন, তা তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই প্রমাণ দিয়েছেন। ভিসি সাহেবের ঘটনাস্থলে ও জানাজায় না আসা এবং দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টা দেরিতে অফিসে আগমনÑ সব কিছুুই রহস্যজনক মনে হচ্ছে। গত ১১ বছরে ছাত্রলীগের নির্যাতনে ২৪ জন নিরীহ ছাত্র প্রাণ হারালেও তাদের নির্লিপ্ততা অভিভাবকদের যতটা না হতাশ করেছে, তার চেয়ে বেশি পীড়া দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক, খোদ চ্যান্সেলরের নির্লিপ্ততা। তিনি ছাত্রলীগের একজন সাবেক নেতা ছিলেন। অপর দিকে মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। তার রয়েছে দীর্ঘ ৫০ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক অতীত। ৩৫ বছর তিনি সংসদ সদস্য ছিলেন এবং সাত বছর ধরে দেশের সর্বোচ্চ পদ অলঙ্কৃত করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। ভিসিদের কাছে তার একটি আহ্বানই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে বলে জনগণ বিশ্বাস করে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান পরিবেশ ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৮ সালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ওই সময় তৎকালীন সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন বা এনএসএফের গুণ্ডারা সরকারের মদদে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে যা করত, বর্তমানে ছাত্রলীগ তা-ই করছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ১৯৭১ সালের ১৬ অক্টোবর নিহত মোনায়েম খান ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটানা সাত বছর পদাধিকার বলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর থাকাকালে তার প্রত্যক্ষ মদদে সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠন তাণ্ডব চালিয়েছিল। এনএসএফ ক্যাডারদের গুণ্ডামির ভুক্তভোগী ছিলেন সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, কাজী জাফর আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, শেখ ফজলুল হক মণি, নূরে আলম সিদ্দিকী প্রমুখ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতা।
সরকারসমর্থক শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সুশীলসমাজের অনেকেই টেলিভিশনের টকশোতে মন্ত্রীদের সাথে সুর মিলিয়ে বলে থাকেন, বিএনপির শাসনামলে ছাত্রদলও অনুরূপ কুকর্ম করত। জনগণের জবাব হচ্ছে, সে কারণেই তো জেনারেল মইন ইউ’র সাহায্যে বিএনপিকে হটিয়ে আওয়ামী লীগ ও জাপাকে সারাজীবনের জন্য ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। তার পরও যদি ছাত্রলীগ ছাত্রদলের দেখানো পথেই হাঁটে, তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? আবরারের হত্যাকারীরা সবাই এসএসসি ও এইচএসসিতে গোল্ডেন অ+ পাওয়ায় তারা বাবা-মায়ের নয়নের মণি ছিলেন; তেমনি স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদেরও প্রিয় ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর নষ্ট রাজনীতির খপ্পরে পড়ে এবং দলবাজ শিক্ষকদের আশকারা পেয়ে তারা হয়ে উঠেছে খুনি ও নির্যাতনকারী, যার দায় শিক্ষক ও রাজনীতিবিদদের ওপর কিছুটা হলেও বর্তায়। ভিন্নমতের শিক্ষক ও ছাত্রদের লাঞ্ছিত করা ছাড়াও কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং স্কুল-কলেজের শিশু-কিশোরদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন দমনে পুলিশের সাথে হেলমেট বাহিনী হিসেবে তাদের নামানো হলো। গত বছর ৩০ ডিসেম্বর রাতের প্রথম প্রহরে প্রশাসন, পুলিশ ও পোলিং অফিসারদের মদদে ভোটকেন্দ্র দখল করে অস্বচ্ছ ব্যালট কেটে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স পূর্তি করে ৯৭ শতাংশ আসনে সরকারি প্রার্থীদের ‘জয়’ নিশ্চিত করতে তারা ব্যবহৃত হয়েছে। অতএব, তারা তো প্রশ্রয় পাবেই। একটানা ৩৬০ মিনিট নির্যাতনের সময় প্রতি মিনিটে আবরারের প্রাণভিক্ষার আবেদন দুই ডজন মেধাবী ছাত্রের একজনের হৃদয়েও সামান্যতম আঁচড় কাটতে পারেনি। এমন যুবকরা চাকরি পেয়ে সাত হাজার টাকায় বালিশ এবং ৩৭ লাখ টাকায় পর্দা ক্রয় করবে না তো কী করবে?
প্রসঙ্গক্রমে পাকিস্তানের সাবেক স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান কর্তৃক একটি প্রাণভিক্ষার আবেদন প্রত্যাখ্যানের ঘটনা স্মরণীয়। এই প্রাণভিক্ষার আবেদনের তদবিরকারী ছিলেন বাঙালি একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তাকে আইয়ুব খান বলেছিলেন, ‘প্রাণদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি ১৯ বার আঘাত করে হতভাগ্য লোকটিকে খুন করেছিল। হতভাগ্য লোকটি এই ১৯ বারই খুনির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েও বাঁচতে পারেননি। তাই তার প্রাণভিক্ষার আবেদনও বিবেচনাযোগ্য নয়।’ নষ্ট রাজনীতি ও দলীয় ব্যক্তিদের আশকারার যৌথ পরিণামে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে কী পয়দা হয়ে বের হচ্ছে? ফায়দাতন্ত্রের রাজনীতির পয়দাতন্ত্রের খেলা আর কত দিন চলবে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিরীহ ছাত্রদের উপযোগী শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য আর কত বছর আমাদের প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে হবে? হ

 


আরো সংবাদ



premium cement